আধারে দেখা বৃত্তান্ত আলোয় প্রকাশ সাংবাদিকতা একটি পেশা। একটা সময় ছিল শখের বশে কেউ সংবাদ সংগ্রহ করত,মানুষকে সচেতন করার জন্য তা প্রকাশ বা প্রচারের ব্যবস্থাও নিজেই করত। চলমান দশকে বাংলাদেশে সংবাদিকতা একটি মর্যাদাশীল পেশায় পরিণত হয়েছে। এ পেশা এমনি এমনি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। প্রতিভাবান শিক্ষত মানুষদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল আজকের সাংবাদিকতা।
বর্তমানে অনেকের মধ্যে উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর সাংবাদিকতা শুরু করার প্রবণতা বেড়েছে। মূল ধারার সাংবাদিকতার বাইরে শিক্ষনবীস-সাংবাদিকতা ব্যাপক সম্ভাবনার রূপ লাভ করেছে। এর মাধ্যমে যোগ্য, ভবিষ্যৎ দায়িত্বশীল ও নৈতিকতা সম্পন্ন সাংবাদিক তৈরি হওয়ার পথ সুগোম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা শিক্ষানবীস সাংবাদিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নিজের শিক্ষাজীবনের সাথে সাথে বাস্তব কাজের পরিবেশে থেকে সাংবাদিকতা আত্মস্থ করার সুযোগ থাকে এখানে।
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষকরাও নানা ভাবে সাংবাদিকতার বিভিন্ন ধরণের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। নিজের জানা-শোনা, বোঝা-পাড়া লেখনীর সাহায্যে উপস্থাপন করে জাতিকে দিক নির্দেশনা দেয়ার সুযোগটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েই যথার্থ ব্যবহার করে যাচ্ছেন। সংবাদিকতা এখন একটা শিল্প হিসেবে বিবেচিত। সম্ভাবনার এ শিল্প প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে তা ঝুকিপূর্ণ হয়ে ওঠছে। সত্য ঘটনার প্রকাশ বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় শক্তিমান শাসকশক্তির বিরুদ্ধে যায়।
আর কোন সংবাদ শক্তিমানের বিরুদ্ধে গেলেই সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে অত্যন্ত নগ্নভাবে, আইনকে পাশ কাটিয়ে কল্পিত আইনের মাধ্যমে। ছায়াশক্তি মূর্তশক্তি হিসেবে পেশির জোরে কোন অদৃশ্য কারণে নীতি বলে বিবেচিত হচ্ছে। শাসকের শোষণ, অত্যাচার ঠিক রাখার কৌশল আইন বলে বিবেচিত। কাগজে-কলমে বহুদলীয় গণতন্ত্র মুদ্রণ রেখে বাস্তবে একদলের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার করার পদ্ধতি গণতন্ত্রের আধুনিক সংস্করণ। যার ফলে সত্য প্রকাশকেরা কোনঠাসা হতে বাধ্য হচ্ছে।
স¤প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটা ঘটনা এ পেশার বিকাশের ক্ষেত্রে অশনি সংকেত। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার আইনের কারণে হারাতে বসেছে সাধারণ মানুষ।
গত ৩ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ একটি কলাম লেখেন। তাঁর বিষয়বস্তু ছিল দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমুহের দুর্নীতির নানা দিক নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা। ঘটনা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও উপাচার্যের নিয়োগসহ নতুন উপাচার্যের হাতে ঘটে যাওয়া কয়েকটা অসাংবিধানিক কর্মকান্ডের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।
এর সাথে রাষ্টযন্ত্র ও দলীয় প্রভাব কিভাবে সরাসরি জড়িত তার একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এমনকি শিক্ষা দেয়ার জন্য যে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় সেখানেও শিক্ষাকে মানদণ্ড না ধরে রাজনীতিকে মানদণ্ড ধরা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা মূল্যায়নের সঠিক পদ্ধতি না থাকার কারণে অযোগ্যরা খুব সহজেই নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছে পেছনের কোন শক্তির ইশারায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি পদে যারা থাকেন তারা সবাই পরীক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী।
রাষ্ট্র তাদের পক্ষে, সুতরাং তাদের শক্তি থাকে অনেক বেশি। কেননা আইন তৈরি হয় দলীয় কর্মীদের ভোটে, নিজেদের পিঠ বাঁচিয়ে। প্রশাসনের কোন দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে একযোগে সকলের গায়ে লাগে। তাই সবাই তৎপর হয়ে ওঠে। আনোয়ারুল্লাহর কলাম প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে তটস্থ হয়ে পড়ে প্রশাসন।
সঙ্গে সঙ্গে নানা উপায় অবলম্বন করে প্রতিবাদ ছাপানোও হয়। নিয়মানুযায়ি প্রতবাদ ছাপালেই অসঙ্গতি নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা প্রশাসনের মনোঃপুত হয় না। প্রশাসন মাঠে নামায় ক্ষমতার দাপট। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩/৪ ধারার শর্তগুলো লঙ্ঘন করে, শিক্ষকদের মত প্রকাশের সাংবিধানিক স্বীকৃতিকে উপেক্ষা করে আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ করতে চাই ওই শিক্ষককে।
