আমি একজন ছাত্র। আজ ১৪ ডিসেম্বর। শোকাবহ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। একাত্তরে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষ প্রান্তে যখন বিজয় আসি-আসি করছে, বিভিন্ন জায়গায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে উত্তাল-উদ্বেল পুরো দেশ; ঠিক সে সময় আসে একটি কালো দিন। পালায়নপর শত্রুরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার মিশন হাতে নেয়।
হেমন্তের স্নিগ্ধ সকালে খবর আসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান নিধনের। দিনটি ছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেশীয় নরঘাতক হায়েনার দল মেতে ওঠে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিধনযজ্ঞে।
এ রাতেই তাদের তালিকা ধরে ঘর থেকে চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। হত্যা করে ফেলে রাখা হয় নিস্তব্ধ ভুতুড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন বধ্যভূমিতে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র দু’দিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর ঘাতকচক্র ঢাকা শহরে বিশিষ্ট শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন পেশার কৃতী সন্তানদের অপহরণ করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। পরে মিরপুরের ডোবা-নালা ও রায়েরবাজার ইটভাটায় বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায় বুলেটবিদ্ধ তাদের নিথর দেহ, তাদের হাত ছিল পেছনে বাঁধা, ক্ষতচিহ্ন ছিল শরীরজুড়ে। এই নিধনযজ্ঞে জাতি হারায় তার অসংখ্য মেধাবী সন্তান। একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সে অনুযায়ী একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিত্সক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
এদের মধ্যে ছিলেন ড. জিসি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমদ, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, আরপি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহী, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীনসহ অনেকে।
যথাযোগ্য মর্যাদা ও শোকের আবহে আজ পালিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ উপলক্ষে নিয়েছে নানা কর্মসূচি। এতে রয়েছে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।
আজ ভোর থেকেই শোকাহত মানুষের ঢল নামবে সেদিনের হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতিস্তম্ভের সামনে। সেখানে অর্পণ করা হবে পুষ্পার্ঘ্য। শোকবিধুর মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। দেশের সর্বত্রই আজ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। শোকের প্রতীক কালো পতাকাও ওড়ানো হবে।
কর্মসূচি : আওয়ামী লীগ সকাল ৬টা ৩৭মিনিটে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গভবন ও সারাদেশের সংগঠন কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, ৬টা ৩৭ মিনিটে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে, ৮টা ৪০ মিনিটে রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সোয়া ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভাপতিত্ব করবেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। জাতীয় নেতা এবং বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা এ আলোচনায় অংশ নেবেন।
এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিজয় দিবস উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
কর্মসূচিগুলো হচ্ছে ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ। দুপুর ২টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউট মিলনায়তনে জিয়াউর রহমানের কর্মময় জীবনের ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও দুপুর আড়াইটায় আলোচনা সভা। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৫ ডিসেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউট প্রাঙ্গণে বিজয় মেলার আয়োজন। ড্যাবের রক্তদান কর্মসূচি, কবিতা পাঠের আসর ও গণসঙ্গীত পরিবেশন।
আড়াইটায় আলোচনা সভা, সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে পাঁচটায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ছয়টায় দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাভারের স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সাতটায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ। সন্ধ্যায় নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে জাসাসের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৭ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে থেকে বিজয় র্যালি।
১৮ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা।
এছাড়া ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের আয়োজনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ১৯ ডিসেম্বর কৃষক দল ও ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), ২০ ডিসেম্বর যুবদল, ২১ ডিসেম্বর মহিলা দল, ২২ ডিসেম্বর মত্স্যজীবী দল, ২৩ ডিসেম্বর ছাত্রদল, ২৪ ডিসেম্বর স্বেচ্ছাসেবক দল ও ২৫ ডিসেম্বর জিয়া পরিষদের উদ্যোগে আলোচনা সভা।
দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আলোচনা অনুষ্ঠান এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে।
সকাল ৮টায় মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। সকাল ৯টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। এছাড়া সকালে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সকাল সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল ও উপাচার্য ভবনসহ প্রধান প্রধান ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণের কবরস্থান, জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণের স্মৃতিসৌধ, বিভিন্ন আবাসিক এলাকার স্মৃতিসৌধ ও মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সকাল সাড়ে ১১টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে আলোচনা সভা, বাদ জোহর কেন্দ্রীয় মসজিদ, বিভিন্ন হল মসজিদ এবং উপাসনালয়ে দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করেছে।
সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) যৌথ উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী এবং মহাসচিব শওকত মাহমুদ এক বিবৃতিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য বিএফইউজের সব অঙ্গ ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয়ের ৪০ বছরের আলোচনা হবে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৩টায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।