দেখে এলাম থান্ডার ড্রাগনের দেশ-১
গরমে অস্থির ঢাকাবাসী আর একই সময়ে ঢাকা থেকে মাত্র ৫৭৫ কিলোমিটার দূরত্বে থিম্পুতে এই বসন্তেও তাপমাত্রা ৫-৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। হঠাৎ শীতে আমাদের বেশ কাবু করে ফেলেছে। ওয়াংচুক রিসোর্টের রুমের হিটারেও শীত মানতে চায় না। আর রিসোর্টের বাইরে তো ডিপ ফ্রিজ। এখানে শৈত প্রবাহ নেই কিন্তু শীত আছে।
এই শীতের ভোরেই সকালে নাস্তা শেষে পারু শহরে যাবার জন্য ট্যুরিস্ট কোস্টারে উঠে বসলাম। বিদায় থিম্পু। থিম্পু থেকে বিদায় বেলায় থিম্পু সম্পর্কে মজার একটি তথ্য দিয়ে রাখি-থিম্পুই পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী শহর যেখানে কোন ট্রাফিক সিস্টেম নেই। গাড়ী চালকেরা নিজেরায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেন। অল্পভাষী ভুটানিরা শব্দদূষণ তো দূরে এরা কোন শব্দই করে না।
আশ্চর্য্য হলেই সত্য, এই কয়েকদিনে গাড়ীর কোন হর্ণের শব্দও শুনতে হয়নি। শুধু গাড়ীর বাতির সিগন্যাল অনুসরণ করেও যে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা যায় এই ভুটানে এসে প্রথম জানলাম। ট্রাফিক মেনে চলার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম এরা অনুসরণ করে। ভুটানের রাস্তায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় প্রাইভেট কার, তারপর কোস্টার এবং সবশেষে ট্রাক। ওভারটেকিং-এর কোন ভাবনায় এদের মাথায় নেই।
কী সুন্দর ট্রাকগুলো আমাদের যাবার রাস্তা করে দেয়! পিছনে কোন প্রাইভেট কারের সিগন্যাল বাতি জ্বলতে দেখলে আমাদের কোস্টারও দেখি তার জন্য রাস্তা ছেড়ে দেয়। এভাবেই থিম্পু থেকে পারু যাবার পথে পারু বিমানবন্দরের ঠিক আগে ভুটানের রাজা মশায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল! আমাদের কোস্টার হঠাৎ রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে গেল আর সাত-আটটি গাড়ী বহর আমাদের কোস্টারকে অতিক্রম করলো। আমাদের মন্ত্রীমহাশয়রা কোন রাস্তা দিয়ে গেলে তাদের আগমনের আধাঘন্টা আগেই রাস্তা ব্লক হয়ে যায়। আর আমাদের ড্রাইভার যদি না বলতো তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না এইমাত্র স্বয়ং ভুটানের রাজামহাশয় আমদের পাশ দিয়ে চলে গেল। রাজা মহাশয় যাবেন আর প্যা পু প্যা পু শব্দ হবে না তা হয় নাকি।
কী জানি বাবা! ভুটানদেশে দেখি নিয়ম-কানুন সব ভিন্ন।
[পারু বিমানবন্দর]
ভুটানের একমাত্র বিমানবন্দর থিম্পু থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে পারু শহরে। দূর পাহাড়ের উপর থেকে পারু বিমানবন্দরটা দেখতে একদম খেলনা বিমানবন্দর মনে হয়। দুই পাহাড়ের মাঝে পারু নদীর তীরে একটা মাত্র রানওয়ের খুবই ছোট্ট স্বপ্নের মতো সুন্দর বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দর থেকে আরেকটু সামনে পারু মূল শহর।
অনেক পুরানো শহর। রাস্তার দুই পাশে কাঠের তৈরি বর্ণিল চিত্রাঙ্কিত সম্বলিত দোকান আর রেস্টুরেন্ট, ঐতিহ্যমন্ডিত বাড়ী আর সবুজ দিগন্ত মাঠ নিয়েই পারু শহর।
পাহাড়ঘেরা রাজ্যে পারু শহরেই যা কিছু সবুজ ফসলের মাঠের দেখা মিলল। প্রকৃতি যেমন এই ভুটানদেশে অকৃপণভাবে তার সৌন্দর্য্য মেলে ধরেছে তেমনি এইদেশের অধিবাসীরাও সেই প্রকৃতিকে ভালোবেসেছে। নিজেরায় যে যার বাড়ীর সামনে রাস্তার দুইপাশে বৃক্ষের সারিগুলো শোভাবর্ধনে উদ্যোগ নিয়ে রাস্তার দুইপাশে বৃক্ষসারিতে সাজিয়ে রেখেছে।
প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই গোলাপী, সাদা ফুলের সমাহার। পুনাখার তুলনায় পারু শহরের দুইপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর। পুনাখার পাহাড়ের চড়াই উৎড়াই পথের তুলনায় পারুর পথ অনেকটায় সমতলে। রাস্তার দুই পাশে ফসলের মাঠ, মাঠের বুক চিরে বহমান নদী, সমতলভূমি ধীর ধীরে রুপান্তরিত হয়েছে পাহাড়ে, পাহাড়ের উপর স্বচ্ছ নীল আকাশ।
