লিখতে পারি না, তাই চুপচাপ থাকি অনেক বছর আগের কথা, সে সময় ফুটবল খেলার বিশাল জয়জয়কার। মোহামেডান-আবাহনী খেলা হলে ঢাকা স্টেডিয়ামে লোকজন ভেঙে পড়ে, সারা শহরে পতাকা ওড়ে আর পাড়ায় পাড়ায় যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে যায় দু'দলের সমর্থকদের মাঝে। আমার বাবা তখন তরুণ, নতুন এসেছেন ঢাকায়, খেলার বেশ ভক্ত। শখ হলো একদিন স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাবেন, মোহামেডান-আবাহনীর। যথাসময়ে যাওয়া হলো, বাবা নতুন লোক, আগে-পিছে বেশি না দেখেই একটা গ্যালারিতে ঢুকে বসে গেলেন।
চরম উত্তেজনাপূর্ণ খেলা হচ্ছে, মাঝপথে মোহামেডান গোল করে বসলো। মোহামেডানের কড়া সমর্থক আমার বাবা গো-ও-ল বলে লাফিয়ে উঠলেন, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, কোথাও একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, তাঁর আশপাশের কেউ লাফাচ্ছে না, হইহল্লা হচ্ছে উল্টোপাশের গ্যালারিতে, এদিকের গ্যালারি নীরব। ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন, আশপাশের লোকজন সব তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, খুনে দৃষ্টিতেই বলা যায়। নীরবতা ভেঙে একজন হঠাৎ বলে উঠলো, ধর শালারে! সাথে সাথে ব্যাপক হল্লা, বাবা এখনো মাঝে মাঝে বলেন, খুব কপালজোর যে সেদিন লোকজনের কাছে অনুনয়-বিনয় করে, এবং বাকি খেলা না দেখেই কোনমতে বের হয়ে এসেছিলেন।
তার অনেক বছর পরের কথা।
পাকিস্তান দল বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে এসেছে। ততদিনে ফুটবল মোটামুটি বিদায় নিয়েছে, বাংলাদেশ টেস্ট খেলুড়ে দেশ, প্রায় সব বিদেশী দল খেলতে আসে ঢাকাতে, তাদের দেখতে হোটেলে আর স্টেডিয়ামে ভিড় জমায় রং-বেরঙের তরুণ-তরুণীরা, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে, অটোগ্রাফ নেয়। পাকিস্তানী আর ভারতীয় ক্রিকেটাররা আবার হটকেক, তরুণীদের হার্টথ্রব একেকজন, বেচারা বাংলাদেশীগুলো বেশি খেলতে পারে না, তারচেয়েও খারাপ কথা হলো, কালাকোলা ছোটখাটো বাঙালি দেখলে আবার বঙ্গললনাদের মন ভরে না, কাজেই তারা এই খাতায় ব্রাত্য। খেলা হচ্ছে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান, হঠাৎ-ই টিভি পর্দায় ভেসে উঠলো, সুদর্শনা এক বঙ্গললনা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে--"আফ্রিদি, ম্যারি মি। " পুরো দেশে হইচই পড়ে গেল, পরদিন পত্রিকায় বিশাল শিরোনাম হলো, দেশপ্রেমিকরা গরম গরম বিবৃতি দিলেন আর বিশ্বপ্রেমিকরা "প্রেম মানে না বাধা" জাতীয় বচন ঝাড়লেন, তবে বিশ্ব মিডিয়াতে বেশ একচোট রঙ্গরসিকতা হলো।
