আজকের পুরোটা সকাল অথবা সকাল হওয়ার আরো অনেক আগে যখন একটু একটু করে হয়তো ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে আর আমি নিদ্রা-জাগরণের মাঝামাঝিতে থেকে আরো একটু ঘুমাবার চেষ্টা করছি সেই তখন থেকেই একটা ভ্যাপসা- অস্বস্তিকর গরম। এই রকম গরমে বিছানার এপাশ- ও পাশ গড়াগড়ি করে নেয়া গেলেও ঘুমটা আর ঠিক জমে ওঠে না। তো সেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করার সময় থেকে আজকের পুরোটা সকাল, আবার সকাল পার হওয়ার পর দুপুর কিংবা তারও পরের বিকাল বেলাতেও মাঝে মধ্যে পুরা আকাশটা মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ মেঘটা খুব ঘন হয়ে উঠছে, একটু খেয়াল করে আকাশের দিকে তাকালে কেন জানি একটা বিষণ্ণ কিশোরীর মুখ দেখছি বলে ভুল হয়। এইরকম মেঘ দেখলে মনে বড় আশা হয় কোথাও থেকে একটা হিম বাতাস এসে সব জুড়িয়ে দিয়ে যাবে, একটা দমকা বৃষ্টি এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
কোথায় কী! সারাটা দিন যেন এক ফোঁটাও ভেজা কি শুকনো কোন বাতাসই নাই। দূরে কোথায়ও কি একটুও বৃষ্টি হয় না?
না-হওয়া বৃষ্টির জন্য প্রতীক্ষাই বলি, আকুলতাই বলি, কিংবা ক্ষোভই বলি সব একটা সময় এই বিকালে এসে না-আসা একটা ট্রেনের উপর গিয়ে পড়ে। বিকাল সাড়ে চারটা থেকে আমি বিমানবন্দর রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের ঠিক এখানটায় ঠাঁয় দাড়ানো। না দাড়িয়ে থেকে আমার করার আর কি বা আছে? এখানে অপেক্ষায় আছে কয়েক হাজার যাত্রী, সঙ্গে তাদের বাক্স-পেটরা, সঙ্গে হয়তো না-হওয়া বৃষ্টি অথবা না-আসা ট্রেনের জন্য প্রতীক্ষা অথবা আকুলতা অথবা ক্ষোভ। এই ভিড়ের মধ্যে ঠাঁয় দাড়িয়ে থেকে আমার মনে হতে থাকে শেষ পর্যন্ত সব কিছুরই- সেটা প্রতীক্ষাই হোক, আকুলতাই হোক, কিংবা ক্ষোভই হোক- একটা শেষ আছে।
তারপর বৃষ্টিটা আসে প্রথমে ফোঁটায়-ফোঁটায়, সাথে একটা ঝিরঝিরে বাতাস নিয়ে, তারও একটু পরে- যেন বা লজ্জা পুরোপুরি কেটে গেছে- বৃষ্টিটা একদম ঝমঝমিয়ে আসে। বৃষ্টির সাথে সাথে এতক্ষণের বিকালটা টুপ করে সন্ধ্যার ভিতর ডুব দেয়। তারও অনেক পর রাত একটু একটু করে মধ্যরাতের অনেক গভীরে তলিয়ে যেতে থাকলে একা নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে আমার ভিতরে একটা গান সুর হয়ে বাজতে শুরু করে-~~যা কিছু ছিল থেমে থাকা আবার থামবে এই বিদায়ে/ আমার অপার সীমানাতে তোমার চিহ্ন তবু বেঁচে~~।
সুবর্ণ এক্সপ্রেস আসে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে, সন্ধ্যা সাতটায়। ভিড় ঠেলে নিজের সীটের কাছে আসলে আমার এতক্ষণের ভুলে থাকা অস্থিরতা আবার উড়ে এসে জুড়ে বসে।
এই প্রথম আমি টিকেট না কেটেই ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনের এক এটেন্ড্যান্ট এসে আমাকে টিকেট দিয়ে যাওয়ার কথা। প্রথম শ্রেণীর ৩৮০ টাকার একটি সীট ৫০০ টাকায়। আমাদের মত অতি অলস বা অতি ব্যাস্ত যারা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকেট কাটতে পারেন না তাদের জন্য ভালো ব্যাবস্থাই বলতে হবে। কিন্তু এই ব্যাবস্থা যতই ভালো হোক, এখন টিকেট হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার ভিতরের অস্থিরতা আর যায় না।
তো এই অস্থিরতা নিয়েই বসে থেকে আমি দেখি আমার পাশের সীটের ছোট একটা মেয়েকে। আমার চিনতে ভুল হয় না -মেয়েটা একটা মেইড। আমাকে স্বস্তি দিতে একটু পর ট্রেনের এটেন্ড্যান্ট এসে হাজির।
স্যার, আপনাদের চারজনের জন্য একটা টিকেট।
চারজন মানে? আমার টিকেট কোথায়?
