শফিক হাসান মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা। নিজের সীমিত চৌহদ্দি ডিঙ্গিয়ে আরো সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু সব মানুষ কি পারে স্বপ্ন সফল করতে! স্বপ্নলোকের সিঁড়ি স্পর্শ করার সুযোগ কম মানুষই পায়। স্বপ্ন দেখে যারা স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে পারে তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান, পরিশ্রমী। কুশলীও বটে।
গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীরা নতুন একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। অনেকেই মডেল হতে চায়। হতে চায় ছোট বা বড় পর্দার নায়ক-নায়িকা। তবে মডেল হওয়ার দিকেই ঝোঁক অধিকাংশের। কারণ মডেল হতে তেমন প্রতিভা না থাকলেও চলে, শুধু সুন্দর মুখাবয়ব ও চলনসই ফিগার থাকলেই হলো।
তাছাড়া মডেলের স্ট্যাটাসও অনেক বেশি। বর্তমানে সারা বিশ্ব কাঁপাচ্ছে বিজ্ঞাপন দুনিয়া। পণ্যের বাজারের চেয়ে বড় কোনো বাজার নেই। সঙ্গত কারণেই এ প্রবণতায় আচ্ছন্ন হয়েছে অনেক স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী। কেউ এতো বেশি এই স্বপ্ন-আক্রান্ত, তারা ভাবে মডেল হতে না পারলে জীবন বৃথা।
সুতরাং মডেল হওয়ার জন্য সোজা কিংবা বাঁকা পথ যত পন্থাই অবলম্বন করা প্রয়োজন, তার কিছুই করতে পিছপা হয় না তারা। কিন্তু পর্দা সবাইকে নেয় না। অনেককেই ছুড়ে ফেলে আস্তাকুঁড়ে। গ্রহণ-বর্জনের এই অবিনাশী খেলায় কারো জীবন, বেঁচে থাকা কণ্টকাকীর্ণ হয়ে ওঠে। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।
মডেলিংয়ের চোরাবালিতে মেয়েরাই পা দেয় বেশি। যেহেতু তাদের হারানোর মতো সম্পদ ছেলেদের তুলনায় কিঞ্চিত অধিক। তাদের অস্ত্র শরীরী সম্পদ, যা টাকার চেয়েও উপাদেয়। প্রয়োজনে এই সম্পদ ব্যবহার করতে দিতে দ্বিধা করে না মেয়েরা। এসব করতে করতে, স্বপ্ন পূরণের নেশায় তারা এতোবেশি তলিয়ে যায়-ফেরার পথ থাকে না।
চোখের সামনের স্বপ্নটুকুও ক্রমশ ম্লান হতে শুরু করে। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়ার পরই যখন নিজেদের ভুলটুকু ধরা পড়ে; তখন আর কিছুই করার থাকে না। কারণ অধিকাংশের জন্যই এটা ‘ওয়ানওয়ে রোড’। এই ওয়ানওয়ে রোডের সর্বশেষ যাত্রী হয়েছেন র্যাম্প মডেল তাহিয়া তাবাসসুম আদৃতা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হন আদৃতা।
৩১ অক্টোবর রাতে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। আদৃতার গলায় শ্বাসরোধের চিহ্ন ছিলো। ধারণা করা হয়, খুনি আদৃতার ওড়না দিয়েই শ্বাসরোধ করে। লাশ উদ্ধার করার পর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাফন করে। পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সূত্র ধরে আদৃতার পরিবার তার পরিচয়টি নিশ্চিত করে।
ধারণা করা হয়, প্রেমঘটিত কারণে খুন হন আদৃতা। একাধিক ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো। সবশেষে তিনি সম্পর্কে আবদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আশিস কর্মকার রেহানের সাথে। পেশাগত সূত্রই এ সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করে। রেহান থাকেন ঢা. বি.’র জগন্নাথ হলে।
