বিকট
আমাদের এলাকায় যখন প্রথম একটি সুপারশপ গজিয়ে উঠলো তখন বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিলো জনসাধারণের কাছ থেকে। স্বচ্ছলেরা স্বস্তি পেয়েছিলো উন্নত মানের পণ্য কেনার জন্যে দূরে যেতে হবে না বলে। মধ্যবিত্তদের প্রথম পছন্দ কাঁচাবাজার হলেও ঠাঁট বজায় রাখতে মাঝেমধ্যে সুপারশপে যেতো। আর দরিদ্ররা-থাক তাদের কথা। আমি যাই খুব মাঝেসাঝে।
রাত জেগে কাজ করতে হয় বলে ক্ষুধার কথা মাথায় রেখে কিছু শুকনো খাবার;মূলত চিপস কিনি। রাতের বেলা ফ্রিজ থেকে ভাত-তরকারি বের করে গরম করা অনেক ঝামেলার কাজ। আজকে কিছু চিপস আর কোমল পানীয় কিনে বিল দিতে যাবার সময় হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন গুঁতো দিলো ট্রলি দিয়ে। অসাবধানতাবশত হয়েছে ভেবে তেমন পাত্তা দিলাম না। কিন্তু এরপরে আরো জোরে ঠেস দেয়ার পর আমি মাথা গরম করে কিছু বলতে গিয়ে দেখি যে এটা আমার স্কুলজীবনের বন্ধু মুন্নার কাণ্ড।
পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হলে এখন আর ভালো লাগে না। এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি যথাসম্ভব। মুন্নাকে দেখে মেজাজটা খারাপ হল কিছুটা। ট্রলিভর্তি জিনিসপত্র। বোঝাই যাচ্ছে বেশ ভালো রোজগার করে।
-কী রে! ভালো আছিস?
প্রশ্নের মধ্যে প্রশ্নবোধকতা যথাসাধ্য কমিয়ে রাখি, যেন সে বুঝতে পারে আমি কথা বলতে আগ্রহী না। তবে সে যথেষ্ঠ আগ্রহী ছিলো, যতটা না বন্ধুত্বের খাতিরে তার চেয়ে বেশি নিজেকে জাহির করতে। মুখভরা হাসি নিয়ে মেকি হৃদ্যতা দেখানোর পর সে আমার কেনা জিনিসগুলোর বিল দিতে চাইলো। এবার আমি তার প্রতি বন্ধুত্ব অনুভব করি!
-চল কোথাও বসে চা-বিড়ি খাই।
মুন্না বলে।
আমি অমত করি না। ট্রলিটা সুপারশপের দারোয়ানের কাছে গচ্ছিত রেখে আমরা বসি একটা টং দোকানে।
ব্যাপারটা এরকমই হবার কথা, অনেকদিন পর দু বন্ধুর দেখা, অতীত স্মৃতি বিনিময়, চা-সিগারেট টানা। কিন্তু টং এর দোকানে বসে কেটলি থেকে নির্গত ধোঁয়া আর চুলোর আগুন দেখে আমার ভেতর কেমন যেন একটা বিষাক্ত অনুভূতি হয়। মুন্নার সাফল্যকীর্তন, সুখী সংসার আর সন্তানের বর্ণন, এসব শুনতে শুনতে আমি উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত সন্ধ্যার বন্ধ্যারূপ দেখতে পাই।