উনাদের সাথে।
উনারা তিনজন আর আপনি একজন-এই চারজনের জন্য একটা টিকেট।
বিরক্তিটা চেপে রাখলে একটু পর আমি বুঝতে পারি আমার পাশের মেইড সহ আমাদের পেছনে সারিতে বসা আরো দুইটা মেয়ে নিয়ে ওরা তিনজন। তাকিয়ে দেখি মেয়ে দুটোর মধ্যে একজন হয়তো মেইডের সমবয়সী, আর একজন হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অথবা সদ্য পাশ করা তরুণী।
স্যার, উনারা তিনজন তো, তাই টিকেট উনার কাছে থাকবে।
এতক্ষণে- টিকেট যার কাছে থাকবে সেই তরুণীর দিকে আমি ভালোভাবে তাকানোর একটা উপলক্ষ পাই।
তারপর আরো একবার তাকালে আমার মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে ওঠে। আমি বুঝতে পারি আমার চারপাশটা-এই ট্রেন, সঙ্গে তার যাত্রীরা, ট্রেনের বদ্ধ জানালার ওপাশের জমানো অন্ধকার, যার দিকে তাকিয়ে আছি সেও তরুণীও-সব দুলতে শুরু করেছে। নিজেকে নিয়ে আমার সন্দেহ হয়- নিশ্বাস নিতেও বোধ হয় আমি ভুলে যাচ্ছি। তারপর সব যেমন শেষ হয় চারপাশের দুলুনি তেমনই বন্ধ হলে আমার ভিতর থাকে শুধু মাত্র একটা শূন্যতার বোধ। মিলা! কতোদিন পর! কতোদিন পর দেখলাম!
আমি ঠিক দেখেছি? মিলা তো? সত্যিই মিলা? মাইনাস এইটিন পাওয়ারের লেন্সের আড়ালে ঢেকে যাওয়া আমার চোখে অনেক কিছুই এড়িয়ে যায়।
‘এইটা কেমন কথা? আমি এতক্ষণ আপনার সামনে দাড়ানো। আপনি আমাকে একটুও চিনতে পারেন নাই?’ - মিলাই কি একদিন আমার কাছে অনুযোগ করে নি? সুতরাং পেছনের সারিতে বসা তরুণীর দিকে আমাকে আবার তাকাতে হয়। তারপর আমি দেখি স্বচ্ছ ওড়নার আড়ালে ঢেকে যাওয়া একটা মুখ, এখনও কৈশোরের স্পর্শ লেগে থাকা দুটো চোখ অথবা ছল করে তাকানোর ভঙ্গীমা অথবা সব উপেক্ষা করা তীব্র চাহনি-এইটা মিলা ছাড়া অন্য কেউ না।
আমি বুঝতে পারছি আমার ভিতর প্রেম নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়-অন্য একটা বোধ জন্ম নিচ্ছে। এইটাকে বোধ হয় শূন্যতার বোধই বলে।
আশেপাশের জড়-জীবজগতের অস্তিত্ব ভুলে শূন্যতার ভিতরে একটা ঘুমের মতোন তলিয়ে যেতে থাকলে আমাকে যেন এক প্রকার ধাক্কা দিয়েই জাগিয়ে তোলে সর্বক্ষনের সঙ্গী মোবাইল ফোনটা। ওপাশে এক বন্ধুর কন্ঠে হতে হতে না-হওয়া শচীনের আরো একটা সেঞ্চুরীর আক্ষেপ আমাকে তেমন না টানলেও আমার মনে পড়ে যায় আজ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ভারত-পাকিস্তান সেমিফাইনাল। খেলাটা মিস করবো বলে গতকালও নিজের ভাগ্যকে দুষছিলাম।
