আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ও মানুষের আস্থার সংকট

প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ও মানুষের আস্থার সংকট ফকির ইলিয়াস ====================================== বাংলাদেশে অনেক কিছুই সরকার পরিবর্তন হলেও আর ফিরে আসে না। যা আসে তা দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য। রাষ্ট্রস্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এ নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি।

সুশীল সমাজরা বেশ তৎপর। শহীদ মিনারে তাদের সমাবেশ দেখলাম টিভিতে। অনেকেই সেখানে বক্তব্য রেখেছেন। এদিকে ঢাকা সিটি বিভক্ত হয়ে গেছে জাতীয় সংসদে এমপিদের ভোটে। শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক।

কোনো রাজনৈতিক কারণে নয় বরং সেবার মান বাড়াতেই ঢাকা সিটি করপোরশেনকে (ডিসিসি) দুভাগ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। জাতীয় সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে ডিসিসি ভাগ করলে নির্বাচনের বিধান রাখা হতো না। বরং মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখা হতো। তিনি বলেন, অনেকে বলছেন, রাজধানী ভাগ করা হয়েছে।

কিন্তু আমরা বলতে চাই রাজধানীকে দুভাগ করা হয়নি। লন্ডনেও দুটি সিটি করপোরেশন আছে। তাহলে ইংল্যান্ডের রাজধানী কোনটি? তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকার ১৭টি ইউনিয়ন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ডিওএইচএস ডিসিসির বাইরে। এসব এলাকায় যারা বসবাস করেন তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটার নয়। তারা শুধু জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়।

এসব এলাকাকে ডিসিসির আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারেও আমরা আলোচনা শুরু করতে চাই। ’ তিনি আরো বলেছেন, ‘১৭টি ইউনিয়নে কোনো নাগরিক সেবা নেই। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মাত্র চারটি ব্লক সিটি করপোরেশনের আওতায়। ’ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ডিওএইচএস নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে যারা বসবাস করছেন তারা ডিসিসির অধীনে না হয়েও সেবা ভোগ করছে। তারা ডিসিসিকে হোল্ডিং ট্যাক্সও দেয় না।

এসব এলাকা নিয়ে আগে কোনো কথা হয়নি। সরকার এ ব্যাপারে আলোচনা শুরু করতে চায়। ’ ডিসিসি ভাগ নিয়ে বিভিন্ন টকশো ও মিডিয়ায় আসা আলোচনা প্রসঙ্গে এলজিআরডিমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি এ বিষয়ে কথা বলছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে তারা মূল ফ্যাক্ট যাচাই না করে কথা বলছেন। আকবর সাহেব (আকবর আলি খান) বলেই বসলেন পৃথিবীর কোথাও দুটি সিটি করপোরেশন নেই।

কিন্তু এটা ঠিক না। ’ সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘লন্ডনে দুটি সিটি করপোরেশন আছে। একটি সিটি লন্ডন ও আরেকটি গ্রেটার লন্ডন। দুটির হেডকোয়ার্টারের দূরত্ব মাত্র ৫০ গজ। সেখানে দুজন আলাদা নির্বাচিত মেয়র রয়েছেন।

এছাড়াও সেখানে আরো ৩৬টি বরো কাউন্সিল রয়েছে। প্রত্যেকটিতে আলাদা মেয়র রয়েছেন। অর্থাৎ শুধু লন্ডনেই মেয়র রয়েছেন ৩৮ জন। তাদের সিটি করপোরেশন ৪শ বছরের পুরোনো। ’ তিনি বলেছেন, ‘এ ছাড়া নিউইয়র্কে একজন মেয়র থাকলেও সেখানে ৫ জন বরো কাউন্সিল মেয়র রয়েছেন।

নিউইয়র্ক সবচেয়ে ধনী শহরগুলোর একটি। তাদের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সমুুদ্র বন্দরের মালিকানা সিটি করপোরেশনের। এমনকি শহরের পুলিশের দায়িত্বও তাদের। ’ তিনি বলেন, ডিসিসি দুভাগ করতে গিয়ে সরকার বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য খুঁজে পেয়েছে। ঢাকা একটি ‘পিকুলিয়ার’ শহর।

ঢাকার আয়তন যতোখানি তার অর্ধেকও ঢাকা নয়। ভাসমান জনসংখ্যার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কেউ বলে বেড়ান, এক কোটি কেউ বলেন আবার এক কোটি ২০ লাখ। সরকার মূলত নাগরিক সুবিধা আরো বেগমান করতে ডিসিসি বিভক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নগরবাসীর দোরগোড়ায় নাগরিক সেবা পৌঁছে দিতে প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতেই হবে।

এর কোনো বিকল্প নেই। ঢাকার সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘তারা (বিএনপি) যদি জনগণের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসে ডিসিসিকে আবার আগের অবস্থায় নিতে চায় তাহলে জনগণের রায় হিসেবে আমরা তা মেনে নেবো। ’ উপজেলা পরিষদ বিল নিয়ে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট এবং উপজেলা পরিষদ সংগঠনগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিন একাধিকবার আলোচনার পর অনেকের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংশোধনী আনা হয়েছে। তারপরও বলবো এটা হয়তো পরিপূর্ণ নয়। আগামীতে আরো সংশোধনী আনা হতে পারে।