আফ্রিদির পৌরুষ যে পাকমুলুক ছাড়িয়ে সুদূর বাঙ্গাল মুলুকেও পৌঁছে গেছে, এই ভেবে সম্ভবত ভুট্টো আর ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা নরক থেকে অট্টহাসি দিলো, আর বাঙালি পুরুষরা সম্ভবত কেউ রঙ ফর্সা করার ক্রিম কিনতে বের হলো আর কেউ কেউ "আমরাও আফ্রিদি হবো" ভেবে পরের খেলাগুলোতে চাঁদতারা পতাকা নিয়ে স্টেডিয়াম দাপিয়ে বেড়ালো। এতটাই দাপালো যে, পরের সফরে পাকি অধিনায়ক ইনজিমাম বলে বসলেন, মনে হচ্ছিলো ঢাকা নয়, করাচীতে খেলছি। শুনে অনেকে খুশিতে আটখানা হয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে বানরলাফ দিলো, আমরা অক্ষমরা মাথা নিচু করলাম, যদিও যাদের কারণে এই অপবাদ, তাদেরকে জুতোপেটা করার মুরোদ আবাহনী-মোহামেডান খেলায় খুনোখুনি করে ফেলা সেই আমাদের হলো না।
তারপর আরো বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, নানা রকম কুকীর্তির কারণে পাকিস্তানের মাটিতে যেমন খেলতে যায়নি, ঢাকার মাটিতেও তাদের পা পড়েনি। বঙ্গসন্তানদের ছ্যাবলামির অবশ্য তাতে কমতি হয়নি, জোয়ান লেড়কা আফ্রিদি নেই তো কি হয়েছে, ভারতেশ্বর শাহরুখ খান তো আছে, এবারে শুধু বঙ্গললনা নয়, বঙ্গযুবকরাও তেড়েফুঁড়ে শাহরুখের সাথে হিন্দি চালিয়ে নিজেদের কীর্তি জাহির করলেন, বঙ্গদেশের মন্ত্রী শাহরুখের পায়ের কাছে বসে নিজের জীবন ধন্য করলেন, বাকিরা হাজার হাজার টাকা দিয়ে টিকেট কিনে কেউ চেহারা দেখে, আর অতি ভাগ্যবান কেউ কেউ কিং খানের সাথে নাচাকুঁদো করে আর আরো ভাগ্যবান ২-১ জন তার গাল চুম্বন করে বা পা ধরে নিজেদের মহীয়ান করলেন, শুধু জাতি হিসেবে আমাদের মাথাটা আরো একটু নিচু করে দিয়ে গেলেন।
তা-ও ভাবলাম, মন্দের ভাল, অন্তত ইয়াহিয়া আর নিয়াজীর বংশধরকে বিয়ে করতে তো দাঁড়িয়ে নেই, পাকিপ্রেম হয়তো এদ্দিনে কমে এসেছে। এরমাঝে দেশে ব্লগের জোয়ার এসেছে, দেশপ্রেমিক বাহিনীর হুংকারে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল কম্পিত, সুযোগ পেয়ে আমরাও পাকিস্তান-হিন্দুস্তান সবার মুণ্ডু চিবিয়ে গরম গরম লেখা ঝেড়ে দিচ্ছি আর ওদিকে "স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার" যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে গেছে, যাকে বলে সব মিলে একটা জমজমাট দেশোদ্ধারের পরিবেশ।
কিন্তু আসলে পরিস্থিতিটা কি? কোথায়, কতদূর এগিয়েছি আমরা? একে অপরকে ভারতের দালাল আর পাকিস্তানের দালাল বলে অনলাইনে গালিগালাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু আসলে লোকজনের পাকিপ্রেম কতটা কমেছে? অনেকদিন পর আবার পাকিস্তান এসেছে বাংলাদেশ সফরে, নিয়মিত খেলা দেখি স্টেডিয়ামে গিয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সফরেও দেখেছি এবং সেবার খেলার আগের দিনও টিকেট পাওয়া যাচ্ছিল, এবার দেখি, খেলার ৩ দিন আগে, টিকেট ছাড়ার দিন দুপুরের মাঝেই টিকেট উধাও। খানিক হাউকাউ করলাম, রাগের মাথায় দাবীও করে বসলাম যে বাঙালির রাজাকারপনা একটুও কমেনি, পরিচিতরা সান্ত্বনা দিল, আরে, বড় দল তো, এইজন্যই এত আগে টিকেট শেষ, ভারত বা শ্রীলঙ্কা হলেও এটাই হতো। তখনকার মত চুপ করে গেলাম, আজ খেলার সময় বাইরে ছিলাম, শুধু স্কোর-ই শুনে গেছি, বাসায় ঢুকতে ঢুকতে দেখি, উইকেট নেই ৭ খানা।