ট্রেনের চা একদম পানসে, তাও প্রতিবার ট্রেন ভ্রমণে সময় কাটানোর জন্য হলেও এই পানসে চায়েই চুমুক দিতে হয়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমার মনে পড়ে যায় ব্যাগের ভিতর রাখা ড্যান ব্রাউনের ডিসেপশান পয়েন্ট বইটার কথা।
ভাগ্যিস, মনে করে বইটা নিয়ে আসছি- নিজেকে নিজেই তারিফ করি। বাকী সময়টা অন্তত এই বইটা সাথে নিয়ে- মিলাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে- কাটিয়ে দেয়া যাবে।
অথচ সময় কাটিয়ে দেয়া যায় না। পাতার পর পাতা উল্টাতে উল্টাতে পড়তে পড়তেও ঠিক বুঝতে পারি আসলে কিছুই পড়া হয় নাই। মোবাইল হাতে নিয়ে একে-ওকে ডায়াল করি।
তারপরও একটা বিক্ষিপ্ত মনে শূন্যতার বোধ নিয়ে বসে থেকে ভাবি এই পালিয়ে যেতে চেয়ে আসলে লাভ কোথায়? পালাতে কি পারি? মিলা তো থাকে সবসময় মাথার ভিতর, মনের ভিতর অবিকল একটা পোকার মতোন। পুরনো প্রশ্নগুলো আমাকে প্রতিবারের মত আবারো ঠোঁকাতে থাকে- আমি কি মিলার প্রেমে পড়েছিলাম?
মিলা, তোমার সাথে আমার পরিচয় মাত্র বারো দিনের। বারো দিন কত কম সময়, না? আবার বারো দিন অনেক বড় একটা সময়ও হতে পারে। অন্ততঃ আমার কাছে। আমি জানি এই বারো দিন আমার কাছে আর ফিরে আসবে না।
আমি জানি এই বারো দিন আমার সামনে পড়ে থাকা বাকী জীবনটাকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে আমাকেও। আমি কখনো জানতাম না আমার মতোন অন্তর্মুখীন একটা মানুষের কাছে এত গল্প জমা ছিল কাউকে বলার জন্য। মিলা, গত কয়েকদিন ধরে আমার ভিতর নিজের প্রতি একটা বিরক্তি চলে আসছে। আমি কখনো যা ভাবিনি-আমি তাই করছি সেজন্য।
আমি কখনো ভাবিনি একটা মেয়ের জন্য আমার ভিতরটা এতটা আকুল হয়ে উঠবে। আমি ভাবিনি যা কখনো পাইনি তা হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় আমাকে ঘিরে ফেলবে। মিলা, আমি প্রেমে পড়ে গেছি!
কতোদিন পর মিলার সাথে দেখা হল? চার বছর, না কি পাঁচ বছর? এতদিন আগের পুরনো কথাগুলো মনে পড়লে আমার ভিতর- স্বীকার করি একটা কষ্টের অনুভুতি থাকলেও, সেটাকেও ছাপিয়ে-এককালের প্রেমে পড়ার উদ্ভ্রান্ত অথবা ডুবন্ত,অসহায় অনুভূতির কথা ভেবে একটু ভালো লাগাও কি এসে আমার মনকে খানিকক্ষণের জন্য জুড়িয়ে দিয়ে যায় না?