এই পারু শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে যেখান পৃথিবী এসে থেমে গেছে সেখানে আমাদের ট্যুরিস্ট কোস্টারও থেমে যায়।
সামনে আর রাস্তা নেই শুধু সুউচ্চ পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় পরিত্যক্ত ড্রুকওয়াল জং। ড্রুকওয়াল জং আদতে একটি দূর্গ। হলিউড সিনেমায় রাজাদের যেমন দূর্গ দেখা যায় ঠিক তেমনটি দেখতে এই ড্রুকওয়াল জং। ১৭শ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতীয়ানদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এই দূর্গ নির্মিত হয়।
পরবর্তী সময়ে এই জং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রম হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এখন এটি শুধুই পর্যটন কেন্দ্র। নির্জন প্রায় জনমানবহীন এই জং এর ভিতর হাটতে হাটতে ভাবতে থাকি কেমন ছিল সেই তিনশ বছর আগের জং-এর চিত্র। রাজা, উজির, নাজির, সিপাহী, সৈন্য-সামন্তে পরিবেষ্টিত এই ড্রুকওয়াল জংই ছিল তখন ভুটানিদের রক্ষাকবচ।
ড্রুকওয়াল জং থেকে ফুয়েনশিলং।
ফুয়েনশিলং এরপরে জয়গাঁ আর তারপরেই শিলিগুড়ি পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত। ড্রুকওয়াল জং হয়ে আমরা ফিরে আসি ফুয়েনশিলং-এ। ভুটানের দর্শনীয় স্থানের তুলনায় পাহাড়ী রাস্তার সৌন্দর্য্য কোন অংশে কম নয়। সম্পূর্ণ দেশটায় তো পাহাড়ের উপর। কত বৈচিত্রময় পাহাড়।
সবুজ পাহাড়, কালো পাথরের পাহাড়, সাদা পাথরের পাহাড়, ন্যাড়া পাহাড়, খাড়া পাহাড়। পাহাড় দেখতে দেখতে ক্লান্ত মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে যখন হঠাৎ পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ঝরণা ধারা বয়ে যেতে দেখা যায়, দেখা মেলে স্রোতসিনী পাহাড়ী নদী, পাহাড়ের গায়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা নাম না জানা নীল আর হলুদ ফুলের ঝোপ, ঐ দূরে পাহাড়ের টিলায় গড়ে ওঠা জনপদ।
অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষদের জন্য ভুটান হতে পারে আদর্শ। সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা, রাস্তার একপাশে পাহাড়ী খাদ। একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ী কয়েক হাজার ফুট নিচে অতল গহ্বরে।
পদে পদে রোমাঞ্চ আর মৃত্যুর হাতছানি। ভুটানে ভয়ংকর সৌন্দর্য্যের মুখোমুখি হয় পারু থেকে ফুয়েনশিলং-এ ফিরে আসার সময়। আমাদের ভুটান ভ্রমণের শেষদিনে। ভুটানের পাহাড়ী রাস্তা এমনিতেই যথেষ্ট দুর্গম। এই দুর্গম পথে রাত্রে গাড়ী চালানোর প্রশ্নই ওঠে না।
আর রাত্রে হঠাৎ পাহাড়ের ঘুর্ণি বাতাসে আক্রমনে পড়লেই হলো। সারাজীবনের জন্যই ছবি হয়ে থাকা লাগবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যবসত বিশেষ কারণে আমাদের ফুয়েনশিলং-এ পৌছানোর আগেই পাহাড়ের চারিধারে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। এই অন্ধকার ফুড়ে আমাদের কোস্টার রুপকথার মঞ্চে আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যায়। আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ চোখ থমকে দাড়ায় যেখান রহস্যময়ী রুপালী চাঁদ পাহাড়ে লুকোচুরি খেলে।
চাঁদ তো কতই দেখলাম। কিন্তু চাঁদের এতো কাছাকাছি কখনোও যাওয়া হয়নি। আমদের কোস্টার তখনও ভুপৃষ্ট থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উপরে। আরেকটু উপরে উঠলে হয়তো হাত বাড়ালেই চাঁদের বুড়িকে ছুঁয়ে ফেলা যেত। এত বড় চাঁদ, চাঁদের এতো কাছাকাছি এ জীবনে আর কখনই আসা হয়নি।
কে জনতো শেষমেষ সেই চির পুরানো চাঁদ তার রহস্যভেদী সৌন্দর্য্য এই ভুটান দেশে এসে আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করবে !
