সাইফ শাহজাহান শুভ মাহমুদ
সময়টা ঠিক স্মরণে আসছে না। যতদূর মনে পড়ে খুব সম্ভবত ’৮৭-৮৮ সাল। সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কাল পর্বে। তোপখানা রোডের ওয়ার্কার্স পার্টি অফিসে গিয়েছি, ছাত্র সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলাম বললেন, চলুন এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি। শুধুশুধি অনাহূতের মত কোথাও কারও সঙ্গে ঝুলে পড়ে গিয়ে হাজির হওয়া আমার স্বভাববিরুদ্ধ।
স্বাভাবিকভাবে তাই তার প্রস্তাবে রাজি হই না- আপত্তি ওঠাই। কেন জানি না আমি শহীদুল ইসলামকে খুবই পছন্দ করি এবং আমার ধারণা আমার সম্পর্কে তারও একই অনুভব। ফলে শেষ পর্যন্ত আপত্তিটা হালে পানি পায় নাÑ আমরা রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করতে করতেই তোপখানা রোডের ফুটপাত ধরে প্রেসক্লাবের দিকে হাঁটতে থাকি। বেশি দূর যেতে হয় নাÑ মাত্র কয়েকটি বিল্ডিং পেরিয়েই একটা রুমের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েন শহীদুল ইসলাম, আমিও তার পেছনে পেছনে। একটা লোহার ক্যাম্প খাট পাতা ঘরের ভেতর।
তাতে শুয়ে ছিলেন আহমদ ছফা। সাদরে আহ্বান করেন শহীদুল ইসলামকে- একই সঙ্গে অপরিচিত আমাকেও। আহমদ ছফা এত কাছে থাকেন, একেবারে যাকে বলে হাতের নাগালে ধরা-ছোঁয়ার ভেতরে, সেটা আমাকে যুগপৎ বিস্মিত করে।
আমার গায়ে তখনও মফস্বলের যাবতীয় রোমান্টিকতা। যাবতীয় জিজ্ঞাসা-কৌতূহল।
আমি আমার অভিজ্ঞতায় এক অন্যরকম বুদ্ধিজীবীকে আবিষ্কার করি, যার মুখে ঝুলে নেই কপট পাণ্ডিত্যের মুখোশ- যাকে দেখে ভয়ে জড়সড় বোধ জাগে না- যার সামনে রুদ্ধপ্রাণে মেপে মেপে কথা বলতে হয় না- সর্বান্তকরণে যাকে নির্দ্বিধায় আপন বলে মনে হয়, মনে হয় তিনি আমাদেরই লোক। একান্ত আপনজন। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। এ রকম হঠাৎ করে কথা নেই বার্তা নেই এমনকি এখানে যে আসবেন সে কথাটা পর্যন্ত শহীদুল ইসলাম আমাকে বলেননি। শহীদুল ইসলামকে ছফা ভাই খুঁজছিলেন।
তারা তাদের প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সারলেন, তারই ভেতর ছফা ভাই কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গেও। মনে আছে আমি তাঁকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর অনূদিত গ্যেটের ফাউস্ট প্রসঙ্গে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফাউস্টের পরবর্তী খণ্ড তিনি অনুবাদ শুরু করেছেন কি-না। ছফা ভাই সেদিন জবাব দিয়েছিলেন, প্রথম খণ্ডটির পেছনেই তাঁর জীবনের দশটি বছর ব্যয় হয়েছে, তাই পরবর্তীটির অনুবাদের জন্য সময় লাগবে। এই উত্তরটিও আমাকে বিস্মিত করেছিল।
ছফা ভাইয়ের ওই জবাবটির ভেতর দিয়ে আমি একটা জিনিস খুব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলাম সেটা হচ্ছে আক্ষরিক অনুবাদ এবং সৃজনশীল অনুবাদের ভেতর রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব।