মিলার সাথে আমার কোনও মিল কি ছিল? ও আমার মতোই বই গোগ্রাসে গিলতে পারতো। ওর বয়েসী টীন এইজের মেয়েরা যেমন হয় বইয়ের গল্প পড়ে মিলারও বুক ভারী হয়ে আসতো, চোখের কোণে কান্না জমতো। একবার মিলাকে একটা গল্প বলেছিলাম- একটা দুঃখী মেয়ের গল্প, ছোটবেলাতেই ওর মা ওকে ফেলে গিয়েছিল, একা অভিমানী মেয়েটা একদিন নিজেকে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে সব কষ্টের ঊর্ধ্বে চলে গেল।
গল্পটা বলার পর মিলার বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা কান্না, সঙ্গে থেমে থেমে আসা ফোঁপানির শব্দ অথবা ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখ আমার ভিতর একটা মায়ার অনুভুতি জাগালেও,স্বীকার করি, আমার গল্প ওকে কষ্ট দিয়েছে এই ভেবে একটা প্রশান্তির অনুভব খানিকক্ষণের জন্য আমার মনকে জুড়িয়ে দিয়েছিল।
অনেককাল আগের পাওয়া সেই সব কষ্ট, কষ্ট-সুখের অনুভূতি, ফোঁপানির শব্দ, প্রশান্তির অনুভব, উদ্ভ্রান্ত অথবা ডুবন্ত, অসহায় অনুভূতিগুলো এখন এই শূন্যতার সাথে মিশে গিলে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না আমার এই মুহূর্তের অস্থিরতা আসলে কীসের জন্য। তবে বুঝতে পারি স্মৃতি ব্যাপারটা আসলে বহুদিন না পড়া, না ছোঁয়া একটা বইয়ের মলাটে জমা ধূলার মত। এখন বইটা ধরতে গেলে গায়ের উপর কিছু ধূলা এসে পড়বে। আমিও তাই বসে বসে গায়ে স্মৃতির ধূলা মাখতে থাকি।
জানেন, আমাদের বাসা থেকে না একদম সমুদ্র দেখা যায়!
বুঝলাম।
ধ্যাৎ, কিচ্ছু বুঝেন নাই। একদম বঙ্গোপসাগর মানে বে অভ বেঙ্গল দেখা যায়। আজকে সকালে আমি বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম। কি যে বাতাস! আমার সব চুল উড়তেছিল।
ভালো তো।
আমি এতবার বীচে গেছি, এমনকি কক্সবাজারেও, অথচ একবারও সমুদ্রে নামিনি।
কেন?
আম্মু বকা দেয়। সাঁতার জানিনা তো।
ঠিক আছে।
আমি কখনো নিয়ে গেলে তোমাকে সমুদ্রে নামতে দিব।
সত্যি! কিন্তু যদি ডুবে যাই তখন কি করবেন?
কি আর করব? তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব। আমি তো নিজেও সাঁতার জানিনা।
আমার কথা শুনে মিলা প্রথমে আহত, পরে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
আপনি জানেন, আপনাকে আমি খুব ভয় পাই?
আমি নিজের মধ্যে কৌতুক অনুভব করি।
তাই না কি? কেন ভয় পাও?
আপনি ঠিক স্বাভাবিক মানুষ না। আমি এত ছেলের সাথে, সত্যি অনেক ছেলের সাথে মিশছি, কারোর সাথেই আপনার একটুও মিল নেই। আপনি খুব অন্যরকম টাইপের। আপনার মধ্যে কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকতা আছে। এইটাকে আমি খুব ভয় পাই।
খুব সাধারণ হয়ে যেতে পারেন না আর সবার মত?
