খরবটি আশাপ্রদ। দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার বুঝতে পেরেছে, তাদের ঐক্য দরকার। দেশজুড়ে নাশকতার সা¤প্রতিক অপচেষ্টার পর সকল বিভেদ ভুলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৪ দল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে ১৪ দলের নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তব্য রেখেছেন।
নেতারা বলেছেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক শেষে ১৪ দলসহ মহাজোটের কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশাজীবী সংগঠনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করে রাজপথে নামানো হবে।
শরিক দলগুলোর নেতারা ১৪ দলের বৈঠক নিয়মিত না হওয়ায় ব্যথিত ছিলেন আগে থেকেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় শরিকদের মতামত ও পরামর্শ না নেয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা প্রধানমন্ত্রীর সামনেই। মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন থেকে প্রতি মাসে অন্তত একবার ১৪ দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে খালেদা জিয়া ও জামাত ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছে। এদের মোকাবেলা করতে ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিএনপি-জামাতের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে শিগগিরই আমরা রাজপথে নামবো। তার এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছে একুশে আগস্টের সিরিজ বোমা হামলার স্মৃতি। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, খালেদা জিয়া ও নিজামীর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।
স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিদের রক্ষা করতে খালেদা জিয়া এখন ককটেল নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এই ককটেলবাজ ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর মোকাবেলা করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আমরাও মাঠে নামবো। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, খালেদা জিয়া যখন প্রকাশ্যেই বলেন নিজামী-মুজাহিদরা যুদ্ধাপরাধী নয়, তখন বুঝতে হবে তাদের রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য কী? তাই মুক্তিযুদ্ধের সব শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এ অপশক্তিকে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শেখ হাসিনা ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছেন, মহাজোটের শরিক দলগুলোর পাশাপাশি কয়েকটি সমমনা এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলও একই ইসুতে আওয়ামী লীগের পাশে থাকবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ইতোমধ্যে মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইসুতে একইসঙ্গে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে।
আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল অভিন্ন ইসুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
জানা যাচ্ছে, আগামী জানুয়ারিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের দলগুলো নিয়ে রাজধানীর পল্টন ময়দানে সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। পরে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায়ও সমাবেশ করবে দলটি। এছাড়া আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগও রাজধানীতে পৃথক সমাবেশ করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইসুতে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামানোর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে ছাত্রলীগ।
যুব সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে বিভিন্ন যুব সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুবলীগ। দেশের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদেরও সম্পৃক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে।
আজ যে বেগম জিয়া দেশরক্ষা করার কথা বলছেন তার অতীত ইতিহাস কী? তা আমাদের মনে রাখা দরকার। আমাদের মনে আছে, ১৯৭৩ সালের দালাল আইনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এগারো হাজার স্বাধীনতাবিরোধীর বিচার চলছিল। এর মধ্যে ৬শ বিচারাধীন আসামিসহ সবাইকে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর মুক্ত করে দিয়েছিলেন দালাল আইন বাতিলের মাধ্যমে।
যার সিংহভাগই পরবর্তীতে জিয়ার দল বিএনপিতে যোগদান করেছিল। বাংলাদেশে পুরোনো মৌলবাদ ও রাজাকারদের রাজনীতির সূত্রপাত এভাবেই শুরু হয়েছিল পুনরায়। এর পরই বাংলাদেশের মানুষকে বিভক্তির চেষ্টা করা হয়। এর একটি পক্ষ বিএনপি, জামাত মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। আর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রগতিশীল দল নিয়ে নিয়ে অন্য আরেকটি পক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়।
এভাবেই জাতিকে বিভাজনের বিষবৃক্ষটি নিজ হাতে রোপণ করে গেছেন সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান।
দেশ আজ বিজয়ের চার দশক পেরিয়েছে। পেছন ফিরে তাকিয়ে আমাদের সামনে এগোতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এর সঠিক প্রক্রিয়া কী? মনে রাখা দরকার, দেশের বিপুল সম্ভাবনাময় নতুন প্রজন্ম রয়েছে।
যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করবে। যে চেতনা, আদর্শ ও স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে এ প্রজন্ম দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর এর জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব।
বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটাবার কথা বলা হচ্ছে। আমরা দেখছি, একটি মহল ইন্টারনেটে ভুল তথ্য দিয়ে প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। এদের অবসর সময়, অনুভূতি, মনন, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ এই ইন্টারনেট বা সাইবার পৃথিবীতে ঘটে। তদের চিন্তাভাবনা, চেতনাÑ সব কিছুই শেয়ার হয় ফেসবুক, ব্লগ সাইট ও টুইটারের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বেশিরভাগই ১৪ থেকে ৩০ বছর বয়সী মানব-মানবী।
তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। ১৯৭১ সাল তাদের কাছে এক কল্পনার ইতিহাস। আমরা দেখছি আজ ফেসবুকে ‘বিজয়ফুল’ নিয়ে গর্ব করছে এই প্রজন্মই। শুধু ডিসেম্বর নয়, গোটা বছরব্যাপী এই চেতনার জাগরণ আমরা চাই। মননের উন্মেষ চাই।
এ বছরও দেখেছি, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে সামাজিক যোগাযোগের প্রায় প্রতিটি মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের ছবি, পতাকার ছবি, দেশের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, একাত্তরের গল্প, মুক্তিযোদ্ধার গল্প, বীরের গল্প। কেউ একজন ফেসবুকে লিখেছেন, যেন লাল-সবুজের পতাকায় রঙিন হয়ে উঠেছে পৃথিবী। সব আবেগ, সব চেতনা, সব বিশ্বাস যেন জমা হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
আমরা বিশ্বাস করি, এই প্রজন্মের কেউই ভুলে যায়নি সেই ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ধারালেখা। দুলাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকার স্বপ্নবুনন।
দেশে আজ মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করতে চাইছে সেই পরাজিত রাজাকার শক্তিও। তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে! কী ভয়াবহ সংবাদ! অথচ আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের অনন্তকালব্যাপী প্রগতির পথ দেখাবে। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রতীককে কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। এর ধারক হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
বাঙালি অতীতে তো পেরেছে।
আরো পারতে হবে। এর প্রমাণ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন। ৫৪-এর গণরায়। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন। ৬৬-এর ৬ দফা ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনাকে আরো সূর্যরাগে উজ্জ্বল করেছে। শাণিত চেতনা প্রবাহের মতোই এক বিশাল ব্যাপক আবেদন আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়েছে স্বৈরশাসনের অবসানে।
আমাদের কাব্য-কলার বেদিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেন এক স্বতঃউৎসারিত ধারা। দিন যতোই সামনে যাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপে লালিত হবে আমাদের সমাজচেতনা। দেশ মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার অঙ্গীকারে শাণিত করবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এখনো আমাদের কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছেন। তা সত্যিই একদিকে বিস্ময়কর, অপরদিকে গর্ব ও গৌরবের বিষয়। আজকের পরিবর্তনকামী জনগণকে সাহস জোগাতে তাই বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমান সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র (১৫ খ-)’ গ্রন্থমালা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা নিজ প্রতিষ্ঠানে বসেই তাদের পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাথা জানতে ও পড়তে পারবে।
তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের শত্রু-মিত্রদের যথাযথ ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস শিখতে পারবে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নিয়ে আলোচনা, শর্টফিল্ম প্রদর্শনী, আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে।
এক সমুদ্র রক্ত ও লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা।
মুক্তিসেনার রক্তে রঞ্জিত এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল এ স্বাধীনতার সঙ্গে অনেক সংগ্রামী চেতনা বিজড়িত। তবে ঐক্যবদ্ধ জীবন প্রচেষ্টা, মিলন-বিরহ, আশা-নিরাশার বাস্তব অনুভূতি সংবলিত এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী অপরাজেয় এ চেতনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন করে পরিচিত হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। আর তাই কেউ বা মুক্তিযুদ্ধের বই পড়ে আবার কেউ বা দাদা-দাদি, বাবা-মা অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন সেই সময়ের মুহূর্তগুলো। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের কথামালাকে চলচ্চিত্রের সুতোয় বেঁধে উপস্থাপন করা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। কিভাবে বাঙালি জাতিকে চিরতরে মাথা নুইয়ে দেয়ার জন্য এ দেশের দোসররা পাক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
আর কিভাবে নিজের প্রাণ বাজি রেখে এ দেশের দামাল ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ‘মুক্তির গান’, ‘একাত্তরের যিশু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’Ñ এরকম আরো অনেক চলচ্চিত্র আমাদের অনবদ্য দলিল।
ইতিহাসের আলোকে আমাদের ঐক্য দরকার। বর্তমান সরকার তাদের উদার হাত যতোটা বাড়িয়ে দেবে, ততোই উপকৃত হবে দেশ-মানুষ।
২২ ডিসেম্বর ২০১১
ফকির ইলিয়াস : কবি ও সাংবাদিক
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।