বেশি অবাক হলাম না, নতুন কিছু তো না, কিন্তু হঠাৎ ক্যামেরা গ্যালারির দিকে ঘুরতেই সারাদিনের ফুরফুরে মেজাজটা হঠাৎ করে চূড়ান্তভাবে খারাপ হয়ে গেল। সেই বেশ ক'বছর আগের দৃশ্য, সবুজ-সাদা পোশাক আর চাঁদ-তারা খচিত ক্যাপ মাথায় বঙ্গললনাদের আফ্রিদির ক্যাচ পাকড়ানোতে উল্লাসনৃত্য, আশপাশে আরো কিছু বঙ্গসন্তান দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের জার্সি আর পতাকাসমেত। বিশ্বাস করতে চাইলাম যে এরা পাকিস্তানি, কাজেই ভাল মত দেখলাম (ক্যামেরাম্যান বেশ ভালই সময় দিয়েছিলেন), দেখে বলতে বাধ্য হলাম, এরা পাকিস্তানি হলে আমি এস্কিমো নয়তো রাশান। চুপ করে বসে থাকলাম, খেলার ফলাফল দেখে মনখারাপ বা মেজাজ খারাপ কিছুই হচ্ছিলো না, একটা তেতো, ব্যর্থ অনুভূতি। না, ক্রিকেট খেলায় হারার অনুভূতি নয়, নীতি আর বিশ্বাসের খেলায়, ন্যায় আর অন্যায়ের খেলায় হেরে যাওয়ার অনুভূতি।
ভুট্টো আর ইয়াহিয়া ৪০ বছর আগে জিততে পারেনি, আজ তারা জিতে গেল, সেনাবাহিনী দিয়ে নয়, পাকিস্তানের ক্রিকেটার দিয়েও নয়, আমার-ই দেশের কিছু নির্বোধ নির্লজ্জ কুলাঙ্গারকে দিয়ে।
জানি এরপর সুধীজন কি বলবেন। খেলার মাঝে রাজনীতি টানা ঠিক নয়, কাউকে সমর্থন করা মনের ব্যাপার, আফ্রিদি বা পাকিস্তানের এসব খেলোয়াররা দূরে থাক, তাদের পিতা-পিতামহরাও হয়তো কখনো বাংলাদেশের এই গণহত্যা নিয়ে কিছু জানতো না, আফ্রিদিকে বিয়ে করতে অসুবিধা থাকলে, ব্রিটিশদেরও তো বিয়ে করা উচিত নয়, গ্লোবালাইজেশনের যুগে এভাবে জাতিবিদ্বেষ বা ভেন্দেত্তা নিয়ে পড়ে থাকলে কি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে অনেক তর্কবিতর্ক গালিগালাজ হইহল্লা হয়েছে, অনেক ব্লগ বীর, ব্লগ রাজাকার বের হয়েছে, কিন্তু বাস্তব অবস্থা মোটামুটি যা ছিল তাই রয়ে গেছে। পাকিপ্রেমীরা ছিল, আছে এবং অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বেশ ছানাপোনা নিয়ে এরা বেড়ে উঠবে।
সবচেয়ে ভয়াবহ যেটা মনে হচ্ছে, ব্লগার বা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের পাকবিরোধী বা রাজাকারবিরোধী আন্দোলন অনলাইনেই রয়ে গেছে, বাস্তবক্ষেত্রে সেটার প্রয়োগ দেখানোর মত শক্তিশালী এখনো আমরা হয়ে উঠতে পারিনি। অনলাইনে ছাগল তাড়ানো প্রকল্প মোটামুটি সফল-ই বলা যায়, কিন্তু প্রকাশ্য ময়দানে বা অনলাইনে চুপচাপ থাকলেও পাকিপ্রেমীরা তাদের শেকড় ভুলে যেতে পারেনি এবং সুযোগ পেলেই নানাভাবে তাদের ভালবাসা জানিয়ে যাচ্ছে, যার একটার প্রমাণ পাকিস্তানের ম্যাচে এই দৃশ্য।
