আগামী ২৩ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি মুক্তি পাওয়া নিয়ে ফুঁসে উঠছেন চলচ্চিত্রসেবীরা। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আজ বিকাল ৩টায় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (এফডিসি) জরুরি মিটিংয়ে বসছেন তারা। চলচ্চিত্রসেবীদের কয়েকটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত চলচ্চিত্র একতা পরিষদের ব্যানারে ওই বৈঠকে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে জানান সংগঠনটির আহ্বায়ক ও চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। তিনি জানান, কোনো কিছুই আন-চ্যালেঞ্জড ছেড়ে দেয়া হবে না। চলচ্চিত্র শিল্পী-প্রযোজক-পরিচালক সবাই ভারতীয় ছবির আমদানিকে এদেশীয় সংস্কৃতির জন্য আগ্রাসন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘জান দেব, তবুও ভারতীয় ছবি প্রদর্শন করতে দেব না।
এতে কিছু প্রদর্শক লাভবান হলেও গোটা শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বেকার হয়ে পড়বে এ অঙ্গনের হাজার হাজার লোক। ’ তারা সরকারকে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনী বন্ধ করার জন্যও জোর দাবি জানান।
২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে জোর ছবি। পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা সফল এই ছবিতে অভিনয় করেছেন জিত্ ও কোয়েল মল্লিক।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন এ ছবি মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, শুরুতে ১২টি সিনেমা হলে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবে।
স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ থাকে। পাকিস্তান আমলে ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর হিন্দি ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়, তার ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ আমলেও বজায় থাকে। সম্প্রতি উচ্চ আদালত বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের অনুমতি দেয়।
এরপর ৩টি ভারতীয় বাংলা ছবিকে প্রদর্শনের ছাড়পত্র দেয় সেন্সর বোর্ড। জোর ছাড়াও আরও যে দুটি ছবি সেন্সর ছাড়পত্র পায়, তা হচ্ছে বদলা ও সংগ্রাম। চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির সভাপতি বিশিষ্ট নায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা বলেন, আগামীকাল আমাদের বৈঠক রয়েছে। ওই বৈঠকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির সভাপতি হিসেবে আমি বলতে পারি, যে দেশ আমাদের একটি টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের অনুমতি দেয় না, সেখানে সেই দেশের ছবি কীভাবে এদেশে প্রদর্শনের অনুমতি দেয়া হয়? যারা ছবি প্রদর্শন করবে এবং তা দেখবে, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি।
তিনি বলেন, আমরা বাইরের ছবি প্রদর্শনের বিরোধী নই। আমাদের কথা হচ্ছে, এটা হবে পারস্পরিক। তাদের ১০টা ছবি আমাদের দেশে প্রদর্শিত হলে, তাদের দেশেও আমাদের ১০টা ছবি প্রদর্শিত হতে হবে। তাছাড়া ভারতে অন্যূন ১৬টি ভাষায় ছবি নির্মাণ হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি আমাদের দেশে মাত্র হিন্দি কিংবা বাংলা ছবির বাজার সৃষ্টি করবে? তিনি বলেন, যদি ব্যাপারটি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে কোনো কিছুই বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড় দেয়া হবে না।
অভিনেতা, পরিচালক নায়ক রাজ রাজ্জাক বলেন, আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশের সিনেমা হলে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একজন শিল্পী বা অভিনেতা হিসেবে আমি একে সমর্থন করতে পারি না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সরকার চলচ্চিত্রকে উন্নত করার বদলে শিল্পটিকে ধ্বংস করার কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করছে।
অভিনেত্রী, নির্মাতা সুচন্দা এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, ভারতীয় সিনেমা আমাদের দেশের হলগুলোতে প্রদর্শন হলে আমাদের সিনেমা শিল্প একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, চলচ্চিত্রের অবস্থা এমনিতেই খারাপ।
এখন আবার সরকার ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের পাঁয়তারা করছে। আমরা এটি সহজভাবে মেনে নিতে পারছি না। এ শিল্পের সঙ্গে এখনও অনেকে জড়িত। ভারতীয় সিনেমা এলে আমাদের সিনেমা শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন এর সঙ্গে জড়িতরা একেবারে বেকার হয়ে যাবেন।
‘ওরা ১১ জন’-খ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, সমাজ ও রাজনীতিতে যেসব মানুষ দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে, ভারতীয় ছবি প্রদর্শনীর সঙ্গে তারা জড়িত। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে স্বাজাত্যবোধের জন্ম হলো, তা একাত্তরে এসে পরিণতি পেল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করে। দেশীয় ছবি পৃষ্ঠপোষকতা না করে বিদেশি ছবি আমদানির অনুমতি দেয়া হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেল কোথায়, দেশপ্রেম কোথায় থাকল।
