আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া...নস্টালজিকের ভ্রমণ ডায়েরি!

মুন রিভার ... আমাদের একটা কাগজের ব্যাংক ছিলো। মাস শেষে দুজন মিলে টাকা জমাতাম। এই সেদিন ধুপ করে ব্যাংক লুট করে ফেললাম। আমার অনেকদিনের শখ একটা ব্যাংক লুট করবো। গায়ের জোরে না, বুদ্ধি খাটিয়ে।

পরিচিত কোনো ছোটো ভাই বা আপু হয়তো নতুন জয়েন করেছে কোনো ব্যাংকে, ফেসবুকে এই কথা সেই কথার পরেই আমি শুরু করে দেই- 'তুমি কোন ব্যাংকে আছো?' 'ভাইয়া, আমি অমুক ব্যাংকে' 'গুড। আমার অনেকদিনের শখ একটা ব্যাংক লুট করবো। তুমি অমুক ব্যাংকে থাকাতে ভালো হয়েছে। তোমার ব্যাংক দিয়েই শুরু করবো ভাবছি। ' 'ভাইয়া, আজকে আমি উঠি।

' সঙ্গত কারণেই এই ধরণের অর্বাচীন বাক্যালাপের পরে অধিকাংশ ব্যাংকার ছোটো ভাই-ব্রাদারকে আর খুঁজে পাইনা। তো যা বলছিলাম, জুন এর শেষে প্ল্যান করলাম কাগজের ব্যাংক ভেঙ্গে বেড়িয়ে পড়বো। অনেকদিন ধুপ-ধাপ বেড়িয়ে পড়ি না। এডভার্টাইজিং এজেন্সির কাজটাও উপভোগ করছিলাম না। দুম করে চাকরি ছেড়ে দিলাম।

মিশু দুম করে ছুটি বাগিয়ে ফেললো। আমি কুড়মুড় শব্দে কাগজের ব্যাংক ছিড়ে ফেললাম। তারপর দুইজন ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ... নির্জন যমুনার তলে, বসে আছি রিসোর্ট তলে... ঢাকা থেকে এক দুপুরে যাত্রা শুরু আমাদের। তখনও ডিসাইড করিনি যাচ্ছি কোথায়। একবার ভাবলাম যাই চলে বগুড়ায়।

মৌলি (ব্লগার দুরদ্বীপবাসিনী) অনেকদিন ধরে আমাদের বগুড়ার দই এর নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসছিলো, চমকে দিয়ে আসি ওকে। পরে বোহেমিয়ান যাত্রার অলিখিত শর্ত অনুযায়ী নেমে পড়লাম যমুনা ব্রিজ-র টাঙ্গাইল সীমানায়। ঢুকে পড়লাম যমুনা রিসোর্ট-এ। অনেক দিন পর ঢাকা থেকে বের হয়ে দুজনেই খানিক উত্তেজিত। তবে যমুনা রিসোর্ট আমাদের উত্তেজনার পালে খুব যে হাওয়া দিলো তা নয়।

আরামদায়ক রুমে চেক ইন করে সুইমিং পুলে খানিক অনভ্যস্ত সন্তরণে একটু করে ভালো লাগা তৈরি হচ্ছিলো, কিন্তু খরুচে বিল-টিল, ভিতরেই আর্মির কমান্ডারদের বাংলো আর খেতে গিয়ে প্রায় ফতুর হয়ে আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কাষ্ট হাসি হাসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বরং ... এর আগে ঘুরে এলাম রিসোর্ট এর পিকনিক স্পট। পিকনিক স্পট -টা সুন্দর। আমরা যখন ঢুকি, শেষ সময়ে কেউ নেই। লম্বা পথ হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম নদীর কাছাকাছি রিসোর্ট এর শেষ সীমানায়। তারপর গান গেয়ে ফিরে আসা রিসোর্টে।

মন্দ লাগছিলো না। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় মিস হয়ে গেলো স্পিড বোর্ড-এ যমুনা নদী ভ্রমণ। তবে সবকিছুতে আনন্দ এনে দিলো একটা কথা বলা ময়না পাখি... রিসোর্ট এর রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগে একটা মিনি প্যাক চিড়িয়াখানা চোখে পড়ে। ময়না, বানর, ময়ুর, খরগোশ, গুইসাপ, পাখি(রিসোর্টের একটা জিনিষ না বললেই নয়। এরা বিভিন্ন গাছে পাখির জন্য বাসা বানিয়ে রেখে দিয়েছে।

