আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ট্রলি ঠেলে এক জীবন পার

মাথার ওপর প্রখর রোদ, পায়ের নিচে তপ্ত রেলপথ। দুই হাতে ট্রলির হাতল চেপে দৌড়ে দৌড়ে ঠেলছেন মানুষ দুটি। গা থেকে দরদর করে ঝরছে ঘাম। খানিক পর পর কপালের ঘাম মুছছেন। ক্লান্ত হলে হাতলের ওপরই লাফিয়ে বসছেন।

এভাবে রোদ, বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলপথে ট্রলি ঠেলে চলেন বাচ্চা মিয়া ও জাহাঙ্গীর আলম। প্রথমজনের বয়স ৭০, দ্বিতীয়জনের ৩৫ বছর। দুজনই রেলওয়ের ট্রলিম্যান।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ গ্রামে বাচ্চা মিয়ার বাড়ি। তিন ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ছয় সদস্যের সংসার তাঁর।

বড় ছেলে জামাল মিয়া উচ্চমাধ্যমিক পাস করে গৃহশিক্ষকতা করছেন। দ্বিতীয় ছেলে মো. জালাল গত বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। চাকরি না পাওয়ায় ছেলেকে মুরগির খামার করে দিয়েছেন। ছোট ছেলে সাইফুল ইসলাম কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করছেন। একমাত্র মেয়ে কছিন খাতুনের বিয়ে হয়েছে।

স্ত্রী জাহেদা খাতুন গৃহিণী।
বাচ্চা মিয়া বলেন, ‘১৯৭৮ সালে ট্রলিম্যান হিসেবে চাকরিতে যোগদান করি। যান্ত্রিক যুগেও মানুষ হয়ে মানুষকে ঠেলে নিয়ে বেড়ানোর কাজ করছি। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে পায়ে ফোস্কা পড়েছে। দুই হাঁটুতে ব্যথা ধরেছে।

তবু ৩৫ বছর ধরে এ কাজ করে যাচ্ছি। এক বছর পরই চাকরি থেকে অবসর নেব। কিন্তু ট্রলি চালানোর ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন দেখতে পারলাম না। সেই ব্রিটিশ আমলের নিয়মেই ট্রলি চালাতে হচ্ছে। ’
বাচ্চা মিয়া আরও বলেন, ‘আমার কাজ কষ্টের।

কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। এ যুগেও মুঠোফোন ব্যবহার করি না। কর্ম করে সন্তানদের মানুষ করছি। ওরা ভালো মানুষ হলেই আমার কষ্ট সার্থক হবে। ’
বাংলাদেশ রেলওয়ে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলপথের বোনারপাড়া থেকে কাউনিয়া রেলস্টেশন প্রায় ৭০ কিলোমিটারের পথ।

এই রেলপথ দেখভালের জন্য বামনডাঙ্গা প্রকৌশল বিভাগে একজন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) রয়েছেন। তিনি ট্রলিতে চড়ে রেলপথের ত্রুটি, প্রয়োজনীয় পাথর, স্লিপার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ঠিকঠাক আছে কি না, তা সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। এই ট্রলি চালানোর জন্য ট্রলিম্যান রয়েছেন মাত্র চারজন।
জাহাঙ্গীরের বাড়িও মনমথ গ্রামেই। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।

তিনি ১৯৯৮ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। জাহাঙ্গীর বলেন, রোদের সময় রেলপথ প্রচণ্ড গরম থাকে। গরমে পা পুড়ে যায়। বৃষ্টির দিনে রেলপথ পিচ্ছিল হয়ে পা ফসকে যায়। কিন্তু উপায় নেই।

চাকরির জন্যই এত কষ্ট।
বগুড়ার সান্তাহার এলাকার ট্রলিম্যান শফি মিয়া (৫০) বলেন, ‘সব সময়ই চারজনকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়। কারণ, ট্রেন এলে চারজন ছাড়া ট্রলি নিচে নামানো যায় না। অথচ ট্রলিকে ইঞ্জিনচালিত করলেই আমাদের কষ্ট দূর হতো। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহী, পার্বতীপুর ও ঢাকায় ইঞ্জিনচালিত ট্রলির ব্যবস্থা রয়েছে।

কিন্তু বামনডাঙ্গা প্রকৌশল বিভাগে ইঞ্জিনচালিত ট্রলি দেওয়া হচ্ছে না। ’
তিন মাস আগে ট্রলিম্যান হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছেন আবুল হোসেন। যশোর জেলার খরকি গ্রামে তাঁর বাড়ি। আবুল হোসেন বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর কোনো চাকরি পাইনি। তাই জেনেশুনেই এই চাকরিতে যোগদান করেছি।


রেলওয়ের গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) দীপক কুমার সিংহ বলেন, ‘ট্রলি ঠেলতে শ্রমিকদের কষ্ট হয় জানি। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকে এভাবেই চলছে। এ ছাড়া আর উপায় কী! এই ট্রলিতে করেই রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারকাজের তদারকি করতে হয়। ট্রলিটি ইঞ্জিনচালিত করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ’



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।