ফুয়েনশিলং-এ রাত দশটা। শহরটা তখন ঘুমে ঢুলু ঢুলু। এখানে রাত দশটা মানেই অনেক রাত। রাত দশটায় নাইট ক্লাবগুলো বাদে সব দোকানপাটই বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় নির্জন ফুয়েনশিলং-এর রাস্তায় হাটতে হাটতে শহরটা ঘুরে দেখি।
থিম্পু, পারু শহরের তুলনায় ফুয়েনশিলং-এ দর্শনীয় কোন স্থান নেই। দর্শনীয় বলতে শহরের মাঝে বৌদ্ধ মঠ, পার্ক আর ভুটানের প্রবেশদ্বার। যথারীতি এখানকার সব স্থাপনায় ড্রাগন, ড্রুক আর আধ্মাতিক চিহ্নের সংকলনে শৈল্পিক ছোঁয়া। একটিমাত্র লোহার গ্রিলে ভুটান আর ভারতের সীমান্ত পার্থক্য করা হয়েছে। শুধু লোহার গ্রিলের দুইপাশের মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরণের পার্থক্য এনেছে।
ওপারের ভারতের তুলনায় গ্রিলের এপাশের ভুটান শহর ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শান্ত-স্নিগ্ধ। পরেরদিন দুপুর পর্যন্ত ফুয়েনশিলং-এর ছোট্ট শপিং মলগুলোতে ঘুরে বেড়ালাম। ভারতের সীমান্তের কাছে হওয়ায় ফুয়েনশিলং-এ শপিংমলগুলোতে ভারতীয় পণ্যে ঠাসা। ইচ্ছা করলে জয়গাঁয় যেয়েও কেনাকাটা করা যায়। ভারত-ভুটান সীমান্তে কোন দ্বাররক্ষী নেই যে আপনার দুইদেশের সীমান্ত অতিক্রমের পথ আগলে দাড়াবে।
ভুটানের ভিতর শুধু ফুয়েনশিলং-ই ব্যতিক্রম। ফুয়েনশিলং এর পর ভুটান রাজ্যে যতো শহরেই আপনি যাবেন প্রতিটি শহরের প্রবেশদ্বারে শহরে প্রবেশকারীদের নাম, ঠিকানা লিখে রাখবে। ছোট দেশে আদমশুমারির সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। ডাটাবেজ দেখে সহজেই বলে দেয়া যায় ভুটানের কোন শহরে এই মুহুর্তে কত লোকের বাস? কত জন ভিনদেশী?
[শিলিগুড়ি চা বাগান]
ফুয়েনশিলং থেকে জয়গাঁ ইমিগ্রেশন, তারপরে জীপে আড়াই ঘন্টায় শিলিগুড়ি পেরিয়ে ভারতের চ্যাংরাবান্দা বর্ডার। বর্ডারের আনুষ্ঠানিকতা সেরে যখন বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকলাম তখন সূর্য্য ডুবিডুবি।
বাংলাদেশের সীমান্তে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ীতে চড়ে পরদিন ভোরে ফিরে এলাম সেই পরিচিত ঢাকায়।
স্বল্প খরচে ভুটান ভ্রমণের সবচেয়ে সহজ উপায় ঢাকা-বুড়িমারি-জয়গাঁ-ফুয়েনশিলং। রাত্রে ঢাকা থেকে বাসে উঠলে পরদিন সকালে বুড়িমারি বর্ডার। বর্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতের চ্যাংড়াবান্দা থেকে জীপে জয়গাঁ। জয়গাঁয় আবারো ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভুটানের সীমান্ত ফুয়েনশিলং-এ পৌছাতে পৌছাতে দুপুর।
দিনটা ফুয়েনশিলং-এই কাটিয়ে দিতে পারেন। ঘুরে আসতে পারেন কাছেই কুমিরের খামার অথবা টরশা চু থেকে। পরদিন সকালে থিম্পু শহরে জন্য যাত্রা শুরু। দুপুরে স্থানীয় ফুডপার্কে দুপুরের আহার সেরে নিতে পারেন। ফুয়েনশিলং থেকে থিম্পুর দূরত্ব মাত্র ১৭৬ কিলোমিটার কিন্তু এই পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে থিম্পু শহরে পৌছাতে পৌছাতে বিকাল।
বিকালে সুন্দর শহরটি ঘুরে দেখুন। পরের দিনগুলোতে আপনার সময়সূচি অনুযায়ী পারু অথবা পুনাখা থেকে ঘুরে আবারো ফুয়েনশিলং হয়ে ঢাকায় ফিরে আসতে পারেন। যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত ভুটান দেশে ভ্রমণ হতে পারে জীবনের স্মরণীয় কিছুদিন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।