এখন আমি যা যা করতে পারি তা হল, ঘাড় নাড়িয়ে তার কথা শোনা, তার সাফল্যে উচ্ছসিত হবার ভান করা, অথবা কোন কাজের অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়া। শেষের বিকল্পটাই আমার কাছে এই বিদঘুটে পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম করণীয়, কিন্তু কেটলিটার রাগী ধুম্র উদগীরণ আমাকে কেমন যেন মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। পরিস্থিতি আরো একটু উত্তেজনাপূর্ণ হয় দোকানদার চা দিতে গিয়ে মুন্নার গায়ে ঢেলে দিলে। ওর ফর্সা হাতে কী সুন্দর করে ফোসকা পড়ে গেল নিমিষেই! ভালো লাগলো দেখে। আমি আরো ভালো কিছুর আশায় আগ্রহ নিয়ে নড়েচড়ে বসি এবার! জীবন বড়ই নীরস।
কোথাও রোমাঞ্চ নেই। এইসব ছোটখাটো ঘটনা, এই যে ফোসকা পড়ার পরে মুন্নার কাতরানি, দোকানদারকে গালমন্দ, আশেপাশের মানুষের দুই পক্ষ হয়ে চাপান-ওতর বেশ উপভোগ্য এসব। আমিও মনমরা ভাব ঝেড়ে ফেলি দোকানদারকে এক ধমক দিয়ে।
-ঐ মিয়া ঠিকমত দেইখা কাজ করবা না! হাতে ফোশকা ফালায় দিছো। তাও ভালো কাপড়ে পড়ে নাই।
এত দামী জামা নষ্ট হইতো।
পোষাক এবং দেহ সম্পর্কিত আমার এহেন তুলনায় মুন্নাকে অপ্রতিভ দেখায়। আমি ওর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবারও কেটলিটার দিকে তাকাই। কী ভীষণ ফোঁসফোঁস করছে! কেটলিটাকে আমার খুব বন্ধুসুলভ মনে হয়। মনে হয়, আমিও যদি ওই কেটলিটার মত হতে পারতাম! রাগী এবং উত্তপ্ত! গায়ে চা পড়ার পর থেকে মুন্নার কথা বলার উৎসাহ কমে গেছে অনেকটাই।
চলে যাবে নাকি?
-আজকে উঠি রে! দেরী হয়ে যাচ্ছে।
আমার আশঙ্কাই সত্যি হল। তবে আজকে এত সহজে ওকে ছাড়ছি না। কেটলির ফুটন্ত পানি দিয়ে ওর বিলাসবস্তু ভর্তি ট্রলিটা ভিজিয়ে দেবো। আমি আরো কিছু ফোশকা দেখতে চাই।
একবার দেখলাম ওর শরীরে, আরেকবার দেখতে চাই ওর ট্রলির লাক্সারিয়াস বস্তগুলোতে। আমার অন্তর্গত ঈর্ষাকে আবিস্কার করে আমি আনন্দিত হই। যদিও লজ্জিত হওয়াটাই শ্রেয়তর মানসিকতা হিসেবে বিবেচিত হত, কিন্তু লজ্জা, হীনমন্যতা এসব পুষে রাখলে হেমন্তের এই জমকালো সন্ধ্যায় ঝুপ করে শীত নেমে আসবে শিকারী পাখির মত। আমি ভয় পাই শীত এবং শিকারী। বন্ধুর সাহচর্য আজ আমাকে চাগিয়ে তুলেছে, উষ্ণ করছে।
-এত তাড়াতাড়ি বাসায় যায়া কী করবি? খুব বউপাগল হইছোস, না?
বিদ্রুপ করি ওকে।
-হাহাহা! বিয়ে কর, তারপর বুঝবি। তুই বিয়ে করিস না কেন এখনও?
-তোমার মত জাঁদরেল হয়া নেই তারপর করুম।
আমি একটা টোপ ফেললাম।
-আমার মত জাঁদরেল মানে? আমি কী এমন..
সে টোপ গিললো।
তার বিব্রত হবার অভিনয় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হল। কথায় খুশীর ছাপ কোনভাবেই এড়াতে পারলো না।
-না তুই কতবড় চাকরী করিস, কত টাকা ইনকাম করিস, বেতন পাস টাকায় না, ডলারে। তোরে জাঁদরেল বলব না তো কারে বলব?