কেন? জাতি হিসেবে কেন আমাদের এই হীনমন্যতা? নিজেদের যোগ্যতা, সামর্থ্য নিয়ে কেন আমাদের এত হা-হুতাশ? আমরা ফুটবল খেলতে পারি না বলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে রক্তারক্তি করি, কিন্তু আমেরিকান সামোয়ার মত দল অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩১টা গোল খেয়েও হাল ছাড়ে না, লড়তে লড়তে একসময় তারা প্রতিবেশী একটি দেশকে হারিয়েই দিয়েছে, কে জানে, এই ছোট্ট দ্বীপদেশটা হয়তো আরো দূর যাবে, আর আমরা পিছাতে পিছাতে তাদের কাতারে নেমে যাবো, নিজেদের উপর তো আমাদের এই বিশ্বাসটুকু নেই। কত দেশই তো খেলতে পারে না, আমাদের মত অন্য দেশের জন্য জানপ্রাণ ক'জন দেয়? আমরা হিন্দি ছবি, হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে দিনভর মেতে থাকি, একজন শাহরুখ খানের পায়ের কাছে বসে থাকাকে বিশাল পাওয়া মনে করি, অথচ আমাদের গুণী শিল্পীরা নীরবে আমাদের মাঝ থেকে চলে যান, আমরা ফিরেও তাকাই না। আচ্ছা, ছেড়ে দিলাম, হয়তো আমাদের এমন সুপারস্টার মেগাস্টার নেই, কিন্তু যা আছে তার কদর কে করে? সেদিনও অত্যন্ত শিক্ষিত এক প্রবাসীকে বলতে শুনলাম, এই জাতিকে দিয়ে এক মিলিয়ন বছরেও কিছু হবে না।
বটে? স্বাধীন হয়েছে মাত্র ৪০ বছর, এখনই এতটা ধৈর্য্যহারা? উন্নতি কি শুধু বড় বড় কথা বললে আর অন্যের দিকে তাকিয়ে হা-হুতাশ করলে হবে? কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে, সারাক্ষণ নিজের তালগাছ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে উন্নতিটা হবে কোনদিক দিয়ে?
কিন্তু প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি, আমাদের "ভাই"দের কাছে ফেরা যাক। ভাই মানে যাকে বলে, পাকিস্তানের ভাই। এখানে একটু কূটপ্রশ্ন জাগে, পাকিস্তানীরা কোনদিক দিয়ে আমাদের ভাই হলো? জাতি-বর্ণ-ভাষা-গোষ্ঠী-সংস্কৃতি কোনদিক দিয়েই তো এদের সাথে আমাদের কোন মিল নেই। মুসলমান বলে? সত্যি বলতে কি, অন্তত টিভিতে পাকিস্তানী ছেলেবুড়ো, মেয়েমর্দ যাই দেখি, এদের মাঝে "মুসলমান" এর কোন চিহ্ণ তো কোনদিন দেখলাম না, দিব্যি পশ্চিমা কেতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজে পশ্চিমে যাইনি কোনদিন তবে প্রবাসীদের কাছে শুনেটুনে যা মনে হয়, এক হাতে তসবী আরেক হাতে শরাব চালাতেও এদের কোন জুড়ি নেই। যান ছেড়েই দিলাম, আমাদের সৌদী ভাইরাও ওরকম কেতায় মুসলমান, কিন্তু মুসলিম হয়ে মুসলিমদের কচুকাটা করে ফেলার বিধানটা কোন ধর্মগ্রন্থ থেকে এল? ট্যাঙ্ক আর কামানের মুখে উড়িয়ে দেয়া শহীদের হক কে আদায় করবে ওদের কাছ থেকে? ক্ষমা করবো ওদের, ওদেরকে ভাই ডাকবো? বান্দার হক আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্ষমা করার যে অধিকার আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি, তোমরা কিভাবে দেবে?