কোন আইনের ধার না ধেরে চাকুরী বিধির কর্মচারী দক্ষতা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয় প্রশাসন।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে গলাটিপে ধরার প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটিই প্রথম ঘটনা। একজন শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে শায়েস্তা করার জন্য আশ্রয় নেয়া প্রশাসনের শক্তি ও ক্ষমতাকে। ১৯৭৩/৪৪ ধারাকে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মত প্রকাশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে চাকরি বিধি কর্মচারী দক্ষতা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে দুটি ধারা কি পরস্পর সাংঘার্ষিক? যদি সাংঘর্ষিক হয় তাহলে তা দ্রুত সমাধান করা উচিত। তবে একটা কথা পরিষ্কার পত্রিকায় কলামের মাধ্যমে মত প্রকাশ করা কখনই দক্ষতা ও শৃঙ্খলা আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। বা যুক্তিযুক্ত নয়।
আরেকটি বিষয় সামনে আসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাংবাদিকের বহিষ্কারের ঘটনা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৈনিক জলালাবাদ নামক স্থানীয় একটি দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিকে বহিষ্কার করেছে সেখানাকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তার অপরাধ ছিল সে একজন প্রভাবশালী শিক্ষকের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে দিয়েছে। যারা দুর্নীতি করে তাদের কোন শাস্তি হয় না, যারা রুখতে চেষ্টা করে তাদের জীবনে নেমে আসে নানা বাধা-বিপত্তি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমে বলেছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকের কোন প্রয়োজন নেই। তিনি সেই প্রয়োজন না থাকাটাকেই মুখ্য ধরে তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। একজন উপাচার্যের সাংাদিকের প্রয়োজন তখন পড়বে যখন তিনি কোন কল্যাণমূলক কাজ করবেন।
আর দলীয় কোটায় নিয়োগ পেয়ে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সাংবাদিক বাধাই বটে।
রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়ে স¤প্রতি দুই সাংবাদিককে প্রক্টর তার অফিসে ডেকে নিয়ে লাঞ্চিত করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্যরত সাংবাদিকরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে হুমকী পাওয়ার পর তারা নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে সাংবাদিকদের সত্য প্রকাশ করার সদিচ্ছাই দায়ি। যদি কোন সাংবাদিক অনিয়ম, দুর্নীতি দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন প্রশাসনের কাছে সেই যোগ্য সাংবাদিক বলে বিবেচিত।
আর বাকিরা ‘ইয়োলো জার্নালিস্ট’।
সরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকরা স্বাধীন মনোভাব নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে পারছে না। একজন সাংবাদিক খুব সহজেই তার নিজ বিভাগের কোন দুর্নীতির খবর প্রকাশ সাহস দেখাতে পারেন না। কারণ বিভাগের হাতে অ্যাক্টের মাধ্যমে এমন ক্ষমতা দেয়া আছে যে এক শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন কৌশলে মেধাশূন্য করে দেয়ার আইনগত অধিকার রয়েছে। যার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কারো কাছে সামন্যতম জবাবদিহিতা পর্যন্ত করা প্রয়োজন হবে না।
আর ক্যাম্পাসে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে কোন সংবাদ পত্রিকায় ছাপানো হলে সংবাদদাতার নিস্তার নেই। বলে রাখা ভালো আমাদের দেশের রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট বুদ্ধির সাথে সজ্ঞানে মিথ্যার চর্চা। ছাত্ররাজনীতিতেও মিথ্যার চর্চা মারাত্মক। কাউকে মেরে হল থেকে বের করে দেয়ার পরও তারা অবলীলায় বলে, না - কাউকে মারা হয়নি। আবার যদি একান্ত গোপন করা সম্ভব না হয় তাহলে বলা হয়ে থাকে, সে বিরধি গ্র“পের কর্মী, নানা অপতৎপরতার সাথে জড়িত।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সাজানো মিথ্যার ঝুড়ি, আর নিজেদের সাধু সন্ন্যাসী দাবি করে ওই সাংবাদিককে নানা ভাবে হুমকি দেয়ার চেষ্টা করেন ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব! আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অফিসিয়ালি ব্যবস্থা না নিলে ফোনে রাগ মেটানো থেকে বিরত থাকতে পারে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোন ধরণের নিয়োগে দুর্নীতি হয় না এমনটা চিন্তা করা এখন পাগলামি। কিন্তু দুর্নীতির খবর প্রকাশ করলে এমন আচরণ করা হয় যেন সংবাদদাতা কিছুইু জানেন না। সে বোকামি করে সংবাদটি পরিবেশন করেছে। দুর্নীতি বড় পর্যায়ের হলে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো শক্ত হয়।
শোকজ, বহিস্কারের ও দেখা নেয়ার হুমকী থাকে নিত্যদিনের সঙ্গী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।