সাক্ষ্য গ্রহণের সূচনা বক্তব্যে প্রকাশিত হলো ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লার রাজাকারনামা। রাষ্ট্রপক্ষের দেওয়া ৮৮ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্যে ২১ নভেম্বর সোমবার সকালে পড়ে শেষ করা হয়। আগামী ৭ই ডিসেম্বর দেলুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে। একই দিন আসামীপক্ষকে তাদের তৈরি করা সাক্ষীর নাম ঠিকানা ট্রাইব্যুনালে পেশ করতে বলা হয়েছে।
সাঈদীর বিচার শুরুর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে রবিবার ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য শুরু করা হয়।
কিন্তু ওই বক্তব্য শেষ না হওয়ায় গতকাল অসমাপ্ত বক্তব্য শেষ করে রাষ্ট্রপক্ষ। প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সকাল ১০টা ৪৩ মিনিট থেকে বক্তব্য শুরু হয়ে ১১টা ৪৩ মিনিটে শেষ হয়। তাতে সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়।
গতকাল রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যে বলা হয়, সৈয়দ আফজাল হোসেন পিরোজপুরে শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন।
তবে সাঈদী আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী এবং বাকপটু হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ কারণে তিনি রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হতে সক্ষম হন।
সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, তিনি একজন ভুয়া মাওলানা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার থেকে বাঁচার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই পিরোজপুর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
এরপর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানি সেনা সদস্য, ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদস্যদের আটক করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু সাঈদী আত্মসমর্পণ না করে অস্ত্রসহ পিরোজপুর থেকে পালিয়ে যশোরের বাঘারপাড়া থানার রওশন আলীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে আত্মগোপন করে থাকাবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাঁর পরিচয় জেনে যায়। এ কারণে সেখান থেকে পালিয়ে যান সাঈদী। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তিনি প্রকাশ্যে আসেন এবং ভুয়া মাওলানা পরিচয়ে ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরে ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন।
এভাবেই তিনি ‘আল্লামা ও মাওলানা’ পরিচয়ে অপরাধ আড়ালের চেষ্টা করেন।
সূচনা বক্তব্যে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন জুন মাসের মাঝামাঝি সাঈদীকে লুঙ্গি কোচামারা, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, বাম হাতে একটা ডেউটিন, মাথায় পিতল ও কাঁসার থালা, জগ, বদনা. বাটি ইত্যাদিসহ একটি ঝাকা নিয়ে উত্তর হতে দক্ষিণ দিকে ৫ তহবিলের অফিসের দিকে যেতে দেখা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন পাড়েরহাট বাজারে ব্রিজের নিকট লোহালক্কড়ের দোকানদার বসন্ত ও সুরেন নিজ দোকানে বসে কাঁসার থালায় ভাত খাচ্ছিল। সাঈদী ও তার রাজাকার বাহিনী উক্ত দোকানের সামনে এসে লাথি মেরে তাদের গরম ভাত থালা থেকে ফেলে দেয়। ভাত ফেলে কাঁসার থালা দুটি জোর করে নিয়ে যায়।
রবিবার সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আসামী পক্ষের আইনজীবীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিদের আগামী ৭ ডিসেম্বর সাক্ষীদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
সূচনা বক্তব্যে একাত্তরে গোটা পিরোজপুরে সাঈদীর নৃশংসতা তুলে ধরা হয়। ৮৮ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্যের ১১৫ ও ১১২ নম্বর প্যারায় বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভানু সাহাকে ‘নিয়মিত ধর্ষণ’ করতেন সাঈদী। বিপদ সাহার বাড়িতেই সাঈদীসহ রাজাকার সদস্যরা ভানু সাহাকে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করতেন।
একইভাবে হুগলাবুনিয়া গ্রামের মুধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামীকে ধর্ষণ করা হলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তার গর্ভে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন কথা উঠলে লোকলজ্জায় দেশ ত্যাগে বাধ্য হন শেফালী। বর্তমানে ভানু সাহা ও শেফালী ঘরামী ভারতে অবস্থান করছেন।