পরের যুক্তিটা আরো হাস্যকর, আফ্রিদি কি মানুষ মেরেছে, নাকি তার বাবা মেরেছে? ওর কি দোষ? সে কি কিছু জানতো, নাকি এখনো জানে? মারহাবা, খুবই সুন্দর যুক্তি, তাই তো, ওরা তো মাসুম, কিছুই জানে না।
তবে কথা হলো, অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না, উটের মত বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলেও যেটা সত্যি সেটা বদলে যায় না। অজ্ঞতা কখনো কখনো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, "জানি না" কথাটা বলে জঘন্য সব অপরাধের বৈধতা দিয়ে দেয়া যায় না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেয়া যাক, ২য় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিখ্যাত "ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল"-এর। কুখ্যাত সব নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের সাথে সেখানে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল নাৎসি আমলে বিচারকের কাজ করা বেশ কয়েকজন বিচারক ও আইন বিশেষজ্ঞকে। তারা যুক্তি দেখিয়েছিল, তাদের কাজ আইন প্রণয়ন করা, বা আইন অনুযায়ী বিচার করা, সেটা শাসকগোষ্ঠী কিভাবে কাজে লাগালো, তারা সেটা জানতো না, বা জানার দরকার বোধ করেনি।
বলাই বাহুল্য, তাদের এই যুক্তি ধোপে টেকেনি, কারণ সচেতন ও বিবেকসম্পন্ন মানুষমাত্রেই জানতে হবে কিভাবে তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে, কি করছে তাদের শাসকরা, মুখচোখ বন্ধ করে জানালা এঁটে দিলে সেটা তাদের অপরাধের দায় থেকে মুক্তি দেয় না। একইভাবে জার্মানির জনগণ, যারা হিটলারের সময় জেনে বা না জেনে নাৎসি বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, বা নীরব ভূমিকা পালন করেছিল, যুদ্ধের ফলাফল তাদেরকেও ছেড়ে দেয়নি, মিত্রশক্তি পুরো জার্মানিকেই মোটামুটি লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, এবং ১৯৭০ সালে তদানীন্তন জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট জনসমক্ষে হাঁটু গেড়ে বিশ্ববাসীর কাছে ২য় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বলি, উইলি ব্র্যাণ্ডট কি নাৎসি ছিলেন, কাউকে ধর্ষণ করেছিলেন, খুন করেছিলেন, নাকি তার বাবা করেছিলেন এসব অপরাধ? তাঁর ক্ষমা চাইবার দায়টা কোথায়?
এই দায়টা বোঝাই আমাদের নব্য পাকিস্তানপ্রেমী এবং বিশ্বপ্রেমিকদের জন্য একটা কঠিন ব্যাপার, অথবা হয়তো তারা ইচ্ছা করেই বুঝতে চায় না। এই দায় উপলব্ধির দায়, মানবতার দায়, ভুল স্বীকারের এবং সত্যিকার অর্থেই অতীতকে স্বীকার করে নিয়ে ভবিষ্যত সুসম্পর্ক গড়ার সদিচ্ছার দায়, যে দায় পাকিস্তানের শাসকদের কখনোই ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও হবে, এমন কোন সম্ভাবনাও দেখি না। মুখে যতই ভাই-ভাই করুক, পাকিস্তানের কোন শাসক বা রাজনীতিবিদই কখনোই মুখ ফুটে সরাসরি ক্ষমা চায়নি, ইনিয়ে-বিনিয়ে মাঝে মাঝে ভুল হয়েছিল ধরণের দায়সারা কথা বলে শুধু পরামর্শ দিয়ে গেছে অতীতকে ভুলে যাবার।