মিলা কি শেষ পর্যন্ত সেই ভয় থেকেই পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছে? আমার অনেক সংকোচ-সংশয়ের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রশ্নের ভিড়ে হারিয়ে গেছে এই প্রশ্নটাও, ঠিক যেমন এখন এই মুহূর্তে আমার নিছক কুশল বিনিময়ের অজুহাতে ওর সাথে একটু কথা বলার ইচ্ছাটা হারিয়ে যাচ্ছে। কীসের এত সংকোচ আমার? আমি কি ওকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারি না- কেমন আছ, মিলা? একবার তোমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা বড় করতে গিয়ে গেইটের সাথে লাগানো হাসনাহেনা গাছটা কেটে ফেলেছিল বলে তোমার খুব মন খারাপ হয়েছিল- মনে আছে তোমার? আমি এখনো হাসনাহেনা চিনিনা, জানো? শুধু হাসনাহেনা কেন, জবা ফুল ছাড়া আর কি বা চিনি? তোমার খুব ইচ্ছা ছিল একবারের জন্য হলেও সিলেটে যাবে- জাফর ইকবাল স্যারকে দেখার জন্য। আমি এরপর কতবার একা একা সিলেটে গেছি, তুমি জানো? এরকম আরো কতো কতো গল্প জমিয়েছি আমি তোমাকে বলার জন্য, জানো তুমি, মিলা? মাঝে মধ্যে আমি অবিকল একটা মানুষের মত হয়ে যাই। আমার তখন ইচ্ছা করে একটা ছুরি কিনতে। মনে আছে, আমি বলেছিলাম তোমাকে একটা ছুরি উপহার দিব?
এরপর আবারো মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলে আবারো যেন একটা ধাক্কার মত লেগে আমি বর্তমানের এই সময়টায় ফিরে আসি।
আগেরবারের আক্ষেপ ঝরা কন্ঠে এখন সম্ভাব্য জয়ের উচ্ছ্বাস, যদিও আমাকে টানেনা, তবে বুঝতে পারি এর মধ্যে পেরিয়ে এসেছি অনেকটা পথ, পার করেছি অনেকটা সময়। বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখা ডিসেপশান পয়েন্ট তাই তুলে রাখি। এসময় কফিওয়ালাকে দেখে কফির তৃষ্ণা জেগে উঠে, ভাবি মিলার জন্যও কি নেয়া যেতো না এক কাপ কফি- একটা সময় ও প্রচুর কফি খেতো।
শুনো, মিলা, এত কফি খাইওনা।
কেন? কি সমস্যা?
এত কফি খাইলে তুমি কালো হয়ে যাবে।
আমি কালো হলে আপনার কী সমস্যা?
আমার আবার কী সমস্যা? সমস্যা তোমার। তোমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না।
ভালোই তো। আপনার তো তাহলে সুবিধা হয়।
মিলার চোখে-মুখে দুষ্টুমির চিহ্ন।
তাই না কি? আমার সুবিধা! তাহলে আরো একটা কফি দিতে বলি?
দুষ্টুমি খুব সংক্রামক।
এরপর সবসময়ের মত , না-হওয়া বৃষ্টি অথবা না-আসা ট্রেনের জন্য প্রতীক্ষাই হোক আর ক্ষোভই হোক যেমনভাবে শেষ হয়, তেমনভাবে এই সংক্রামক দুষ্টুমি অথবা অবিকল মানুষ হয়ে যাওয়ার অনুভব অথবা প্রেমের এই সব সস্তা গপ্পো, এখন এই ট্রেন ভ্রমণের মত শেষ হয়ে যায় অথবা শেষের কাছে আসতে থাকে। মধ্যরাত পেরিয়েছি সেই কখন, এখন রাত পৌনে দুইটা বাজে। ট্রেন থামলে আমি আবিষ্কার করি ওর সাথে আমার কথা না বলে উপায় নাই। টিকেট যে ওর কাছে- আমাদের এই স্টেশন থেকে একসাথেই বের হতে হবে।
পুরো কম্পার্টমেন্ট খালি হয়ে গেলেও ওরা তিনজন সাথে আমি যেন বিভ্রান্তের মত দাড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। তারপর সম্বিত ফিরে পেলে আমাকেই প্রথমে কথা বলতে হয়।
আমাদের মনে হয় নামা উচিৎ। টিকেট তো আপনার কাছে। আপনারা না নামলে আমি তাই নামতে পারছি না।
নিজের কথাতে নিজেই অবাক হই। কোন কালে আমি মিলাকে আপনি সম্বোধন করেছিলাম?