তখন তোপখানা রোডের সেই অপরিসর রুমটি এবং ওই ক্যাম্প খাটটিই ছিল আহমদ ছফার আস্তানা। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে জড়িত। পত্রিকাটি সে সময় বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ জনপ্রিয়ও। সম্ভবত সেদিন তিনি আমাদেরকে তাঁর প্রিয় র’ চা দিযে আপ্যায়িত করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা তার বিড়ম্বনা বাড়াতে চাইনি।
আহমদ ছফা- তাকে কিভাবে শ্রদ্ধা জানাব! এই লোকায়ত বুদ্ধিজীবী, সমাজের শেকড়ে পেতে রেখেছিলেন নিজের আত্মা-মনন-চৈতন্যকে। এদেশের বিভিন্ন কালপর্বের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়, তাঁর কাজে। বুদ্ধিবৃত্তিক শঠতা, ভণ্ডামি, পরশ্রীকাতরতাকে যেমন তিনি নির্মমভাবে তুলে ধরেছেন, তেমনই ধিক্কার দিয়েছেন ভীরু-কাপুরুষদের, চাবকে দিতে দ্বিধায় ভোগেননি- তার কলম ঝলসে উঠেছে নষ্টদের বিরুদ্ধ্ েআবার সাংঘাতিক ভালবাসা আর পরম মমতায় স্বাগত জানিয়েছেন তরুণতম ঔপন্যাসিক ও গল্পকারদের। আহমদ ছফার মত অকপট সরলতায় তারুণ্যকে স্বাগত জানাবার মত সৎসাহস এদেশের আর কোনও বুদ্ধিজীবীর ভেতর দেখা যায় না।
শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির বিবর নিবাসী ছিলেন না তিনি।
তিনি ছিলেন একজন সম্পন্ন মানুষ- সাধারণ অতিসাধারণ মানুষ। মূলত তিনি মানুষ হতেই চেয়েছিলেন, পরগাছা বুদ্ধিজীবী হতে নয়। ত্রিকালদর্শী এই লেখক বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই এ সত্য উচ্চারণ করেছিলেন যে, এদেশের বুদ্ধিজীবীরা যা বলেছে তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না এবং আজ যা বলছে তা শুনলে এদেশের সমাজও পরিবর্তিত হবে না- সেই কথাগুলো আজ স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের গায়ে জ্বলন্ত আগুনের আঁচের মত দগ্ধ করছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাদের আত্ম বিক্রি করে বসে আছেন- তাদের ঊর্ধ্বে আরোহণ যে আসলে ঊধর্ব-পতন সে বোধটুকুও তাদের লোপ পেয়েছে। বিভিন্ন কোট ও কুর্তা, আঁচল ও গিলাফ তাদের চাটুকার কীট অস্তিত্বের আশ্রয়।
আহমদ ছফা এই ক্লীব কীটদের ভিড় থেকে অনেক দূরে ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতিত জমিতে সব্জি চাষ করেছেন, অবহেলিত পথশিশুদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন পাঠশালা, গরিব মেয়েদের জন্য সেলাই স্কুল খুলেছেন, পুষেছেন পাখি। যান্ত্রিক এই নগরীর ছাদের টবে ফুটিয়েছেন ফুল- এসবের ভেতরেই একজন প্রাণবান চিরতরুণকে খুঁজে পাই। যিনি পরজীবী পরগাছা বুদ্ধিজীবী নন।
‘পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ’ বইটি আমাকে পড়তে দেন ক্যান্সার আক্রান্ত তরুণ কবি কমল মমিন।
আমরা তার (কমল মমিনের) গদ্যের বই ‘আমাকেও মনে রেখো’ প্রকাশনার চেষ্টা করছি তখন। উদ্যোগ নিয়েছেন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। অনেকেই আমাদের সে উদ্যোগে সানন্দে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছে। কবি, সাংবাদিক সোহরাব হাসান কমল মমিনের পাণ্ডুলিপি কম্পিউটার কম্পোজের জন্য প্রেসে দিয়ে দিয়েছেন, এদিকে গল্পকার আনিস রহমান, গল্পকার মনিরা কায়েস এবং আমি অন্যান্য কাজে ব্যাপৃত। ঠিক এ সময় কলকাতা থেকে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কবি আবু হাসান শাহরিয়ারকে ই-মেইল করে জানালে তিনি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কুবেরের বিষয়-আশায়’-এর বাংলাদেশ সংস্করণের রয়্যালিটির টাকা চিকিৎসার্থে কবি কমল মমিনকে দিতে চান।