কিন্তু কোথাও এই অতীতকে কেউ ভুলে যায় নি, যায়নি বলেই উইলি ব্র্যান্ডট হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চান, যায়নি বলেই ১৯৭২ সালে জাপানি প্রধানমন্ত্রী কাকুওয়েই তানাকা সফরকারী চীনা প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর কাছে ক্ষমা চেয়ে অতীতের সব অত্যাচারের দায় স্বীকার করে নেন, ভুলে যাওয়া যায় না বলেই জাপানি সম্রাট হিরোহিতো ১৯৮৪ সালে কোরিয়ান প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চান, এবং ১৯৮৫ সালে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী ইয়াসুহিরো নাকাসুনি খোদ জাতিসংঘে ২য় বিশ্বযু্দ্ধে জাপানের ভূমিকার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপান নিজেও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের হোতাদের একজন হিসেবে তাদের নাম ইতিহাস ভুলে যায়নি বলেই জাপানি প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি ২য় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের সমাধি পরিদর্শনে গেলে জাপানেও নিন্দার ঝড় ওঠে, চাপের মুখে তাকে সরে আসতে হয় নিজের অবস্থান থেকে।
[এই লিংকে গেলে এমন আরো কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে, এখানে তালিকা লম্বা করতে চাইছি না।
Click This Link ]
এবার দেখা যাক, আমাদের পাকিস্তানি "ভাই"রা কি করেছে। ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা বিবেচনা করলে, পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি খুব বড় মাপের নয়,এমনকি তাদের ৯৩ হাজার সৈন্যকেও তারা জীবিত ফেরত নিয়ে গেছে।
তাদের কোন সামরিক কর্তা বা রাজনীতিবিদকেই তারা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় নি, এবং সদাসর্বদা চেষ্টা করে গেছে মার্কিন ও মধ্যপ্রাচ্যিয় প্রভাব খাটিয়ে ১৯৭১ এর সব ঘটনা ধামাচাপা দিতে, বা অন্যখাতে প্রবাহিত করতে। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভালো যে পাকিস্তানের কিছু শর্ত না মানা পর্যন্ত সৌদি আরব এবং ওআইসি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, নানা সময়ে এই রাষ্ট্রটি চেষ্টা করে গেছে ১৯৭১-এ পরাজিত এদেশীয় শক্তিকে সাহায্য দিয়ে এবং সমর্থন দিয়ে এখানে অস্থিতিশীলতা তৈরিতে। পাকিস্তানের কোন পাঠ্যবইতে, কোন জায়গাতে, কোন ইতিহাসে, কখনো ১৯৭১ বিষয়ে এক বিন্দু সত্য কথা উচ্চারণ করা হয়নি। জার্মানি বা জাপানের মত পাকিস্তানি বর্বররা কোন রকম অনুশোচনায় ভোগেনি ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যার জন্য, বরং বারবারই চেষ্টা করেছে এই গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা কমিয়ে একে স্রেফ যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি হিসেবে দেখাতে।
বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলোর মত তারা নির্মম সত্যকে বিশ্ববাসীর সামনে স্বীকার করে তো নেয়-ই নি, নিজের দেশের জনগণকেও সম্পূর্ণ অন্ধকারেই রেখেছে, এবং পাকিস্তানী জনগণেরও সত্য জানার কোন আগ্রহ আছে, এমনটাও কখনো মনে হয়নি। ভিয়েতনাম বা ইরাক যু্দ্ধের সময় "নাসারা" আমেরিকা আর ব্রিটেনের রাস্তায় রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের শাসকদের এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছে, বিক্ষোভ করেছে, জেলে গেছে, বিশ্ববিবেকের সামনে তুলে ধরেছে তাদের শাসকদের কদর্য চেহারা, বুঝাতে চেয়েছে ক্ষমতালোভী কুৎসিত ঐ মানুষগুলো আর তারা এক নয়, কিন্তু পাকিস্তানে? ১৯৭১ সালে গুটিকয় বুদ্ধিজীবির ক্ষীণ কণ্ঠ ছাড়া এই ৪০ বছরে কতবার, কতজন পাকিস্তানী সরাসরি তাদের শাসকদের গণহত্যার দায় স্বকণ্ঠে সর্বসমক্ষে স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে?