আমাদেরকে নিতে লোক আসার কথা।
এই ট্রেন পর্যন্ত আসবে? অপেক্ষা করবেন?
না, না। চলেন, নামি।
সুতরাং ওরা নেমে পড়ে, সাথে আমি।
ওদের তিনজন মানুষের ছয়টা ব্যাগ। একবার মনে হয় বলি- মিলা, আমি কি একটু হেল্প করবো? আমার অনেক সংকোচের আড়ালে হারিয়ে যায় এই কথাটাও।
আচ্ছা, নতুন স্টেশনটা এইদিকে না?
না, না। তোমার ভুল হচ্ছে।
আমি আবারো যে তুমি বলে ফেললাম সেদিকে খেয়াল না করেই উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করে ওরা তিনজন, সাথে ওদের ছয়টা ব্যাগ।
ওদের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে পড়ে যায় সন্ধ্যায় হয়ে যাওয়া অনেক প্রতীক্ষার সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টির কথা।
আমরা এত দেরিতে নামলাম-পুরা প্লাটফর্মই ফাঁকা!
ঐদিকে কই যান?
নতুন স্টেশন এইদিকে না?
না। উল্টাদিকে হাঁটেন আবার।
এইবার বুঝতে পারি, মিলাই ঠিক ছিল, আমার ভুল হয়ে গেছে। ততোক্ষণে মিলা অনেক সামনে চলে গেছে।
পেছন থেকে মিলাকে ডাকবো ডাকবো করে ডাকতে পারিনা, তাই একটু দৌড়েই ওর সামনে গিয়ে দাড়াই।
স্যরি, ভুল করে ফেলছি। নতুন স্টেশন আসলে উল্টাদিকে।
মিলা কেন জানি বিরক্ত হয় না। একটু খানি হেসে উঠে।
আমি জানি এইটা অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হাসি। ওর হাসিটা আমাকে আবারো মনে করিয়ে দেয় সন্ধ্যায় হয়ে যাওয়া অনেক প্রতীক্ষার সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টির কথা।
তারপর একটা সময় মিলা একটা গাড়িতে উঠে বসে। আমাকে দেখবে বলেই কি পেছনে আমার হাঁটাপথের দিকে তাকিয়ে থাকে? ওর দিকে তাকাবো না ভাবতে ভাবতে ওদের গাড়িকে পেছনে ফেলে আমি হাঁটতে থাকি। এরপর ওদের গাড়িটাও আমাকে পেছনে ফেলে গেলে আমি দেখি মিলা পেছনের দিকেই তাকিয়ে আছে।
তারপর যেমনটা হওয়ার কথা, আমার মাথাটা আরো একবার চক্কর দিয়ে ওঠে। তারপর এই নিয়ন আলোয় ধোঁয়া পথ, সামনের গাড়িটা, গাড়ির ভিতর বসে থাকা তরুনী-এই সব পরাবাস্তব উপকরণ আমাকে ভেঙ্গে ফেলতে থাকলে- সন্ধ্যার সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতোন না, বরং অন্য রকম একটা বৃষ্টি, একটা নোনতা স্বাদ আমার গলার কাছে এসে আটকে যায়। তারও অনেক পর রাত একটু একটু করে মধ্যরাতের অনেক গভীরে তলিয়ে যেতে থাকলে একা নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে আমার ভিতরে একটা গান সুর হয়ে বাজতে শুরু করে-~~যা কিছু ছিল থেমে থাকা আবার থামবে এই বিদায়ে/ আমার অপার সীমানাতে তোমার চিহ্ন তবু বেঁচে~~।
উৎসর্গঃ ডানা-কে। মেয়েটা আমার মত অলস ছেলেকে দিয়ে গল্পটা সে শেষ করিয়ে নিল!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।