তিনি বলেন, এখন যেখানে আমাদের দেশীয় সিনেমা শিল্পের ভিত্তিকে শক্তিশালী করা দরকার, সেখানে ভারতীয় ছবির আমদানি ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। বিদেশি ছবি প্রদর্শন হবে না—এই আশ্বাসেই আমরা আন্দোলন বন্ধ করেছিলাম।
এখন যদি আবার প্রদর্শনের চেষ্টা চলে, তাহলে এর প্রতিবাদ আমরা করবই। সিনেমাসেবীদের কথা আমি জানি, তারা ভারতীয় ছবির আগ্রাসন রুখতে জান দিতেও প্রস্তুত।
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বিশিষ্ট পরিচালক এফআই মানিক বলেন, বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, বাংলাদেশে ছবি মুক্তি দেয়ার একটি নিয়ম আছে। এজন্য চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির রিলিজ কমিটি থেকে অনুমতি নিতে হয়। ভারতের যে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে, আমার জানামতে ওই রিলিজ কমিটি থেকে কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি।
আমি প্রদর্শকদের অনুরোধ জানাই, ছবিটি যেন তারা সিনেমা হলে প্রদর্শন না করে। চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও নায়ক উজ্জ্বল বলেন, ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের অনুমতি দেয়াটা আমাদের দেশীয় সিনেমা শিল্পের জন্য বড় ধরনের ‘হুমকি’ ও ‘ক্ষতি’। এই শিল্পের সঙ্গে লাখ লাখ লোক জড়িত। তারা বেকার হয়ে যাবে। ভারতীয় ছবি আমদানির মাধ্যমে সরকার শেয়ারবাজারের মতো আরেকটি গণবিস্ফোরণের সম্মুখীন হতে পারেন।
তিনি জানান, বাংলাদেশে ছবি মুক্তির একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ছবি নির্মাণ করতে হবে। ওই ছবির প্রযোজককে প্রযোজক সমিতির সদস্য পদ নিতে হয়। ছবি তৈরির পর প্রযোজক সমিতির রিলিজ কমিটিতে নাম তালিকাবদ্ধ করতে হয়। ওই রিলিজ কমিটি অনুমতি দিলেই কেবল ছবি মুক্তি পেতে পারে।
তিনি বলেন, ভারতের যে ছবিটি আগামী ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে, সেই ছবি যে কোম্পানি আমদানি করেছে, সেটি আমাদের প্রযোজক সমিতির সদস্য কিনা জানি না। সদস্য না হওয়ারই কথা। তাহলে ওই ছবির মুক্তিটি পরিগণিত হবে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের নিয়মনীতি-বহির্ভূত কর্মকাণ্ড হিসেবে। এর দায়দায়িত্ব ভারতীয় ছবি মুক্তির সঙ্গে জড়িতদেরই নিতে হবে।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ আহমদ জামান চৌধুরী খোকা বলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের অনুমতি দেয়ার অর্থ হচ্ছে, ‘নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা’র সমান।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ভারত কি বাংলাদেশের ছবি দেখার অনুমতি দেবে? এখন পর্যন্ত তারা আমাদের ছবি দেখার তো অনুমতি দেয়ইনি, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখার অনুমতিও দেয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশীয় ছবি দেখিয়ে যারা ধনে-মানে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, তারা তো আমাদের ছবির দুঃসময়ে পাশে থাকছে না। তারা দেশীয় ছবির দুর্দিনে সহায়তা করতে দ্বিধান্বিত।
তিনি বলেন, ‘ছবি দেখতে দর্শক আসে না’র অজুহাতে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। আসলে দর্শক না আসার কারণে কিন্তু সিনেমা হলগুলো বন্ধ হচ্ছে না।
বরং সিনেমা হলগুলোর জীর্ণ দশার জন্যই সিনেমা হলমুখী হচ্ছে না দর্শক। এজন্যই সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানান, পাকিস্তান আমলে ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর বাংলাদেশ অঞ্চলে ভারতীয় ছবির আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে উর্দু-হিন্দি ছবি চলত, তবে তা ছিল সীমিত। ওই সময় চলচ্চিত্র শিল্পকে প্রণোদনা দেয়ার জন্য যারা বাংলা ছবি বানাতে চাইতেন, তাদের (প্রযোজক) সরকার হিন্দি ছবি আমদানির অনুমতি দিত।
ওই প্রযোজক হিন্দি ছবির অনুমতিপত্র প্রদর্শকদের কাছে বিক্রি করে ওই টাকা সিনেমা নির্মাণে বিনিয়োগ করতেন।
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিশা সওদাগর বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে আজ এফডিসিতে চলচ্চিত্রসেবীদের সংগঠন একতা পরিষদের বৈঠক হবে। এই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, এ ব্যাপারে আমরা কী করব? তিনি বলেন, ভারতীয় ছবি দেশে চলুক, তা আমরা চাই না। এ ব্যাপারে আমরা সবাই সোচ্চার। প্রতিবাদ জানাতে সবকিছু করা হবে।
এর প্রতিবাদ জানাতে আমরা সবকিছুই করব। জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাসের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী মনির খান বলেন, এখন একটি দেশের ভূখণ্ড দখল করলেই ওই দেশটি দখল হয় না। বর্তমানে আধিপত্যবাদীরা তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি দিয়ে অধস্তন দেশের সংস্কৃতিতে আধিপত্য সৃষ্টি করে। এভাবে অধস্তন দেশের নাগরিকদের মগজ ধোলাই করে ওই দেশকে আধিপত্যবাদী দেশ কব্জায় নিতে চায়। বাংলাদেশে ভারতীয় ছবির প্রদর্শনীও এ রকম উদ্দেশ্য নিয়েই করা হয়েছে।
ভারত তো আমাদের ছবি নিচ্ছে না, এমনকি আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো দেখানোর অনুমতিও দিচ্ছে না। সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, অচিরেই এসব বন্ধ করা হোক
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।