আমরা সাংঘাতিক উদ্দীপ্ত হলাম এই বার্তায়। একজন প্রবীণ প্রতিষ্ঠিত লেখক একজন তরুণ অনুজ লেখকের জন্য কি অসাধারণ কাজ করতে পারেন সেটা আমরা উপলব্ধি করলাম। শ্যামলদা’র ওই ঘোষণা বোধ হয় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ ‘কুবেরের বিষয়-আশয়’ একটি বিপুলায়ন উপন্যাস। বাংলাদেশের নানান ধান্ধার প্রকাশকরা, যারা থান ইটের মত কলাম গ্রন্থ বের করে মন্ত্রণালয়ের টাকা লুটপাট করার কাজে বিপুল উদ্যমে নিমগ্ন, তারা একজন ক্যান্সার আক্রান্ত তরুণ কবির কথা ভাববেনÑ তার অবসর কোথায়। আর তারা যেখানে বিনা অনুমতিতে তস্করবৃত্তি করে পশ্চিম বাংলার লেখকদের বইপত্র ছাপতেই অভ্যস্ত, সেখানে শ্যামলদার দৃষ্টান্তহীন সদিচ্ছাটি যে উপেক্ষিত থাকবে তাতে আর অবাক হবার কি আছে।
সেই দরোজাটিতেও করাঘাত করেছেন ছফা ভাই। বাংলাদেশে আহমদ ছফা একমাত্র লেখক যিনি তাঁর একটি বইয়ের রয়্যালিটির অর্থ অনুজপ্রতিম লেখক কবি কমল মমিনকে প্রদান করেছেন। সেই অর্থের পরিমাণ হয়তো সামান্যই কিন্তু অসামান্য তার এই ভালবাস।
আহমদ ছফা জন্মেছিলেন তাঁর বুকের ভেতর মানুষের জন্য অপরিসীম ভালবাসা নিয়ে। একটি লাঞ্ছিত বেগুন গাছের চারা প্রাণ ফিরে পেয়েছে তাঁর শুশ্রƒষায়।
প্রায় খুন হয়ে যাওয়া একটি মুমূর্ষু তুলসী গাছকে বাঁচিয়ে তোলেন পরম যতœ-সেবা দিয়ে। তাঁর ‘পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণে’ এসব সাধারণ ঘটনা পড়ি আর মুগ্ধ হয়ে যাই। এ রকম অসাধারণ বইও বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেলেন ছফা ভাই। সমাজ পবির্তনের স্বপ্ন। বিপ্লবের স্বপ্ন কখনও তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি।
মাত্র কিছু দিন আগে তাঁর সম্পাদনায় বেরিয়েছে একটি অনিয়মিত পত্রিকা ‘উত্থানপর্ব’। এই নৈরাজ্যপীড়িত সমাজে, যখন বুর্জোয়ারা নিজেরাই নিজেদের মাংসে আহার সারছে ; সাধারণ মানুষ অপুষ্টি, অনাহার, দারিদ্র্য, বোমায় তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর খড়কুটোরও অধমে পরিণত- তখনও বিপ্লবের কবি, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফা অবিচল আস্থা রাখেন মানুষের উত্থানে। মানবিকতার উত্থানে। তাই তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার নাম রাখেন উত্থানপর্ব।
আহমদ ছফার মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির মুত্যু।
এই নিষ্পত্র নি®প্রাণ স্বজনহীন নগরে মানুষের প্রতি ভালবাসাকে যুদ্ধজয়ের একমাত্র আয়ুধ বলে আমাদের ভেতর আর আস্থা জাগাবেন কে?
খোলা জানালা দৈনিক মুক্তকণ্ঠ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।