সব কিছু চলে যাচ্ছে নষ্টদের অধিকারে ভারতে অনেকবার যাওয়া হয়েছে কিন্তু ভ্রমণ বলতে ঠিক যা বুঝায় কখনো তা হয়ে ওঠেনি। যতোবার যাওয়া হয়েছে হয় কোন সাহিত্য সম্মেলন কিংবা কবিতা পাঠের আসর কিংবা চিকিৎসাজনিত কারণকে সামনে রেখেই যেতে হয়েছে। কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গেলে যা হয়, দাওয়াতদাতাদের নির্ধারিত সিডিউলের বাইরে যাওয়ার সুযোগ খুব একটা থাকে না। আর চিকিৎসার কারণে হলেতো ঘুড়ে বেড়ানোর কথা কল্পনার ধারে কাছেই আসতে পারে না। তাই অনেকদিন থেকে আমার ভ্রমণ পিপাসু মন যাবো যাবো করছিল।
আমার স্ত্রীর অনেকদিনের বায়না তীর্থ ভ্রমণে যাবে। বিশেষ করে দু বছর আগে তার হার্টের ভাল্ব সার্জারির পর এই বায়নাটা বেড়ে গেছে। আমি তাতে সাই দিলেও কবে, কীভাবে যাওয়া হবে সেটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে দিন কেটে যাচ্ছিল। কয়েকজন প্রতিবেশীর তীর্থ ভ্রমণের প্রস্তুতির কথা কানে যেতেই স্ত্রী নড়ে চরে ওঠলেন, প্রতিদিন কানের কাছে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন- এবার যাওয়া যাক। আমিও মনে মনে নেচে ওঠলাম এক অজানা আনন্দের শিহরণে।
কিন্তু সামনে দু ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা, এ সময় বাইরে যাওয়া কতটুকু সমীচিন হবে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই দিন কাবার হয়ে যাচ্ছে। যা হবার হবে ভেবে ছেলেদের পাসপোর্টের আবেদন করে ফেললাম। দিন পনেরোর মধ্যে পেয়েও গেলাম। পাসপোর্ট হয়ে গেলেও মন দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে দোলছিল। মাথায় সবসময় একটি কথাই ঘুড়পাক খাচ্ছে- সামনে ছেলেদের বার্ষিক পরীক্ষা।
পাক্কা একমাসের ভ্রমণ। ফিরে এসেই বার্ষিক পরীক্ষার ধাক্কা সামলাবে কীভাবে। সবশেষে মনকে বুঝালাম, যা হবার হবে, এবার যাবোই। পরীক্ষায় একবছর না হয় ড্রপ দিল, এমন কী আর হবে? শুরু হল প্রস্তুতির পালা।
দল অনেক ভারী হয়ে গেছে।
১৬ জনের দলে সবশেষে যোগ হল আরো তিনজন। আমার বড় ভাই, বড় বৌদি আর বৌদির ছোটভাই। উনিশজন লোকের ভিসার ব্যবস্থা করা চাট্টিখানি কথা নয়। ভিসা পেতে পেতে সেপ্টেম্বরের ২৫ পেড়িয়ে গেলো। ঠিক হলো অক্টোবরের ৩ তারিখ আমরা ডাউকী সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করব।
নির্ধারিত দিন সকাল সারে নয়টায় দুটো লাইটেস বোঝাই হয়ে রওনা দিলাম তামাবিলের উদ্দেশ্যে। তামাবলিরে রাস্তাটাই আপনার ভ্রমণরে আনন্দ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখবনে দূরে অনেক উচু সব পাহাড়। এই পাহাড়রে উপরেই আপনাকে যেতে হবে। মনে পড়ে নজরুলরে সেই বিখ্যাত গানের কলি- আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ...।
ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌছে গেলাম তামাবিল বর্ডারে। কিছু পরিচিতজনের সহায়তায় ইমিগ্রেশনে তেমন সমস্যা হয়নি, যদিও ১৯ জনের নাম এন্ট্রিসহ বিভিন্ন রুটিন কাজ সারতে সময় অনেক লেগে গেছে। যাই হোক, কাস্টম, ইমিগ্রেশনের কাজ সেড়ে অপরাহ্ন ১টার দিকে আমরা ভারতের বুকে পা রাখলাম। ভারতরে ডাউকি চেকপোস্টে দেখলাম বিল বোর্ডে বড় হরফে লেখা Welcome to India। ভারতের কাস্টম, ইমিগ্রেশন শেষে দুটো টাটা সোমোতে চড়ে বসলাম, গন্তব্য- ভারতের 'সেভেনে সিস্টার্স' এর অন্যতম মেঘালয়ের রাজধানী শিলং।
আড়াই-তিন ঘন্টার পাহাড়ী পথে যাত্রা। গাড়িতে বসে বসে চারপাশ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ বাংলাদেশ দেখা যায়, পরে পাহাড়ি পথে ঝর্ণা আর প্রাকৃতকি দৃশ্য দেখে আমি ক্যামরো হাতে নিয়ে গাড়িতে বসে বসেই ঝটপট ছবি তুলতে থাকি। আমাদরে সোমো ততক্ষণে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার ফুট উপর দিয়ে চলছে। কেবল খাড়াই নয়, রাস্তার ২০/৩০ হাত পর-পর ভয়ানক মোড়।
