আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলার লোকায়ত ধর্ম: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধীতা করে অস্টাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় লোকায়ত ধর্ম গড়ে উঠেছিল। এসব লোকায়ত ধর্ম উপধর্ম বা গৌণ সম্প্রদায় নামেও পরিচিত; ইংরেজিতে এইসব লোকায়ত ধর্মকে বলা হয় ‘মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস’। কারও মতে আবার ‘উপাসক সম্প্রদায়’।

এসব লোকায়ত ধর্মের নামগুলি বেশ বিচিত্র ধরণের এবং বেশ রোমাঞ্চকর। যেমন: বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনী পন্থী, সহজিয়া, খুশিবিশ্বাসী, রাধাশ্যামী, রামসাধনায়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, হযরতী, মীরাবাঈ, কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী ইত্যাদি। এসব লোকধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের সমন্বয়। এ কারণেই বাংলায় গড়ে ওঠা লোকধর্মের অধিকাংশ প্রবর্তকই একজন মুসলমান অথবা হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে। যেমন সাহেবধনী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক একজন মুসলমান উদাসীন হলেও এ ধর্মের প্রধান সংগঠক চরণ পাল ছিলেন জাতে গোয়ালা।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউলচাঁদ ছিলেন সুফিমতে বিশ্বাসী, অথচ তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন রামশরণ পাল। এইসব লোকধর্মের অনুসারীদের কারও নাম হতে পারে শিবশেখর, পিতা যদুলাল অথচ জাতে মুসলমান। এসব লোকায়ত ধর্মের অনুসারীদের অনেকেই ছিলেন নিরামিষভোজী মুসলমান। বাংলা লোকধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিশ্বাসের (ফেইথ) ভূমিকাই প্রধান। যেমন, প্রশ্ন করা হয়- আউলচাঁদ কে? উত্তরে বলা হল: আউলচাঁদ গোরাচাঁদের অবতার।

শ্রীক্ষেত্রে গোপনাথের মন্দিরে গোরাচাঁদ হারিয়ে যান। তারপরে আউলচাঁদের রূপ নিয়ে ঘোষপাড়ায় তাঁর উদয়! বাংলার লোকধর্মের মধ্যে অন্যতম হল বাউলধর্ম। বাউলধর্মের উদ্ভবের পিছনে প্রধানত ইসলামি সুফিবাদের গভীর প্রভাব ছিল। অবশ্য ইসলামি সুফিবাদ ছাড়াও বাংলার লোকধর্মের উদ্ভবের পিছনে আরও দুটি প্রভাব বিবেচনা করা হয়। শোষিত অন্তজ্য শ্রেণির ব্রাহ্মণ্য বিরোধীতা এবং লোকায়ত বৈষ্ণব ধর্মের উদার আহ্বান।

ষোড়শ শতকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচৈতন্যদেব বাংলার সমাজজীবনে গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। তৎকালীন সময়ে অন্ত্যজ মানুষের ওপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচার রোধ করতে তিনি এক উদার সমন্বয়বাদী বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেন। সেই ধর্মের সাধনা ছিল অত্যন্ত সহজ । ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করেছিল। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্যদেব মৃত্যুবরণ করার পর অবশ্য গৌড়ীয় বৈষ্ণবমঠ শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়।

বৈষ্ণব ধর্মটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যায়। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা সংস্কৃতে শাস্ত্রগ্রন্থ লিখে চৈতন্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। চৈতন্যদেবের শিক্ষা এবং সাধারণ মানুষের রক্ষার দিকটি হল পরিত্যক্ত । নি¤œবর্ণেরা সাধারণ মানুষ এতে করে তাদের ধর্মসাধনায় দিকভ্রান্ত হল। (ফরহাদ মজহার তাঁর ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘ভাবান্দোলন’ গ্রন্থের উৎসর্গ-পত্রে লিখেছেন ...উপমহাদেশের জাত-পাত-শ্রেণী-নারী-পুরুষভেদ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান পূর্বসুরি দয়াল নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর শ্রীচরণে) দয়াল নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম একজন শিষ্য।

নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্র। বীরচন্দ্র এই ধর্মীয় সংকটকালে এগিয়ে এলেন। তিনি বৌদ্ধ সহজিয়া তান্ত্রিক এবং শিক্ষাবঞ্চিত মানুষদের বৈষ্ণবমতে ফিরিয়ে আনলেন। কাজেই বৈষ্ণবধর্মে যুক্ত হল নানান লৌকিক গুহ্য সাধনা এবং মন্ত্রবীজতন্ত্র । গুপ্তবিদ্যায় আচ্ছন্ন হয়ে উদ্ভব হল বৈষ্ণব সহজিয়া মতের ।

বাংলার গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল আখড়া এবং সাধনকুঠির। আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’ বইতে লিখেছেন, ‘বিভিন্ন পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে এসে চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পর বাউলধর্ম তার নিজস্ব রূপ পরিগ্রহ করে। ’ ( পৃষ্ঠা; ৩৭) বৈষ্ণব সহজিয়ারা বীরচন্দ্র কে দেখলেন শ্রীচৈতন্যদেবের অবতাররূপে। কিছুকাল পরে বলা হল যে -কৃষ্ণের অবতার গৌরাঙ্গ (শ্রীচৈতন্যদেব) এবং গৌরাঙ্গের অবতার বীরচন্দ্র। এই সূত্র অবলম্বন করে পরবর্তীতে কর্তাভজারা ঘোষণা করল: কৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্র আউলচন্দ্র / তিনেই এক একেই তিন।

অর্থাৎ বীরচন্দ্রের বদলে প্রধান হয়ে উঠলেন আউলচাঁদ। এভাবে উদ্ভব হল বৈষ্ণববিশ্বাসী নতুন এক লোকসম্প্রদায়ের । এরপর বাংলার লৌকিক ধর্মসাধনার তীব্রগতিতের এগিয়ে যেতে থাকে। তবে উনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম সংস্কার আন্দোলন, মিশনারীদের প্রচার, ব্রাহ্মধর্মের উত্থান এবং শ্রীরামকৃষ্ণর জীবনসাধনা বাংলার লোকায়ত ধর্মের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এসব উপধর্ম বা গৌণ সম্প্রদায়ের ঠাঁই হয় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে।

তবে লৌকিক উপধর্ম আজও টিকে আছে। সভ্যতা -রাজনীতি-বিজ্ঞান-শাস্ত্র-নিপীড়ন একে আজও মারতে পারে নি। দুই বাংলায় বাউল এবং লোকগানের জনপ্রিয়তা এই সত্যকেই প্রমাণ করে। সেই যাই হোক। বাংলার লৌকিক ধর্মসাধনার দুটি রূপ রয়েছে।

(ক) অনুমান এবং (খ) বর্তমান। রাধা-কৃষ্ণ-বৃন্দাবন-মথুরা -কংস এসব কল্পনায় অনুমান করে যে সাধনা তাকে বলে অনুমানের সাধনা। আর বর্তমানের সাধনা হল মানবদেহ নিয়ে। এ মতের অনুসারীরা মনে করেন দেহেই আছে বৃন্দাবন। তারা আরও বিশ্বাস করেন যে, দীক্ষা নিয়ে গুরুর নির্দেশিত পথ দেহতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে যুগলভজনের যে ঐশী উপলব্দি সেটিই সঠিক পথ।

তারা বলেন, মানুষ কাছে পিঠে নড়ে চড়ে কিন্তু খুঁজলে জনমভর মেলে না। দুই ভুরুর মাঝখানে যে সূক্ষ্ম জায়গা তাকে বলে আরশিনগর। সেইখানে পড়শী বসত করে। পড়শী মানে মনের মানুষ। আরশি ধরলে পড়শী আর পড়শী ধরলে আরশি ...কাজেই আরশিনগরে পৌঁছতে হলে মানুষকে এড়িয়ে গেলে চলবে না।