তার ম্রিয়মাণ ভাব কেটে যায়। সে আবারও অতি উৎসাহের সাথে তার সাফল্যগাঁথা বয়ান করতে থাকে, তাবলীগের হুজুররা যেমন কাউকে পেলেই ধর্মের মহিমা বয়ান করা শুরু করে।
এখানে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। ওদের কথার বিষয়বস্ত ধর্ম এবং ঈশ্বর, আর এর টাকা এবং স্ত্রী। খুব সহজেই লিংকআপ করা যায় দুটো ব্যাপার। হাহাহা!
-আচ্ছা কয়টা বাজে?
-পৌনে আট।
-সুপারশপগুলা আটটায় বন্ধ হয়ে যায় না?
-হু।
-তাহলে তো এখন উঠতে হয়। ট্রলিটা নিয়ে আসি।
আমি কেটলিটার দিকে তাকালাম। সে প্রস্থান প্রস্তাব অনুমোদন করল।
সুপারশপে গিয়ে আমরা ট্রলি থেকে নামাতে থাকি যাবতীয় নিত্য ব্যবহার্য এবং বিলাসী পণ্য।
সবগুলো সুন্দর করে প্যাক করে দেয় দক্ষ সেলসম্যান। শেষমুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নেই একটা ট্রলি কেনার। সুপারশপে ক্রেতাদের কেনাকাটার সুবিধার্থে সাজিয়ে রাখা ট্রলিগুলো বিক্রীর জন্যে না। তাই আমার অনেক পীড়াপীড়িতেও তারা রাজি হয় না। তবে রাজি কীভাবে করতে হবে আমার জানা আছে।
ওখান থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানটায় গিয়ে ফুটন্ত কেটলিটা ঝুপ করে উঠিয়ে নিয়ে দৌড় দিই। হতচকিত চা বিক্রেতা এবং ক্রেতারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢুকে পড়ি সুপারশপটায়। আমার হাতে ফুটন্ত জল ভরা কেটলি। আমি জানি উত্তপ্ত এই কেটলিটা আমার দেহে কোনরকম প্রদাহের সৃষ্টি করবে না, কিন্তু আশেপাশের মানুষের মধ্যে ঠিকই ভীতি সঞ্চার করবে। এটা ভালো কেটলি।
আমার বন্ধু কেটলি। কেটলির মুখটা সেলসম্যানের সামনে রিভলভারের মত করে ধরি, ওরা ভয় পেয়ে আমাকে একটা ট্রলি দিয়ে দেয়। কেটলিটাকে ট্রলির মধ্যে রেখে মুন্নাকে বলি,
-চল এবার!
-যাবো তো, কিন্তু কেটলি, ট্রলি এসব দিয়ে তুই কী করছিস! বুঝতেছিনা কিছু।
জবাবে আমাকে কিছু বলতে হয় না। কেটলিটা ফোঁস করে ওঠে।
সে চুপসে যায়।
রাতটাকে বেশ ভালো লাগছে এখন। উষ্ণ এবং সুন্দর একটা রাত। সাথে দুই বন্ধু। মিইয়ে যাওয়া স্কুল সহপাঠী আর সদ্য পরিচিত রাগী কেটলি।
-তোকে আজকে বাসায় পৌঁছায়া দিবো।
মুন্নাকে বলি আমি।
-একটা ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া কর।
-তোর নিজের গাড়ি নাই কেন রে?
-যে দুই পয়সা বেতন পাই তা দিয়া গাড়ি কেমনে কিনি! সামনের মাসে অবশ্য প্ল্যান আছে একটা...
