শরীরে শরীর নয়, ঠোঁটে ঠোঁট রাখাও নয়, মূহুর্তের ছোঁয়াও নয়, একটু দেখাতেই লিটার খানেক অগ্নিজলের ঘোর। ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরে আড়াই লক্ষ মৃত শিশুদের একজনঃ
১২ই নভেম্বরের রাত্রি
সে দিনটির কথা আমার মনে আছে স্পষ্ট।
আমি ছিলাম চিটাগাংএ। সপ্তম শ্রেনীতে পড়ি। আবাসিক স্কুলে পড়তাম।
১ কিমি সামনে সমুদ্র, ২০০ গজ পেছনে পাহাড়। সেদিন সকাল থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যায় শুরু হয় সাইক্লোন। আমরা দোতলায় থাকতাম। ৮ জন এক ঘরে।
এমন বাতাস আর ঝড়ের তান্ডব যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অবিরাম বজ্রপাত, বারান্দায় সামুদ্রিক পাখির স্তুপ। সারারাত সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে (আর এক সতীর্থ সারারাত আজান দিয়ে) রাত পার করি। ভোরে পেছনের জানলা দিয়ে দেখি অভূতপূর্ব দৃশ্য। পেছনের পাহাড় আগে ছিল ঘন জংগলে ঢাকা- সে পাহাড়ে তো কোন গাছই নেই, এমনকি কোন ঘাসও নেই, সবুজ গাছ গাছালীতে ঢাকা পাহাড় এখন মুড়ানো খয়েরী রংএর টিলা।
হোস্টেলের বেয়ারা কিছুক্ষন পর ডাকলো পাখী দেখতে, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। শামুক খচা (ভাংগা), কাঞ্চি চোরা, ওয়াক, স্নাইপ, গাংচিল, বক আরো অচেনা অনেক প্রজাতির পাখি। বড় সাইজের চার বালতিতেও কুলায় নাই, বারান্দার একপাশে জড়ো করা আছে বাকিগুলো। পাখিগুলো সমুদ্রের দিক থেকে এসে আছড়ে পড়ে মরছিল হোস্টেলের সাথে বাড়ি খেয়ে খেয়ে সারারাত ধরে।
জলচ্ছ্বাস নিহত ছোট্ট একটি মেয়ের মৃতদেহ সৎকারের চেষ্টা
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর আমাদের শীতের ছুটি হয়।
ছুটিতে বাবার শিকারের সংগী হয়ে একদিন শিকার কুড়োতে কুড়োতে উত্তর পতেংগা থেকে হালি শহর সৈকতে আসি। তখন সন্ধ্যা প্রায়। বীচ থেকে (তখন মাটির বাঁধ আর ম্যাংগ্রোভ ছিলনা) একসারি নারিকেল গাছ আমাদেরকে গ্রামের ভেতর দিয়ে সোজা সমুদ্র পাড় থেকে রাস্তায় নিয়ে আসতো (আমরা নাম দিয়েছিলাম তাহিতি)। বাবা উত্তর পতেংগায় নেমে গাড়িটিকে হালিশহরে পাঠিয়ে দিতেন। যেখানে বীচ শেষ এবং গ্রাম শুরু হ'তে যাচ্ছে ঠিক সেখানেই একটা ঝোপের মধ্যে কমলা রংয়ের কিছু একটা দেখে এগিয়ে যাই আমি।
তিন চার বছরের একটা মেয়ে শিশুর মৃতদেহ -সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসা ঘুর্ণিঝড়ের সংহার। বেশ কিছুদিন গত হয়েছে। কিন্তু তাতে না পচঁন ধরেছে না মুখটা একটুও বিকৃত হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল শিশুটি পুতুল খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবা অনেক চেষ্টা করলেন সৎকারের।
গ্রামের লোকদের অসহযোগিতায় তা আর সম্ভব হয়নি। তারা এক পর্যায়ে বলা শুরু করলো "শহরোত্তুন মাঁরি আনি খবর দিত ছায়" (শহর থেকে বাচ্চাটাকে মেরে এনে এই নির্জন জায়গায় কবর দিতে চাচ্ছে)।
সৈকতে অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের লাশ ভেসে আসতো।
______________________________________________
১২ই নভেম্বর'৭০এর প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড়ের চোখ
১২ নভেম্বর ঘুর্নিঝড়ের গতিপথ
আজ থেকে ঠিক ৪১ বছর আগের এইদিনে পৃথিবীর লিপিবদ্ধ ইতিহাসের ভয়াবহতম জলোচ্ছ্বাস আমাদের উপকুলে আছড়ে পরে।
এটা আরো ছিল বিশ্বের সবচে' প্রাণ সংহারী তিনটি প্রাকৃতিক দূর্যোগের একটি।
এক রাতের মধ্যে পাঁচ লক্ষ মানুষ (অনেক উপাত্তে দশ লক্ষ) নিহত হয় । সবচে' ক্ষতিগ্রস্থ হয় ভোলা। তজুমুদ্দিন থানার ৪৬.৩ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এলাকার ৮৫ শতাংশ ঘর বাড়ি, উপকূলের ৬৫ শতাংশ মাছ ধরার ক্ষমতা (fishing capabilities) ধ্বংস হয়, ৭৭ হাজার জেলে যারা ডাংগায় ছিল তখন তাদের মধ্যে ৪৬ হাজার নিহত হয়, ৩৬ লক্ষ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই দূর্যোগে।
পাঁচ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুই ছিল আড়াই লক্ষের বেশী।
২ লক্ষ ৮০ হাজার গবাদিপশু মারা পড়ে এই দূর্যোগে।
অনেক রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার একটি নিয়ামক ছিল এই জলোচ্ছ্বাস । দূর্যোগ ব্যাবস্থাপনা ও দূর্যোগ উত্তর ত্রাণে সীমাহীন ব্যার্থতা সাধারন বাংগালীদের মনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাষন যন্ত্রের প্রতি পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে।
ত্রিশে নভেম্বর, ১৯৭০, ভোলায় ক্ষুধার্ত শিশুরা খাবারের আশায় বসে আছে।
১৯৭১ এর জর্জ হ্যারিসন-বব ডেলেন আয়োজিত বাংলাদেশ কন্সার্টের একটা কারনও ছিল এই জলচ্ছাস।
ঘুর্নিঝড়ের পর গুটি বসন্তের টিকা
দেয়া হচ্ছে। এ প্রজন্মের কারো সাথে এই
বিভিষিকাময় মহামারীর পরিচয় নেই।
তোর কপালের সিঁদুরে টিপ মুছিয়ে দিল ঝড়
________________________________________________
ওপরের স্মৃতি চারনের দুটি অংশ আমি ২০০৯ এবং ২০১০ এ এই ব্লগে করেছিলামঃ
ঊনসত্তুর থেকে পচাঁত্তুর, পর্ব-১
১৯৭০এর ১২ই নভেম্বর
উপাত্তগূলো এবার যোগ করলাম।
সূত্রঃ
The 10 deadliest storms in history
PAKISTAN: Top 10 natural disasters since 1935
NaturalDisaster.us
10 Biggest, Deadliest, Most Destructive Hurricane's EVER!!
10 The biggest disaster with most victims.
Category:Bangladesh Cyclones
1970 Bhola cyclone ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।