দেখতে খুব মজা লাগে), অজস্র কবুতর...মন ভালো হয়ে যায়। ময়নার সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ নিজের নাম বলে বলে যখন ময়নার নিরবতায় হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম, তখন ময়না মৌনিব্রত ভেঙ্গে কথা বলা শুরু করলো। সেই অনুভূতিটা ছিলো দারুণ। একদম পুরুষালী গলায় ময়না কথা বলে জাস্ট চমকে দিলো আমাকে। এর পরেও ময়নার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

মিশু এদিক সেদিন ঘুড়ে বেড়ায়, ক্লিক ক্লিক করে ছবি তোলে আর আমি কথা বলা ময়নার সাথে বন্ধুতা করি। আমি- 'বলো রানা' ময়না- 'ময়না' আমি-'বলো রানা' ময়না-'অ্যা!' একটু পর ময়না বলে উঠে-'শীষ দাও, শীষ দাও। ' বলে নিজেই তারস্বরে শীষ বাজাতে শুরু করে দেয়। পরদিন চেক আউট করে ফিরে আসার আগ দিয়েও আমি অনেকক্ষণ ময়নাকে আমার নাম বলে এসেছি। আমার ধারণা এরপর কেউ ময়নার সামনে গিয়ে চমকে যাবেন।

কারণ ময়না বলে উঠবে-'রানা, রানা। আমার বন্ধু...' কিভাবে যাবেন- উত্তরবঙ্গের যে কোনো বাসে উঠে পড়ুন। আমরা গিয়েছিলাম শ্যামলীতে। এমনিতে ভাড়া ৩৫০ এর মত টুওয়ার্ডস পাবনা। ব্রিজের কথা বলে টিকেট কাটলে ১০০ এর মত কমে যায়।

হিট- কথা বলা ময়না পাখি। আমার বন্ধু... চারপাশে নদীর হাওয়া...পিকনিক স্পটের সবুজতা। রিসোর্টের রেস্টুরেন্ট-এ রাতের খাবারের সময় হারমোনিয়াম তবলা সহযোগে গান শ্রবণ। আরামদায়ক ডিলাক্স রুম। সুইমিং পুলের সন্তরণ।

মিস- এর ভাড়া। সবচেয়ে কম ডিলাক্স রুমের ভাড়াও ভ্যাট সমেত প্রায় ৪০০০ টাকা। ( তায় আবার ডিসকাউন্ট চলছিলো তখন) রিসোর্টের লোকবল। পেশাদারিত্ব না গড়ে ওঠা। একটু পর পর সেনাবাহিনীর চোখ মুখ শক্ত করে চলে যাওয়া অফিসাররা।

রোদ হয়ে ছুয়েঁ দেখা পাহাড়ের কোল ... রিসোর্ট থেকে ঢাকায় ফিরে এসেই আমরা লম্বা ট্রিপে বেড়িয়ে পড়ি। এবার গন্তব্য সিলেট। রাতের উপবনে একটা মন খারাপ করা ফার্স্ট ক্লাস বাথে উঠে বসি। কু ঝিক ঝিক করে ট্রেন যায়। মিশু ঘুমায়, আমি জাগি ... তারপর জানলা দিয়ে রাতের বাতাস আর প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমিও ঘুমিয়ে পড়ি।

সিলেট পৌঁছে যাই খুব ভোরে। আগে থেকে বুকিং দেয়ায় সোজা গিয়ে উঠি আই ই বি-র রেস্ট হাউসে। আমি গিয়েই সটান ঘুম। তারপর নাস্তা করে, ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়ি তামাবিল এর উদ্দেশ্য। আই ই বি-র রেস্ট হাউসেই পরিচয় হয় অডিট করতে আসা এক পরিবারের সাথে।

তারাও যাবেন তামাবিল। সো, দল ভারি হয়,আমি একা হই। জিরো পয়েন্ট দেখার কি আছে, আমার মাথায় ঠিক ঢুকছিলো না। কিন্তু তামাবিলের পথে যেতে যেতে হাতের ডানে মেঘালয়ের যে অপার্থিব পাহাড় চোখে পড়ে- সেটার সৌন্দর্য আসলে শব্দে ধরা কঠিন। কুয়াশার রহস্যে ঘেড়া পাহাড়।

সবুজের আলিঙ্গনে এক এক পাহাড়। পাহাড়ের কোল থেকে ঝর্ণাপাত। কিছুদুর এগুলেই একটা জায়গা দৃশ্যমান হয়, যেখানে তাকালে এক সঙ্গে তিনটা ঝর্ণাপাত চোখে পড়ে। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের কি অপূর্ব সৃষ্টি... পথ শেষ হয় জিরো পয়েন্ট-এ। ছবি তোলা হয়।