বাংলার লোকায়ত ধর্মের নারীকেন্দ্রিকতা এর আরেকটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আউলচাঁদের বাইশজন শিষ্য ছিলেন। এঁদের মধ্যে রামশরণ পাল ছিলেন প্রধান। তাঁর স্ত্রীর নাম সরস্বতী। সেই সরস্বতী থেকে সতী।

কর্তাভজারা সতীমার ঘর বলে পরিচয় দেয়। গর্ব বোধ করে। বাংলার লৌকিক ধর্ম প্রতীকবহুল। সেই সব প্রতীকেও আমরা নারীকে পাই। যেমন, অমাবস্যা হল নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনি।

অনেক লোকায়ত ধর্মবিশ্বাসী মনে করেন নারীদেহই সত্য। নারীই সব চেয়ে বড় গুরু। নারীর কাছে ইঙ্গিত নিয়ে তার সাহায্যে তবে সাঁতার দিতে হবে। (মহমতি বুদ্ধ ধ্যান শেষে সুজাতা নামে এক নারীর হাতে অন্ন গ্রহন করেছিলেন: ইসলামের নবী তাঁর নবুওত প্রাপ্তির সংবাদ প্রথম বিবি খাদিজার কাছে বলেছিলেন; লালনও তাঁর নবজীবনে রাবেয়া নামে এক তন্তুবায়শ্রেণির নারী কাছে আশ্রয় পেয়েছিলেন) ... লোকায়ত পন্থীরা বিশ্বাস করে- নারী শরীরের বাঁকে মানে দশমীদ্বারে লুকিয়ে আছে মহারত্ন। আগলা স্রোতে ডুবে না গিয়ে ডুবতে হবে তলাতল অতল পাতালে।

মামুন নদীয়ার একটি গানে রয়েছে- নারীর ওই সিন্ধুমাঝে/ভানুর এক কিরণসাজে/ তাহার মধ্যে প্রেমের বাঁচারে/ মামুন নদীয়া বলে/ চল সখি গভীর জলে/ শুদ্ধপ্রেম কেনাবেচা করি লো কিশোরী। যা হোক। বলছিলাম যে- আগলা স্রোতে ডুবে না গিয়ে ডুবতে হবে তলাতল অতল পাতালে। তবে মিলবে রত্নধন। সেই বাঁকে মাসে মাসে বন্যা আসে।

তাকে বলে গভীর অন্ধকার অমাবস্যা। নারীর ঋতুকাল। সেই বাঁকা নদীর বন্যায় মহাযোগে ভেসে আসে মহানীম অধরমানুষ। তাকে ধরতে হবে। তার সঙ্গে মিলনে অটল হতে হবে।

তাকেই বলে গুরুপ্রাপ্তি। বাংলার লোকায়ত ধর্মের উদ্ভব এবং স্বরূপ এভাবে বৈচিত্রপূর্ন । তবে এর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বাধীন ধর্মীয় মতের চর্চা আমাদের আকর্ষন করে। এ প্রসঙ্গে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘কল্যাণীর রামশরণ পাল, কুষ্টিয়ার লালন শাহ, হুদোর চরণ পাল, ভাগা গ্রামের খুশি বিশ্বাস, মেহেরপুরের বলরাম হাড়ি এঁরা সকলেই উচ্চবর্ণের ভ্রুকুটির বাইরে সাধারণ ব্রাত্যজনের বাঁচবার জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। নিছক প্রতিবাদ নয়, টিকে থাকারও।

সংকীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে বাঁচা নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা। তাই মুর্তিপূজা, অপদেবতা পুজা, অকারণ তীর্থভ্রমন, দেবদ্বিজে বিশ্বাস, শাস্ত্র নির্ভরতা ও আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে এঁদের অস্ত্র ছিল জাতিভেদহীন সমন্বয় এবং নতুন মানবতাবাদী সহজ ধর্মাচরণ। ’ (গভীর নির্জন পথে। পৃষ্ঠা, ৪১) তথ্যসূত্র আবুল আহসান চৌধুরী; লালন সাঁইয়ের সন্ধানে। সুধীর চক্রবর্তী; গভীর নির্জন পথে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.