সূচনা বক্তব্যের ১১৫ নম্বর প্যারায় আরও বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৫ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে সাঈদীর নেতৃত্বে উমেদপুর পাড়েরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার তিন বোন মহামায়া, অন্যরানী ও কমলা রানীকে সেনাক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ ছাড়া একইভাবে ২৫ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে পাড়েরহাট বন্দরের কিষ্ট সাহাকে হত্যার পর তার মেয়েসহ হিন্দুপাড়ার অসংখ্য নারীকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে ধর্ষণ করা হয়।
প্যারা নম্বর ১১৪ তে বলা হয়েছে, সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী হিন্দু সম্প্র্রদায়ের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালাত। তাদের বাড়ি-ঘর লুণ্ঠন করাসহ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত। পরে লোকজন সব হারিয়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। যারা যেতে পারেননি এ রকম মধুসূদন ঘরামী, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, হরিলাল, অমূল্য হাওলাদার, শান্তি রায়, জুরান, ফকির দাস, জোনা দাসসহ ১০০-১৫০ জন হিন্দুকে সাঈদী ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেন। তাদের নিয়ে তিনি মসজিদে নামাজ পড়াতেন, তাদের মুসলমান নামও দেন তিনি।
স্বাধীনতার পর ধর্মান্তরিত এসব মুসলমান স্বধর্মে ফিরে যান বলে এলাকায় এখন তারা ‘ধর্মান্তরিত’ বলে পরিচিত।
সাঈদীর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে একাত্তরের ৮ মে মানিক পশারী ও তার ভাইয়ের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে হত্যা, ২৫ মে থেকে ৩১ জুনের মধ্যে নলবুনিয়া গ্রামে আজহার আলীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার ছেলে সাহেব আলীকে হত্যার পর নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া, ২ জুন বিশা আলীকে নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা।
অন্য আরও অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৫ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ে আদাকুল গ্রামের বিমল হাওলাদারের ভাই ও বাবাকে ধরে কুড়িয়ানা হাইস্কুল ক্যাম্পে নিয়ে তাদেরসহ ২৫০০-৩০০০ নিরীহ বাঙালিকে পেয়ারা বাগানে নিয়ে হত্যা, ২৫ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সময়ের যে কোনো এক দিন হোগলাবুনিয়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে তরণী সিকদার ও তার ছেলে নির্মল সিকদার, শ্যামকান্ত সিকদার, বানীকান্ত সিকদার, হরলাল কর্মকার, মাইঠভাঙ্গারের প্রকাশ সিকদারসহ ১০ জনকে গুলি করে হত্যার পর নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া, ৪ মে থেকে ১৬ ডিসেম্ব্বরের মধ্যে পাড়েরহাটে আক্রমণ করে হরলাল মালাকার, অরকুমার মির্জা, তরণীকান্ত সিকদার, নন্দকুমার সিকদারসহ ১৪ হিন্দুকে রশিতে বেঁধে পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে নিয়ে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
গতকাল সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আগামী ৭ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন। তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
’
এরপর সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে বলেন, ‘আমরা দেশে-বিদেশে তদন্ত করছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা প্রয়োজন। আমরা পিরোজপুরে যাব। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা চাইছি।
’
জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘প্রয়োজন নেই। আপনারা যেদিন যাবেন, তার আগে এসপিকে চিঠি দেবেন। আশা করি, সব ঠিক থাকবে
সাঈদীর বিরুদ্ধে গত ৩১ মে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনসহ অগি্নসংযোগের অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ সংবলিত ১৫ খ ের ৪ হাজার ৭৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন টিমের কাছে জমা দেওয়া হয়। এরপর গত ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি ঘটনায় অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়। গত ২৯ জুন থেকে সাঈদী কারাগারে আটক রয়েছেন।
খবরের সূত্র এই লিংকে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।