রিমান্ড বিষয়টি অত্যান্ত অমানবিক। শ্রদ্ধেয় আব্দুল মতিন খসরু এ বিষয়ে পরিস্কার আলোচনা করেছেন। সাক্ষাতকারটি পড়লে বুঝা যায় যারা রিমান্ড চাচ্ছে এবং যারা রিমান্ড দিচ্ছে তারা সমান অপরাধী। আসুন এই নিকৃষ্ট অমানবিক রিমান্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই।
এটা রেডিও তেহরানের সাথে একটি সাক্ষাতকার।
বাংলাদেশের হাইকোর্টে হট্টগোলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার হওয়া সাবেক এটর্নি জেনারেল ও বিএনপিপন্থী বিশিষ্ট আইনজীবীর মৃত্যু, রিমান্ড ও রিমান্ডের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের আইনগত ভিত্তিসহ আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশের সাবেক আইনমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামীলীগ নেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী আব্দুল মতিন খসরুর সঙ্গে। তার পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো।
রেডিও তেহরান : জনাব আব্দুল মতিন খসরু, বিএনপি সমর্থক আইনজীবী, সাবেক ডেপুটি এটর্নি জেনারেল এমইউ আহম্মেদ মারা গেলেন। তার পরিবার এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পুলিশি নির্যাতনে তিনি মারা গেছেন। এর আগেও আমরা দেখেছি পুলিশের হাতে আটক থাকা অবস্থায় অনেকে মারা গেছেন।
তো এই যে পুলিশি নির্যাতন এটা কেন ? পুলিশ যে আটককৃত ব্যক্তির ওপর নির্যাতন চালায় বাংলাদেশের আইনে এটাকে কিভাবে দেখা হয়েছে। ?
অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু: দেখুন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন বা সেই নির্যাতনের ফলে কারো মৃত্যু - এটা গুরুতর অপরাধ। এটি দ্বণ্ডনীয় অপরাধের মধ্যে পড়ে। যদি প্রমাণিত হয় যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার হেফাজতে থাকাকালীন কোন আসামী বা কেনো ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তাহলে তার দায় দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে নিতে হবে এবং রাষ্ট্রকেও তার দায় দায়িত্ব বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে কারো মৃত্যুর জন্য ইনডিভিজুয়াল লায়াবেলিটির কথা আমাদের আইনে বলা আছে।
আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এটাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
রেডিও তেহরান : আমরা গত দুই তিন বছরে যেটা দেখছি , যারা গ্রেফতার হচ্ছেন তাদেরকে সাথে সাথেই রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। আর রিমান্ডে যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় সেটি গণমাধ্যমে নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে ।
রিমান্ডের আইনটা কি ? কখন একজনকে রিমান্ডে নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে?
অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু : আপনি দু তিন বছরের কথা বলছেন কেন- গত প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর যাবত এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। আমরা লক্ষ্য করছি - কেউ রিমান্ডের জন্য আবেদন জানালেই হাকিম বা ম্যাজিষ্ট্রেটগণ প্রায়ই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কিন্তু রিমান্ড দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ আইন এবং নিয়ম আছে। রিমান্ডের আইনে বলা হয়েছে- তদন্তের স্বার্থে এবং সত্য উদঘাটনের স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয় তাও সে রেয়ার কেসের ক্ষেত্রে রিমান্ড দেয়া যেতে পারে। শুধু তাই নয় স্পষ্টভাবে বলা আছে - কি কারণে রিমান্ড প্রয়োজন তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ম্যাজিস্ট্রেট বা হাকিমের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের দৃষ্টিকোণ থেকে রিমান্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আসামীর স্বার্থ সাক্ষ্য আইনে মূল্যহীন। আর নির্যাতনের মাধ্যমে যদি কোনো তথ্য পাওয়া যায় সেটি এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের দেশে রিমান্ডের যথেচ্ছ অপব্যবহার হচ্ছে, এবিউজ হচ্ছে। ফলে এ বিষয়টির ওপর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাকিম বা বিচারকদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
বাছ বিচার না করে , সুস্পষ্টভাবে কেস স্টাডি না করে , কি কারণে রিমান্ড চাচ্ছে তা বিশ্লেষণ না করে রিমান্ড দেয়ার একটা প্রাকটিস হয়ে গেছে। অতি সাধারণ কারণে এবং মামুলী মামলার ক্ষেত্রেও দেখা যায় রিমান্ড চাওয়া হচ্ছে । তবে এধরনের রিমান্ডকে উচ্চতর আদালতে অবশ্যই ডিসক্যারেজ করা উচিত। যে কোনো কেসে রিমান্ড চাওয়াটা যেন বাংলাদেশে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমি বলব এটা অন্যায়, এটা অবৈধ - কোন অবস্থাতেই রিমান্ড আমাদের ফৌজদারী কার্যবিধি এলাও করে না, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদেও একই কথা বলা হয়েছে।
রেডিও তেহরান : রিমান্ডে যে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হয় বাংলাদেশের আইনে এ সম্পর্কে কি বলা আছে ?
অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু: আমি এ সম্পর্কে বলব- রিমান্ড বা রিমান্ডের নামে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা সংবিধানে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ । তাছাড়া জুডিশিয়াল কাস্টডিতে আসামী যে সাক্ষ্য দেয় তার কোন দাম নেই। ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সের ক্ষেত্রে এ ধরনের সাক্ষ্য মূল্যহীন এবং আইনের পরিপন্থী। এখানে রিমান্ড সম্পর্কে আরো কিছু কথা সুস্পস্টভাবে বলতে চাই। রিমান্ড কাদের ক্ষেত্রে নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে আমাদের আইনের যে নির্দেশনা তা হচ্ছে - গ্যাং ডাকাতি, ডাকাতি, গুরুতর অপরাধ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এসব ক্ষেত্রে রিমান্ড দেয়া যেতে পারে এবং আগেকার দিনে এসব ক্ষেত্রেই রিমান্ড চাওয়া হতো ।
কিন্তু বর্তমানে যে কোন ব্যাপারে রিমান্ড চাওয়া হচ্ছে - এক্ষেত্রে আমি বলবো - ম্যাজিস্ট্রেটদের অনেকের আইনের ওপর দখল নেই, জ্ঞান নেই, পুলিশের কথা আর কি বলবো - পুলিশের তো এ ব্যাপারে জ্ঞান একেবারেই নেই। আর এজন্য তাদের জোরালোভাবে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শুধু তাই নয় বোথ অব দ্যা অথোরিটি পুলিশ এ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেট -সবার ক্ষেত্রে মনিটরিং ব্যবস্থা রাখা দরকার। আমি বলবো উচ্চতর আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের এ ব্যাপারে যথেস্ট খেয়াল রাখা দরকার ।
এখানে আমাদের কনস্টিটিউশনের আর্টিকেল ১০৯ এ মনিটরিং প্রভিশনের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
সে অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট এবং হাকিমদের মনিটরিং অথরিটি এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের এটি দেখা প্রয়োজন এবং পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরও এ ব্যাপারে প্রোপার ট্রেনিং এবং জ্ঞান আছে কিনা জানি না - তবে তাদের উচিত বিষয়টি তদারকি করা।
রেডিও তেহরান : রিমান্ডে নির্যাতনের মাধ্যমে যদি স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় , সেই স্বীকারোক্তি কি আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে ?
অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু : না সেটি আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ রিমান্ডে নির্যাতনের মাধ্যমে যদি কারো স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় সেই স্বীকারোক্তির কোনো এভিডেনশিয়াল ভ্যালু নেই। আইনের দিক থেকে এটি মূল্যহীন। এটি অনেক কারণে করা হয়ে থাকে।
অনেকে অবৈধভাবে পয়সা অর্জনের করে থাকে, অথবা কারো প্রতি প্রভাবিত হয়েও অনেক ক্ষেত্রে এটি করা হয়ে থাকে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে না বুঝে করে। এ বিষয়ে আইন ও সংবিধানের ওপর প্রোপার ট্রেনিং না থাকার কারণে অবৈধ এ বিষয়টির যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ।
রেডিও তেহরান : বিএনপি এবং আ্যডভোকেট এম ইউ আহম্মেদের পরিবার যে অভিযোগ করেছে, এটর্নি জেনারেল তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, পুলিশ যখন গ্রেফতার করতে যায় তখনই তিনি ব্যথার কথা বলেছেন, এবং তখনই ওনার হার্ট এটাক হয়েছে। ফলে পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু: দেখুন , এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি মন্তব্য করতে চাই না। কারণ বিষয়টি তদন্তের ব্যাপার। তবে আমি এটুকু বলবো- অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল ওনাকে আমি ভালো করে চিনতাম। ফলে যদি অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে তাহলে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে। তারপর পুলিশ যে কথা বলছে হার্ট এ্যাটাকের কথা।
তো আমি জানিনা উনি হার্টের রোগি ছিলেন কি ছিলেন না। পুলিশ নির্যাতন করেছিল কিনা তাও জানিনা। বিষয়টি তদন্তের ব্যাপার। তবে অভিযোগটা অবশ্যই খুবই গুরুতর। #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।