দেয়ালে দেয়ালে ছায়া দিয়ে লেখা মিথ্যা স্লোগান সত্যি হয়ে উঠুক একদিন (২য় পর্ব প্রকাশের পর)
পাক-সরকারের কারাগার থেকে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির সম্ভাবনা এক সময় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকলে মুুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন দেশের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতাদের একাংশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত নেতাকর্মীদের নিয়ে মুজিব বাহিনী নামে প্রায় ৮ হাজার সদস্যসম্বলিত একটি আলাদা বাহিনী গঠন করেন। এ সময় একটি বিশেষ রাজনৈতিক কমান্ডো-বাহিনী হিসেবে মুজিব বাহিনী প্রতিষ্ঠা করায় মস্কোপন্থী কমিউনিস্টগণ ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় ২০ হাজারের অধিক তরুন যুবককে গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। প্রশিক্ষণ শেষে এঁরা ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এবং রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের রণক্ষেত্রগুলোতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা যুদ্ধ ছাড়াও সংবাদ বহন, রেকি করার মতো যুদ্ধে সহায়ক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া প্রবাসী সরকারের প্রথম বিমান বাহিনী গঠন এবং নৌবাহিনীর অভূতপূর্ব সাহসী অপারেশনগুলোতে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ব্যাপক ভূমিকা বজায় থাকে।
অন্যদিকে পিকিংপন্থী বাম নেতাকর্মীগণ তাঁদের ভিন্নতর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করলেও মুক্তিযুদ্ধে পাক-সরকার কর্তৃক গণহত্যাকে পিকিং বা চীন পরোক্ষভাবে সমর্থন করলে তাঁরা আদর্শিকভাবে বিপর্যস্ত হন। এ নিয়ে পিকিংপন্থী বামদের মধ্যেকার চলমান উপদলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফর আহমদসহ পিকিংপন্থী নেতাদের একাংশ এ সময় ভারতে অবস্থান করে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একটি বামপন্থী ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করেন। কেননা, চলমান মুক্তিযুদ্ধ রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের স¤প্রসারণবাদী চক্রান্তের ফসল। তাই ভারত-রাশিয়ার সহযোগিতায় আওয়ামীলীগ এ মুক্তিসংগ্রামের ফলাফলকে এ দুটো দেশের হাতেই তুলে দেবে।
এঁদের মধ্যে কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা নেতৃত্বাধীন দলটি (পূর্ববাংলা সাম্যবাদী দল) এক সময় চীনা দৃষ্টিভঙ্গিকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেন এবং একইসঙ্গে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-রাশিয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁরা খাঁটি কমিউনিস্ট নেতৃত্বে রামগতি নোয়াখালীতে ১০ হাজারের অধিক সদস্য সম্বলিত লাল গেরিলার মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি অংশ করে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে তাঁরা যুগপৎ পাকিস্তান বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করার দুমুখো যুদ্ধ-কৌশল গ্রহণ করেন। এ সময় বেশকিছু শ্রেণীশত্রু খতমের ঘটনাও ঘটে। তবে পাকিস্তানীদের বিপক্ষে এ দলটি বেশ কিছু অপারেশনে সাফল্য অর্জন করলেও পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর অবিশ্বাস ও অসহযোগিতার কারণে তাঁরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
কমরেড মতিন-আলাউদ্দিন নেতৃত্বাধীন দলটি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে পাবনা জেলাশহর মুক্ত করার নেতৃত্ব দান করেন। এ সময় তাঁরা স্থানীয় পুলিশ ও জনগণের সহায়তায় শতাধিক পাকসনোকে হত্যা করতে সক্ষম হন। কিন্তু পরবর্তীতে এ দলটি বাংলাদেশ প্রশ্নে চৈনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, নওগাঁ রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে পিকিংপন্থী ওহিদুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পিকিংপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রচলিত দুই ককুরের লড়াই তত্ত্ প্রত্যাখান করেন। তিনি মার্চের গণহত্যা শুরুর আগে থেকেই স্থানীয় স্বচ্ছল ব্যক্তিবর্গ ও থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে তাঁর সহস্রাধিক রাজনৈতিক সহকর্মীকে অস্ত্র ও যুদ্ধের কলাকৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন আত্রাই অঞ্চলটি ছিল রাজশাহীর বাঘমারা থানার তাহেরপুর থেকে নওগাঁর সরল শিকারপুর পর্যন্ত ৫০ মাইল, নওগাঁর মান্দা থানার প্রসাদপুর থেকে নাটোরের সিংড়া থানার কালিগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৫০ মাইল এবং বগুড়া সান্তাহারের সান্ধিরা গ্রাম থেকে নাটোরের নলডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৫০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ দলে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষারত ছাত্র, স্থানীয় কৃষক-শ্রমিক-মজুর ছাড়াও পুলিশ-আনসার-ইপিআর ও সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ও পালিয়ে আসা সদস্যরা ছিলেন। ওহিদুর রহমান তাঁর যোদ্ধাকর্মীদের নিয়মিত সেনাবাহিনীর আদলে সেকশন, প্লাটুন, কোম্পানী, ব্যাটেলিয়ন পদ্ধতিতে গড়ে তোলেন। সহস্রাধিক সদস্য সম্বলিত এ দলটি মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুুড়ে শত শত পাকসেনা ও রাজাকার হত্যার মাধ্যমে একটি বিস্তৃত অঞ্চল প্রায় মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত পর্যায়ে কিছুকিছু অপারেশনে ওহিদুর বাহিনী ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করে এ দেশ মাটি ও মানুষের জন্য বিজয় নিশ্চিত করেন।
আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, চলমান রাজনৈতিক সমস্যাবলী বিশ্লেষণের দূর্বলতা প্রভৃতি যে কারণেই হোক মুক্তিযুদ্ধকালে মানবজাতির প্রাগ্রসর চিন্তাধারার অধিকারী হিসেবে খ্যাত বামপন্থী রাজনীতিকদের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ ভ্রান্তির শিকার হয়ে জনবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনার প্রয়াস পেলেও ব্যতিক্রমবাদে অন্তর্গতভাবে তাঁদের সকলেরই স্বপ্ন ছিল এক শোষণমুক্ত অসা¤প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা। কেননা এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মঙ্গল ও সমৃদ্ধি সম্ভব। (সংক্ষেপিত)
*** সমাপ্ত ***
সহায়ক গ্রন্থাবলী :
ক. মঈদুল হাসান, মূলধারা ’৭১, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৬
খ. নাড়গোপাল ঘোষ, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও তার পটভূমি, কল্পনা বক সিন্ডিকেট, নদীয়া, ১৯৯৭
গ. তালুকদার মনিরুজ্জামান, বামপন্থী রাজনীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৭
ঘ. ওহিদুর রহমান, আত্রাইয়ের কৃষক, মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল ও দুই পতাকা (অপ্রকাশিত)
ঙ. আমজাদ হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা, পড়–য়া, ঢাকা, ১৯৯৭
চ. জাগলুল আলম, বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলনের গতিধারা ১৯৪৮-১৯৮৯, প্রতীক, ঢাকা, ১৯৯০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।