’ তিনি বলেছেন, ‘প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করে তৃণমূলের ক্ষমতা বাড়ানো এ সরকারের মূল লক্ষ্য। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের সময় উপজেলা পরিষদ প্রথম গঠন করা হয়। ’৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় এসে এক কলমের খোঁচায় তা বাতিল করে দেয়। এ সরকার উপজেলা পরিষদকে আবারো কার্যকর করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা খবরে জেনেছি, সরকার জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ করতে তৎপর হয়েছেন।

কারা হবেন এই প্রশাসক, তাও বেশ স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় নেতাদের এই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এর অর্থ হলো এই, জেলার নির্বাহী প্রশাসকদের (ডিসি) পাশাপাশি পরিষদ প্রশাসকরাও ‘উন্নয়ন’ কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এটা সরকারি একটা প্রতিপত্তি বিস্তারের চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। জানা যাচ্ছে, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের আগেই জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে।

প্রশাসক নিয়োগের সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পরিষদের নির্বাচন হবে। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসকের নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা থাকছে না। নির্বাচকম-লীতে রয়েছেন জেলার আওতাধীন স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত মেম্বার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হবেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ১৫ জন সদস্য। নির্বাচকম-লীর সদস্যদের রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পরই সরকার দ্রুত নির্বাচিত পরিষদ গঠনে উদ্যোগী হয়েছে।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপমন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন। স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে এ ব্যবস্থা না থাকলেও এ সংক্রান্ত আদেশ বহাল রয়েছে। প্রশাসকও উপমন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন। তবে প্রশাসক নির্বাচনে অংশ নিলে এই পদমর্যাদা ও পরিষদ, সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা, জনবল, গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না। এদিকে প্রশাসক নিয়োগের জন্য তালিকা চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া এখন শেষ পর্যায়ে।

বাছাইকৃতরা সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তি। সাধারণভাবে বিতর্কিত নন এবং স্থানীয় জনসাধারণ ও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য রয়েছে এমন ব্যক্তিদের নামই তালিকায় স্থান পেয়েছে। প্রত্যেক জেলায় যোগ্যতাসম্পন্ন একাধিক নেতা থাকায় চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ নিয়ে স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিষয়টি বিশেষ সতর্কতার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে। নিযুক্ত প্রশাসকরা পদে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।

নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচন পরিচালনা করবে। প্রশাসক এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত চেয়ারম্যানের ওপর পরিষদের মাধ্যমে জেলার উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক দায়িত্ব এসে পড়বে। বিরোধী দলের সরকারবিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় তিনি অলিখিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়কের ভূমিকায় থাকবেন। রাজনৈতিক তাগিদ থেকেই দলীয় প্রভাবশালী বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এই যে রাজনৈতিক খেলা তা বিএনপিও খেলেছে, জাতীয় পার্টিও খেলেছে, এখন আওয়ামী লীগও খেলছে।

লক্ষ্য একটিই, ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করা। এতে রাষ্ট্রের মানুষের আস্থা তাদের প্রতি থাকছে কিনা কিংবা আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর কারো আছে বলে মনে হয় না। যা খুবই দুঃখজনক। ডিসিসি বিভক্তি নিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলছেন ভিন্নকথা। সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান মনে করেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে প্রশাসনিক খরচ বেড়ে যাবে।

টাকা কে দেবে? সব পদ দুটি করে হয়ে যাবে। দুটি করপোরেশনের মধ্যে ঠেলাঠেলি বাড়বে। এতে জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়বে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ বলেছেন, ঐতিহাসিক ঢাকা শহরকে বিভক্ত করে পিচ্চি ঢাকাতে পরিণত করাটা অন্যায় হবে। এতে ঢাকার সম্মান এবং ঐক্যের বিনষ্ট ঘটবে।

সংবিধানে স্থানীয় সরকার কথার পরিবর্তে স্থানীয় প্রশাসন কথাটি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে রাখা হয়েছে যাতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ডিসি, ইউএনও এসব প্রশাসনিক লোককে হাতের মুঠোয় রাখা যায়। এদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদেক হোসেন খোকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিদায়ী মতবিনিময় সভায় বলেছেন, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনকে আবারো একীভূত করা হবে। একটা কথা স্পষ্ট আবেগ দিয়ে ঢাকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার জনগণের আস্থা অর্জনও সম্ভব নয়। আস্থা অর্জন করতে হলে কাজের প্রকরণ দেখাতে হবে।

আমার মনে হয়, রেপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান যেমন টিকে গেছে, ডিসিসির বিভক্তিও তেমনি টিকে থাকবে বিএনপি ক্ষমতা যদি পেয়েও যায়। বদলাতে পারে ঢাকার বিমানবন্দরের নাম। কারণ এ দেশের দলগুলো নিজেদের দলীয় ঝা-া ওড়াতে ব্যস্ত। মানুষের স্বার্থ বড়ই গৌণ, অনেকের কাছেই। নিউইয়র্ক / ১ ডিসেম্বর ২০১১ --------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ৩ ডিসেম্বর ২০১১ শনিবার প্রকাশিত ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.