পড়াশোনার পাশাপাশি রেহান র্যাম্প মডেল হিসেবেও কাজ করেন। একত্রে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় এবং প্রণয় গড়ে ওঠে আদৃতার সঙ্গে। আদৃতা খুনের পর হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ধারের জন্য পুলিশ গ্রেপ্তার করে তার প্রেমিক রেহানকে। এর আগে, পৃথকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় রনি ও মাসুদ নামে দুই যুবককেও। এদের নামে মামলা হয়েছে।
এছাড়া মামলা হয়েছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা জেনেসিস ভিউ অ্যান্ড মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট’র নামেও। মামলার পরপরই এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, কর্মকর্তারা গা ঢাকা দেয়। অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, কর্মকর্তাকে শেল্টার দিচ্ছে; ইচ্ছাকৃতভাবে এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে। জেনেসিস ভিউ নামক এই বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আদৃতা কাজ করতেন। দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে জেনেসিস ভিউয়ের মালিক মোতালেব হোসেন বরুণের সাথে আদৃতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়।
বরুণের সাথে তোলা বেশকিছু ছবিও আদৃতার ল্যাপটপে ছিলো। কিন্তু বর্তমানে ল্যাপটপটি উধাও। ধারণা করা হচ্ছে, যে চক্র আদৃতাকে হত্যা করেছে তারাই এসব গুম করেছে। এছাড়া আদৃতা ব্যবহার করতেন পাঁচটি মোবাইল ফোন সেট। নিহত হওয়ার দিন পাঁচটি ফোনই তার সাথে ছিলো, কিন্তু পরে এই ফোনগুলোও সুকৌশলে সরিয়ে ফেলা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রেহান স্বীকার করেছেন, তিনিই আদৃতাকে হত্যা করেছেন। আদৃতা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন রেহানের সাথে। এজন্য তিনি রেহানকে চাপাচাপিও করতেন। কিন্তু রেহান পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে বিয়ে করতে পারবেন না বলে এড়িয়ে যেতেন। খুন হওয়ার দিন আদৃতা ভাড়া বাসায় ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন রেহানের কাছে।
কিন্তু রেহানের অসম্মতিতে কথা বাড়াবাড়ি হয়। বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে আদৃতাকে খুন করেন তিনি। সংবাদসূত্র রেহানের স্বীকারোক্তিমূলক এ খবর জানালেও এখনো আদৃতার হত্যা রহস্য ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটিত হয়নি বলেই অনেকের ধারণা। এর পিছনে উক্ত বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাত থাকাও অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তার সাথে আদৃতার ইয়াবা সেবনের তথ্যও পাওয়া যায়। ইয়াবা সেবনের জন্য আদৃতা মাঝে মাঝে এ অফিসে যেতেন। আর্থিক সংকটের দরুন অনেক বিজ্ঞাপন নির্মাতা আদৃতাকে ব্যবহার করেছেন। আদৃতাও ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, ভবিষ্যত সম্ভাবনার কথা ভেবে নিজেকে ব্যবহার হতে দিয়েছেন। অনেকেই আদৃতাকে কাজ পাইয়ে দেবার প্রলোভনে ফেলে ব্যবহার করেন।
কিন্তু কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, তা পরিষ্কার। যা হয়েছে তা অকাজ। অকাণ্ড। সবশেষে আদৃতা খুনই হয়ে গেলেন! খুনের মাধ্যমেই পরিসমাপ্তি ঘটলো তার মডেল হওয়ার স্বপ্নের।
মডেল খুন হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম নয়।
এর আগেও ঘটেছে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলে মডেল তিন্নি হত্যাকাণ্ড। জনপ্রিয় মডেল তিন্নিকে খুন করে তার লাশ ফেলে রাখা হয় রাস্তার পাশে। ‘বেওয়ারিশ’ লাশ উদ্ধার করে দাফনের পর আবিষ্কৃত হয় তার পরিচয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে অনেকের নাম।
