আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ বিমানের সেবা ভাল

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল বাংলাদেশ বিমানের নাম শুনতেই প্রথমেই মুখে একটা তেতো স্বাদ হয়। বাংলাদেশ বিমান হল দুর্নীতিতে আক্রান্ত, দেনায় জর্জরিত, যখন তখন দেউলিয়া হয় এমন ধুঁকতে থাকা একটি পিছিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠান যার সব কাজ বিলম্বিত। আর এর ভেতরে কিলবিল করছে শত শত পোকা, যারা দায়িত্বে কর্মচারী-কর্মকর্তা হয়েও ভয়ংকর ঘুণের মত, প্রতিষ্ঠানটিকে নিষ্ঠুরভাবে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তা স্বত্বেও এখন পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে বয়স্ক, সপ্রতিভ এবং সবচাইতে ধৈর্যশীল কেবিন ক্রু বা এয়ার হোস্টেস’রা হচ্ছে বাংলাদেশ বিমানের। সাজপোশাক, বয়সে যা’ই হোক, আমি তাদের ধৈর্যে মুগ্ধ এবং অভিভূত।

স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশ বিমান সরকারী সার্ভিস; তাই তাদের মধ্যে একটা গা ছাড়া ভাব আছে, থাকাটা স্বাভাবিক যদিও দোষের কিছু। কিন্তু তবু আমি মনে করি তাদের নিয়ে যত সমালোচনা, নিন্দা আমরা শুনতে পাই, তার পুরোটার দাবীদার তারা নন। তাদের নিয়ে থাকা সমালোচনা গুলো বিবেচনায় আনার আগে ভেবে দেখা দরকার তাদের কাজ কতটা কঠিন! তাদের কাজ হচ্ছে অদ্ভুত আচরণের কিম্ভূত বাঙালিদের, সেবার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করা। সহজ কাজ নয়। একবার মনে পড়ে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছি বাংলাদেশ বিমানে।

ভাগ্যক্রমে একটা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট পড়ে গেছে। যাদুঘরে রাখার সময় হয়ে গেছে যে ডিসি-টেন গুলোর, তাদের একটা নয়। একেবারে লিজ নেওয়া আধুনিক (অত্যাধুনিক নয়) এয়ার বাস! এইবারের মত বেঁচে যাওয়া আমার খুশি দেখে কে? তো, খুশি খুশি দাঁত গুলোকে কোনরকমে মুখের ভেতর ঠোট চেপে বন্দি করে রেখে, জাহাজে উঠার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কি ব্যাপার? পাঁচ মিনিট যায়, পনের মিনিট যায়, কিন্তু লাইন তো আর এগোয় না! বেশ কিছুটা সময় পার করে যখন বিমানের ১৪ গুষ্টি শেষ করে, ভবিষ্যতের গুষ্টির উদ্ধারের জন্য মুখ খুলব (মনের মুখ), ঠিক এইসময় দেখলাম লাইনটা চলতে শুরু করেছে। আমার খুশি খুশি দাঁত গুলো ঠোটের অসতর্কতায় এইবার বেড়িয়েই পড়ল।

কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। প্লেনে উঠে দেখি হুলস্থূল কাণ্ড! মধ্য বয়স্ক না-অতি-সুন্দর চেহারার কেবিন ক্রু'রা সমানে “হাজি সাহেব”, “হাজি সাহেবা” বলে চেঁচাচ্ছেন। আর শুভ্র পোশাকের মূলত প্রৌঢ় হজ্ব যাত্রীরা যে যেখানে বসে আছেন সেখান থেকে কেবিন ক্রুদের কাকুতিমিনতি নির্বিকার চিত্তে উপভোগ করছেন! ঘটনা হল, বোর্ডিংপাস’এ নির্দিষ্ট সিট নম্বর থাকলেও, হাজার কাকুতিমিনতি করেও হাজি সাহেবদের তাদের জন্য নির্দিষ্ট সিটে বসানো যাচ্ছে না। এই কারণেই আসলে দেড়ি হচ্ছিল বোর্ডিং করাতে। বিরক্তি হীন কিন্তু করুণ কণ্ঠে রীতিমত করজোড়ে কেবিন ক্রুরা হাজি সাহেবদের অনুরোধ কর চলেছেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা সিটে গিয়ে বসতে।

কিন্তু কে শুনে কার কথা? আমি আমার সিটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সেই সিটে বসে থাকা প্রবীণ হজ্জ-যাত্রী আমাকে বললেন, “আগে আইতে পার নাই?” তাই শুনে শূন্য চোখে আমি ঘুরে তাকালাম কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন এয়ারহোস্টেসের দিকে। দেখি তার মুখ আমার চেয়েও করুণ। কাঁচুমাচু হওয়ার ভান করে বললেন, "স্যার যেখানে খালি পান বসে পড়ুন। ওনারা বুঝতে চাচ্ছেন না। " তা আমি আর উচ্চবাচ্য না করে জানালার পাশের বিকেলের সোনালী রোদ এসে উজ্জ্বল, চমৎকার সিট'টা আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখার মায়া ত্যাগ করে ভেতরের দিকের একটা আঁটসাঁট সিটে গিয়ে বসলাম।

আমার দুইপাশে এখন সাদা মেঘের বদলে সাদা হাজি সাহেবেরা। তো এই পর্যায়ে শুরু হল কেবিন ক্রুদের সত্যিকারের পরীক্ষা। আমি বিস্ময় ভরা মুগ্ধ চোখে দেখলাম কি পরিশ্রমটা করেই না তারা হাজি সাহেবদের সেবা করে চললেন! তারা হাজি সাহেবদের অনেকের সিট-বেল্ট বেঁধে দিলেন। যখন তখন পানি চাইছেন তো, পানি দিয়ে গেলেন। তাদের ভারী আর আকার-বিহীন বোচকাগুলো উপরে বক্সে তুলে দিলেন।

বোঁচকা খুলে যেন ভোমরার পেটের ভেতরে লুকিয়ে রাখা জীবন-সম পানের ডিব্বাটা খুঁজে এনে হাজি সাহেবের হাতে দিলেন। টেক-অফের সময় এক হাজি সাহেবের বেল্ট খুলে দাঁড়িয়ে মালপত্র রাখার বক্স খুলে কি যেন খোজার কথা মনে পড়েছে। “হাজি সাহেব”, “হাজি সাহেব” বসে পড়ুন, বসে পড়ুন বলে চিৎকার করেও লাভ না হলে, দৌড়ে এসে হাজি সাহেবকে সিটে বসিয়ে, বেল্ট দিয়ে বেঁধে পুনরায় সিটে ফিরে গেলেন! এবং এই সমস্ত কাজ তারা করলেন হাসি মুখে, বিরক্তিহীন, ক্লান্তিহীন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মাত্র ৪৫ মিনিটের পথ। আর এই কেবিন ক্রুরা না জানে কতক্ষণ ধরে সার্ভিস দিয়ে থাকেন হাজি সাহেবদের, অবিরত, হজ্জ চলাকালীন সময়ে প্রতিটি ফ্লাইটে! আর তাদের নিয়ে সমালোচনা? আল্লায় সহ্য করব না।

আল্লায় সহ্য করব না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.