করেনি, করবে বলেও মনে হয় না। মুখে মধু রাখলেও পরাজয়ের জ্বালা এদের জুড়ায়নি, এমনকি আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়েও সে আগুন নেভেনি। এজন্যই টিক্কা খান আর নিয়াজী সসম্মানে জীবন কাটিয়ে গেছে, বিচার হয়নি ইয়াহিয়ার, রাও ফরমান আলীর। জার্মানি আর জাপান তাদের অতীতের দায় স্বীকার করে সসম্মানে বিশ্ব মানচিত্রে দাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু অভিশপ্ত পাকিস্তানিরা তাদের অতীতের দায় টেনে টেনে এখন ধ্বংসের মুখোমুখি।
আর আমরা? আমরা এখনো একীভূত পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখি, আমাদের একদল রাজনীতিবিদ এখনো নরহত্যার পরিকল্পনাকারীদের কোলে নিয়ে বসে থাকেন, আরেকদল তাদের বিচারের মুলো ঝুলিয়ে ভোটের রাজনীতি করেন, আর আমাদের তরুণীরা এখনো মেহেরজান হবার গোলাপী স্বপ্নে বিভোর থাকে, তরুণরা আফ্রিদি হবার আশায় চাঁদ-তারা পতাকা নিয়ে উল্লাস করে। নিজের পিতা-মাতা-ভাইয়ের হত্যাকারী আর বোনের ধর্ষকের সন্তান সামনে এসে দাঁড়ালে এই বিশ্বপ্রেমিক উদার প্রজন্ম তাদের ভাই বলে জড়িয়ে ধরে, প্রেমিকা হিসেবে তাকে চুম্বন করতে চায়, আমাদের "স্মার্ট" ক্রিকেটার দাঁড়ি রেখে আফ্রিদি নয়তো শোয়েব আখতার হতে চায়, তাকে পাকিস্তানিদের মত দেখায় দেখে গর্ব বোধ করে, আর আমরা, মুখে বিশ্ব উল্টে দেয়া বাঙালি, মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে খুনোখুনি কোরে ফেলা বাঙালি, এক টুকরো রুটি চুরির জন্য ১০ বছরের শিশুকে পিটিয়ে নয়তো খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা বাঙালি, নিজের চোখের সামনে এইসব বেজন্মাদের উল্লাস আর পাকি-পতাকার সাথে ব্যভিচার দেখে উদাস মুখে আকাশে তাকিয়ে ক্ষমার দর্শন খুঁজি।
কাদের সি্দ্দিকী নামের লোকটাকে তার ইদানিংকার কাজকর্মের জন্য বিশেষ ভাল পাই না। একসময় মুক্তিযু্দ্ধে পাকবাহিনীর আতঙ্ক হয়ে ওঠা এই ভদ্রলোক পরবর্তীতে ডাকাতি-চাঁদাবাজি-টেণ্ডারবাজি ইত্যাদি নানা কারণে তাঁর আগের অবস্থান অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু একটা কারণে এখনো এঁকে আজীবন শ্রদ্ধা করে যাবো, যেতে হবে।
একমাত্র বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী-ই রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল নিয়াজীর সাথে হাত মেলাতে অস্বীকার করেছিলেন তাকে "নারী ও শিশু হত্যাকারী" বলে, আর কাদেরীয়া বাহিনীর কাছে "রাজাকার" নামক জন্তুটার কোন ক্ষমা ছিল না, ধরা পড়ার সাথে সাথে বিনা বিচারে গুলি করে দেয়া হতো রাজাকারদের। ইতিহাসের শিক্ষা কাদেরীয়া বাহিনী যেভাবে নিয়েছিল, সেটা নিয়ে ৪০ বছর আগেই যদি সব রাজাকার মেরে সাফ করে দেয়া হতো, ৪০ বছর পরে এই স্বাধীন দেশের রাজধানীতে বসে গণহত্যাকারী একটা দেশের পতাকা নিয়ে ভাইয়ের রক্তে উল্লাস করার সাহস এই বেজন্মাদের হতো না, আর তাই দেখে চুপ করে বসে থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্তের সাথে আমরা বেঈমানি করতে পারতাম না।
আমাদের কি দুর্ভাগ্য, আমরা কেবলই ভুলে যাই, ইতিহাস শত্রুকেও ক্ষমা করে, বিশ্বাসঘাতককে কখনোই ক্ষমা করে না।
কৃতজ্ঞতা- Farhan Daud(ফেসবুক) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।