এ খুনের হোতা সাংসদ গোলাম ফারুক অভি। প্রায়ই অভি তিন্নির সাথে, তিন্নিরই বাসায় মিলিত হতেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিন্নিকে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবন করাতেন। তাদের একাধিক নীল ছবির সিডিও রয়েছে। এই পর্ণো সিডির ভয় দেখিয়েই অভি তিন্নির মুখ বন্ধ রাখতেন।
তিন্নি হয়ে পড়েছিলেন অভির হাতের পুতুল। অভি যেভাবে চাইতেন সেভাবেই নাচতে হতো তিন্নিকে। তিন্নির স্বামী ফ্যাশন ডিজাইনার পিয়াল সব জানতেন। জেনেও ছিলেন নিশ্চুপ। উল্টো পিয়াল নিজেই অর্থের বিনিময়ে তিন্নিকে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার হতে দিয়েছেন।
‘ক্লায়েন্ট’ জোগাড় করাও ছিলো তার নৈমিত্তিক কাজ। টাকার লোভে পিয়াল সব পারতেন। নিজের স্ত্রীকে পরপুরুষের বিছানায় পাঠানো তার কাছে ‘ডালভাত’। তিন্নি হত্যাকাণ্ডের পরপরই বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ আরো অনেক তথ্য। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এলে, সাংসদ অভি পালিয়ে যান কানাডা।
এক দশক শেষ হয়ে গেলেও এখনো শেষ হয়নি অভির ফেরারি জীবনযাপন। যদিও গত জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল থেকে অভির সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিলো। বিদেশ থেকেই সব নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। জনসভায় বক্তৃতা দিতেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। কিন্তু মইন-ফখরুদ্দীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করায় পাল্টে যায় দৃশ্যপট।
অভির আর ফেরা হয় না। এদেশে অকর্ম-কুকর্ম করে অভিদের কিছুই হয় না। অন্য মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড হলেও কারাভোগ না করে ক্ষমতাসীনদের বদান্যতায় জেল থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি সহজেই। কিন্তু তিন্নিদের ললাটে লেখা থাকে দুঃখ আর লাঞ্ছনা। অকালমৃত্যু।
তাদের ভুলে কোনো ক্ষমা নেই। নিয়তি এখানে খুবই নির্মম। এ বাজে পরিণতির জন্য তারা নিজেরাও কম দায়ী নয়। তারা যে স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্নে মশগুল, সে জগতের খানাখন্দে ঘাপটি মেরে আছে নানামুখী অন্ধকার। অতল এ অন্ধকার ডিঙিয়ে আলো ঝলমল জগতে প্রবেশ সহজসাধ্য নয়।
কিন্তু নামযশের মোহে অন্ধ মডেল যশোপ্রার্থীরা এসবের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যান স্বীয় লক্ষ্যপানে। লক্ষ্যপানে পৌঁছাতে প্রয়োজনবোধে তারা সমাজ, সংস্কৃতিবিরোধী কাজ করতেও দ্বিধা করেন না।
মডেল হওয়ার যে সর্বনাশা খেলায় আমূল জড়িয়ে পড়ছেন এদেশের তরুণীরা, এ প্রবণতা মোটেও সুস্থ নয়। শর্টকাটে মডেল হওয়ার চেয়ে মডেল হওয়ার জন্য যে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয় সে চিন্তা বা চেষ্টা অনেকেরই নেই। ফলে শর্টকাটের কাজেই অনেক সময় ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা।
স্বপ্ন পরিণত হচ্ছে দুঃস্বপ্নে। এ সর্বনাশা প্রবণতা, আকাশকুসুম কল্পনায় রাশ টানতে না পারলে দুঃস্বপ্নের পালা ক্রমশ ভারীই হতে থাকবে। বাড়তে থাকবে তিন্নি কিংবা আদৃতাদের লাশ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।