ট্রলির ভেতর থেকে কেটলিটা আবারও ফোঁস করে ওঠে। কিছুটা গরম পানি তার গায়ে ছিটকে দেয়।
তার আয়েশী শরীরে আরো কিছু ফোশকা দেখে আমার ভালো লাগে। ফোশকাগুলো বিস্তৃত হয়ে এক অদ্ভুত আকৃতি পেয়েছে। আমাদের দেশের মানচিত্রের মত।
-তোকে আমি একটা গাড়ি গিফট করব। চিন্তা করিস না।
আমার এই অবাস্তব আশ্বাস শুনে ব্যথার মধ্যেও সে হাসে!
-তুই! হাহাহা!
আমি আবারও কেটলিটাকে রিভলভারের মত করে তার মাথার সামনে ধরি,
-ট্রলিটায় ওঠ। এটাই তোর গাড়ি। এটাই আমার গিফট।
-হোয়াট দ্যা ফাক ম্যান!
আমি তার মানচিত্ররূপ ফোশকায় একটু ঘষে দেই কেটলিটার নল দিয়ে।
-ফাইজলামি না, ওঠ!
ট্রলিটায় সে ভালোভাবেই এঁটে যায়।
প্রথমে তার পাশে কেটলিটাকেও রেখেছিলাম, কিন্তু থার্মোডিনামিক্সের সমস্ত সূত্র অগ্রাহ্য করে ওটা সময়ের সাথে সাথে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তাদের সহাবস্থান সম্ভব হলো না আমার বেকুব বন্ধুর চিৎকারে। আমি আলতোভাবে তুলে নেই কেটলিটাকে। কী ভালো একটা কেটলি! উষ্ণ এবং বন্ধুভাবাপন্ন। আমার কাঁধে সে আরাম করে বসে থাকে।
সত্যি, এত ভালো বন্ধু আমি আগে কখনও পাই নি।
-তোর জিনিসপত্র সব ঠিক আছে তো? যা যা কিনেছিলি সুপারশপ থেকে?
-হু!
-এখন তো শালা তোকেই পণ্য পণ্য লাগছে। মনে হচ্ছে সুপারশপ থেকে তোকে কিনে ট্রলিতে করে হাঁটছি। হাহাহা!
-আমি তো আসলেই একটা পণ্য। কর্পোরেট পণ্য।
পরিবারের কাছে পণ্য। আমাকে বিকিয়ে খাচ্ছে সবাই।
-তাহলে বল, তোর জন্যে এই ট্রলিটা উপহার হিসেবে যথার্থ হয়েছে না?
-হ্যাঁ। তুইও বসবি এখানে? জায়গা আছে বেশ।
আমি কোন উত্তর না দিয়ে তার গায়ে কেটলি থেকে গরম পানি ঢালতে থাকি।
ঝলসে দেবো শালাকে! আমাকে পণ্য বানাতে চায়! কিন্তু একইসাথে মনে হয় পণ্য হওয়াটা, নিজেকে বিকিয়ে দেয়াটা খারাপ কিসে! আমার রাগ, ঈর্ষা, বিবমিষা সব উবে যায়। কেটলির পানি ঠান্ডা হয়ে আসে। আমার বন্ধু ঝলসায় না। সে হাসে। তবে কিছুটা গরম পানি আমার শরীরে পড়ে ফোশকা ফেলে দেয়।
আমি দেখি সেই ফোশকাটার আকৃতি অনেকটা আমাদের দেশের মানচিত্রের মতই। আমি কেটলিটা ছুড়ে ফেলে দেই।
সামনে বিশাল ঢালু পথ। আমি ট্রলিতে ঢুকে পড়ি আমার বন্ধুর সাথে। ট্রলিটা উল্কাবেগে চলতে থাকে।
কোথায় গিয়ে থামবে জানি না। তবে বেশ ভালো লাগছে এই গতি। ভালো লাগছে ট্রলির আরামদায়ক আবাসনও! শুধুমাত্র ফোশকা পড়া জায়গাটায় একটু জ্বলছে আর কী! মানচিত্রাকৃতিটাও পছন্দ হচ্ছে না। অবশ্য সব কী আর পছন্দমত হয়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।