দেয়ালে দেয়ালে ছায়া দিয়ে লেখা মিথ্যা স্লোগান সত্যি হয়ে উঠুক একদিন (প্রথম প্রকাশের পর)
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ভারতে বিপুল পরিমান যুদ্ধরসদ সরবরাহ করলে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্কের সুবাদে আইয়ুব খান ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখান পিকিংপন্থীগণ। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে তাঁরা এই আলোকে বিচার করতে গিয়ে এটাকে মার্কিন স্ম্রাাজ্যবাদী চক্রান্তের ফসল হিসেবে নির্ধারণ করেন এবং আইয়ুব খানের বিরোধীতা করাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করার প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করেন। ফলে তাঁরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতিমা জিন্নাহ-র বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের পক্ষে কাজ করেন। অথচ আইয়ুব সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিয়েটো, সেন্টো এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি বজায় রেখেছে, এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এ সরকারের নির্ভরশীলতা রয়েছে। এরপর ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন (পিডিএম) গঠন করে সংসদীয় গণতন্ত্র পদ্ধতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হলে পিকিংপন্থীরা নিজেদের এ আন্দোলন থেকে বিরত রাখেন।
এমনকি এর আগের বছর ১৯৬৬ সালে আওয়ামীলীগ উপস্থাপিত অত্যন্ত জনপ্রিয় ৬ দফা আন্দোলন থেকেও বিরত থাকেন তাঁরা। তাঁদের মতে, ৬ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের সংখাগরিষ্ট জনগণের- শ্রমিক, কৃষক এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাক্সা প্রতিফলিত হয় নি। তাই এটা কেবল পূর্ব-পাকিস্তানে একচেটিয়া অধিকারীদের একটি নতুন শ্রেণীর জন্ম দিবে। এটা সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে আতাঁতের ফলে সৃষ্ট একটি কর্মসূচী ছাড়া কিছু নয়।
অন্যদিকে বামপন্থীদের আরেক অংশ সোভিয়েত বা মস্কোপন্থী নেতৃবৃন্দ পিকিংপন্থীদের সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিবর্তে প্রাথমিকভাবে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশলকে গ্রহন করেন, যা ক্রমশ সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে।
এজন্য তাঁরা আওয়ামীলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের চরম পর্যায়ে ১৯৬৮ সালে মস্কোপন্থীরা সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন এবং আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত যুক্ত থাকেন।
অন্যদিকে, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামীলীগ (ইপিএএল) নেতা শেখ মুজিবর রহমান এ অঞ্চলের প্রধান বিরোধী নেতায় পরিণত হন। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবিতে ৬ দফা আন্দোলনের কর্মসূচী হাতে নিলে এদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব আওয়ামীলীগের হাতে চলে আসে। প্রথমদিকে এ আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আন্দোলন হিসেবে প্রকাশ পেলেও ক্রমশ এতে দেশের আপামর জনসাধারণ সম্পৃক্ত হলে অচিরেই আন্দোলনের চরিত্র বদলে যায়।
৬ দফা আন্দোলন পরিণত হয় গণমানুষের আন্দোলনে। তবুও আওয়ামলীগের নেতৃত্ব হারানোর ভয় ছিল। কেননা, পরবর্তী গণআন্দোলনগুলোতে বামপন্থী ক্যাডার, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক ও নিম্নবিত্ত মানুষের এক বৃহৎ অংশ যারা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রগতিশীল চিন্তাধারা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁরা কেবল বাংলার ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়, কৃষক-শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠার জন্যেও লড়েছিলেন। তাই আওয়ামীলীগ নেতারা তাঁদের স্বায়ত্বশাসনের অর্থনৈতিক কর্মসূচীতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে এটাকে গণমুক্তির দফা হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হন।
অন্যদিকে ষাটের দশক থেকে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যেকার মতাদর্শ ও কৌশলে শত্রুতাপূর্ণ কোন্দল ও বিভক্তি জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, জনগণ নেতৃত্ব তুলে দেয় আওয়ামীলীগের হাতে, রাজনৈতিক মঞ্চের কেন্দ্রে চলে আসেন শেখ মুজিবর রহমান।
আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে, বামপন্থীদের প্রধান দুই উপদলের মধ্যে পিকিংপন্থীগণ শুরু থেকেই আওয়ামী নেতৃত্বাধীন চলমান কর্মসূচী সম্পর্কে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে এ থেকে বিরত থাকেন এবং মস্কোপন্থীগণ প্রাথমিকভাবে জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল অবলম্বনের অংশ হিসেবে আওয়ামীলীগকে সমর্থন করেন এবং সম্পৃক্ত থাকেন। তাঁরা বন্দুকের নল সকল ক্ষমতার উৎস- এ তত্ত্বকে খারিজ করে বিপ্লবী সচেতনতা ও কর্মজীবী মানুষের একতার মধ্য দিয়ে সংসদীয় পন্থায় সমাজতন্ত্র কায়েম করতে সচেষ্ট হন। এজন্য তাঁরা পরবর্তী ১৯৬৯ সালের গণঅথ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এখানে উল্লেখ্য, ’৬৯-্এর গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরি হয়েছিল বামপন্থী মওলানা ভাসানী আয়োজিত কাগমারী সম্মেলনে এবং এর নেতৃত্বের প্রথম সারিতে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য থাকলেও মূল সংগঠক ছিলেন কমিউনিস্টগণ।
কিন্তু পার্টি নিষিদ্ধ, বিপুল সংখ্যক নেতৃবৃন্দ কারাগারে বন্দি ও হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক ইত্যাদি কারণে সাধারণ মানুষ ভয় পেতো এ দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। এজন্যই সাধারণ মানুষ অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী আওয়ামীলীগকে মুসিলিম লীগের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে। আওয়ামীলীগ এর ফল পায় পরবর্তী ’৭০-এর নির্বাচনে।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ৭৬.৫ % ভোট পেয়ে ৩০০ প্রাদেশিক আসনের মধ্যে ২৮৮টি এবং জাতীয় পরিষদে ৭২.৬ % ভোট পেয়ে ১৬২ টি আসনের মধ্যে ১৬০ টি আসন লাভ করে। এতে আওয়ামীলীগ প্রাদেশিক পরিষদ নয় পুরো পাকিস্তানে সরকার গঠনের অধিকার লাভ করে।
কিন্ত পাক-সরকার নির্বাচনের এ ফলাফল প্রত্যাখান করে উল্টো বলপ্রয়োগ ও হত্যার মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল হাতে নিলে এদেশের মানুষের স্বাধীকার আন্দোলন স্বাধীনতা-সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধে মোড় নেয়। পাক-সরকারের হাতে বন্দি হন এদেশের মানুষের সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিবর রহমান। বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ ও আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ প্রতিবেশী-দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁরা দ্রুত প্রবাসী সরকার গঠন করে জনতার মুক্তিসংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত করার প্রয়াস পান। এ সময় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিপক্ষে কার্যকর যুদ্ধ ও সে যুদ্ধে সাফল্য নিশ্চিত করার লক্ষে ভারতের সহযোগিতায় এক লাখের অধিক মুক্তিকামী জনতাকে গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এসকল গেরিলার একটি বড় অংশ ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কৃষক-শ্রমিক। প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলা বা মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ তাঁদের নিজ দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রাধান্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণকামী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আওয়ামীলীগের নীতি অনুযায়ী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত না করার বিধি সত্ত্বেও ভারতে আশ্রয়কৃত বামপন্থী নেতাকর্মী ও সংগঠন তথা মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, মস্কোপন্থী ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, কৃষক ইউনিয়ন প্রাথমিক অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর একটি সহায়ক-শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখেন। তাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থান এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে প্রায় ১২ হাজার তরুণ-যুবককে (অধিকাংশই অরাজনৈতিক) উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীতে পাঠান। এরপর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়লে মুক্তিবাহিনীতে ক্রমান্বয়ে মস্কোপন্থী বামদের প্রায় ৬ হাজার নেতাকর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
একই প্রত্যাশায় সেপ্টেম্বর মাসে মওলানা ভাসানী, মনি সিং, মোজাফ্ফর আহমদ প্রমুখদের নিয়ে প্রবাসী সরকারের জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে মস্কোপন্থী নেতৃবৃন্দ বিপুল ভূমিকা রাখেন এ সময়। তাঁরা মার্চের শুরু থেকেই আসন্ন যেকোনো ধরনের পরিস্থিতিতে পাকিস্তানীদের প্রতিহত করার জন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে তাঁদের কুচকাওয়াজ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ২৫ মার্চ পাকসেনারা গণহত্যা শুুরু করলে মস্কোপন্থী নেতাকর্মীগণ সম্ভবপর আওয়ামীলীগ ও অন্যান্য স্বাধীনত্কাামী দল ও ব্যক্তির সহায়তায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এরপর সামগ্রিক পিরিস্থিতি বিবেচনায় সংগঠিতভাবে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করতে তাঁরা ভারতে গমণ করেন।
(চলবে..) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।