জীপ থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখছি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মনকাড়া পাইন গাছের সারি। মাঝে-মাঝে রডো ড্রেন-ড্রেন। গাড়ি থেকে নীচের দিকে তাকালেই মন একবোরে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। চোখ চলে যায় কয়েক হাজার ফুট নীচের গহবরে। ভয়ে আমাদের ভ্রমণসঙ্গীদের অনেকেই একবোরে আড়ষ্ট।
অনেকের খানকিটা বমি-বমির ভাবও হলো। যতই উপরে উঠছি ততই ঠাণ্ডা লাগছে। বিশাল বিশাাল পাহাড়, তার বুক চিড়ে সরু রাস্তা। আর এ রাস্তা দিয়েই আমাদরে টাটা সোমো ছুটে চলছে শিলং এর উদ্দেশে। দুপাশে পাহাড়ী খাদ।
এ খাদের মাঝে আবার দু এক জায়গাতে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ী নদী। সাপের মতো পাহাড়রে গা বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে।
ঠিক সন্ধেবেলা আমরা পৌঁছে গেলাম শিলং-এর কেন্দ্রস্থল পুলিশ বাজারে। ১৮৬৪ সালে ইংরেজরা যখন আসাম জেলার সদরদপ্তর চেরাপুঞ্জী থেকে শিলং এ নিয়ে আসে তখনই গোড়াপত্তন হয় শহরটির। প্রায় ২০০০ মিটার উঁচু শিলং পিক এর তলায় ঘন সবুজ পাহাড়, ঢেউ খেলানো জমি আর নদীর কলস্বররে মধ্যে ছবির মতো ক্রমশ বিস্তৃত হয় শহরটি।
শিলং অসম্ভব সাজানো গোছানো সুন্দর একটা ছোট শহর। শহরের বাইরে থেকেই দেখবেন সুন্দর সব একতলা, দোতলা বাড়ী। রাস্তা ঘাট বেশ ভালো, ঘুরে বেড়াতে মজা পাবেন। তবে ট্যাক্সি ক্যাব ছাড়া আর কিছু নেই। শহরের অর্ধেকে জুড়েই আবার ক্যান্টনমেন্ট।
শিলং এ খ্রীস্টান সম্প্রদায় বেশি, সে কারণে চার্চও অনেক। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, প্রায় সব বাড়ীর সামনেই গোলাপগাছের ঝাড়। ঘর যত ছোটই হোক না কেন গোলাপ ফুলের স্নিগ্ধ ছোঁয়া তাতে থাকবেই, এ যেন তাদের রূচিরই পরিচায়ক! গোলাপের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাক্টাসেরও দেখা মিলবে এখানে। ভালো মানের স্ট্রবেরির ছড়াছড়ি এখানে। শহরে অনেকে ভালো খারাপ হোটেলে, থাকা খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
থাকা খাওয়ার খরচও টুরিস্ট সিটি হিসেবে কম। তবে শপিং করাটা বোধহয় খুব একটা সুবিধার হবে না। দাম একটু বেশিই। ঘুরে বেড়াতে চাইলে আশেপাশের পার্ক, ফলস্ এইসব দেখতে পারেন, আরেকদিন যাবেন এলিফ্যান্ট ফল্স, উমিয়াম লেক, শিলং পিক এইসব দেখতে। আর চলে যেতে পারনে চেরাপুন্জি।
একদিন পুরা হাতে রাখবেন চেরাপুন্জির জন্য। মেঘের জন্য চারপাশে কিছু দেখবেন না। এরমধ্যেও যা দেখবেন পাহাড়ের উপর থেকে মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। পায়ের নিচ দিয়ে দেখবেন মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে দেখলে কুয়াশা মনে হতে পারে, আসলে সব মেঘ।
মাঝেমেধ্যে এমন হয় কিছু দেখা যায় না, হঠাৎ করে সব ফুঁড়ে উঠে। এই অবস্হা অবশ্য শিলিংয়েও হতে পারে। এই কারণেই এই রাজ্যের নাম মেঘালয়।
শিলংয়ের টুকিটাকি প্রয়োজনীয় তথ্য
আবহাওয়া: মার্চ ও জুন মাসে শিলংয়ে বেড়াতে যাওয়ার আদর্শ মরসুম। গ্রীষ্মে হাল্কা উলের পোশাক ও শীতে ভারি গরমজামার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বৃষ্টিপাত এ অঞ্চলে যখন-তখনই হতে পারে।
থাকার ভাল জায়গা:
শিলং ক্লাব, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২৬-৯৩৮। হোটলে সেন্টার পয়েন্ট, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২৫-২১০। হোটেল পোলো টাওয়ার্স, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২২-৩৪১। হোটেল পাইনউড, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২৩-১১৬।
মধ্যম মানের থাকার জায়গা : ইয়ুথ হস্টেল, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২২-২৪৬। হোটেল আনন্দ, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২৩-৪৬৬। হোটেল উৎসব, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২৬-৭১৫। হোটেল মনসুন, ফোন নং: ৯১-৩৬৪-২২২৩-৩১৬
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।