বি এস এফ এর সাথে চোখাচোখি হয়। কাঁটাতারে ঝুলন্ত একটা লাশের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কথা। আমার মনে পড়ে একজন মাথা উচুঁ দেশপ্রেমিকের নাম। তার নাম তাজউদ্দিন আহমেদ। আমাদের দেশে তাজউদ্দিন আহমেদ-দের বাঁচতে দেয়ার নিয়ম নাই... এইসব নিষিদ্ধ, বাক্য নাই! তামাবিল হয়ে সিলেট ফেরা পথে ঘুরতে যাই জাফলং।

এত এত নাম শুনেছি জাফলং-র। এবার দেখে এলাম। কি যে সুন্দর। স্বচ্ছ টলটলে পানি, শীতল পরশ আর চারপাশে মেঘালয়-এর পাহাড়। দুর্দান্ত কম্পোজিশন।

এই অফ সিজনেও পর্যটকদের ভিড় লেগে আছে। ৩০০ টাকায় নৌকা ভাড়া করে চলে যাই ঝুলন্ত ব্রিজ এর কাছে। সেটা আবার আর এক জিরো পয়েন্ট। এক গাইড ও জুটে যায় আমাদের সাথে। সে নাকি আমাদের সব দেখিয়ে দিবে ঠিকঠাক মতো।

কিন্তু লাজুক গাইড সম্ভবত নিজেই উদাস হয়ে যায় চারপাশের দৃশ্য দেখে। একটা দুটো কথা আর চা খাওয়া ছাড়া আমাদের যোগাযোগ হয়না সে রকম। দশ মিনিটেই ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে নেমে পড়ে নদীতে নামা। মিশু নামে, আমি চুপচাপ নদী আর পাহাড় এর কম্পোজিশন চোখে ধরি। জাফলং ইজ গুড, জাফলং ইজ রিয়েলি সুপার্ব... বিকেলে বের হয়ে ঘুরে আসি শাহজালাল (রঃ) আর শাহপরান (রঃ) এর মাজার।

তারপর সন্ধার দিকে নাজিমগর রিসোর্টে চক্কর। ফিরে এসে ঠিক করে ফেলি শিবির এর হরতাল (পরদিন শিবির এর হরতাল ছিলো...সবাই বলো হুররে)-কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল চলে যাবো। প্ল্যান এর কথা আই ই বি-র আঙ্কেলকে জানাই। আঙ্কেল অমায়িক ভদ্রলোক। স্টেশনে পৌঁছে দেবার বন্দবোস্ত করে দেয়।

আমাদের সিলেট ভ্রমণ এর গল্প ফুরোয়... সিলেট এর হিট- তামাবিল যাবার পথে অপার্থিব সুন্দর পাহাড়। জাফলং এর মনোহর দৃশ্য। মিস- সিলেট শহরের বাচ্চা জ্যাম। ( যে কোনো জ্যাম-এ ঢাকার কাছে বাচ্চা) কিভাবে যাবেন- সোজা রে ভাই। রাতের ট্রেন এ উঠে বসেন।

তারপর ঘুম চোখে ভোরবেলায় সিলেট। :-) সবুজ যখন বাঁধে বাসা, গাছের পাতায় বনে... পরদিন সকালে কালনী এক্সপ্রেস-এ উঠে বসি ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে। দু ঘন্টার জার্নি। টিকেট এর দামও কম। একশ করে।

কু ঝিক ঝিক ঘুমে নেমে পড়ি শ্রীমঙ্গল। আমি ঘুরি ফিরি, হারাই...তারপর আবার ঘুরি-টাইপের লোক। মিশু হলো প্রপার ঘুরে বেড়ানো মানুষ। যাওয়ার আগে গুগলিং করে, যেতে যেতে গুগলিং করে, খানিক বাদে জি পি এস এ খোঁচাখুঁচি করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে-'এসে গেছি, আমরা এসে গেছি। ' আমি মনে মনে বলি-' ধরণি দ্বিধা হও।

' শ্রীমঙ্গল পৌছে সি এন জি ক্যাবে উঠে চলে যাই লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট এ। স্টেশন থেকে ভাড়া নিবে ১৫০ এর মত আর দুরত্ব ১১-১২ কিলোমিটার। শ্রীমঙ্গল পার হতেই চোখে পড়ে দারুন সুন্দর চা বাগান, নানা টি এস্টেট আর নাম ভুলে যাওয়া টি রিসোর্ট। ঘুম ঢুলু চোখে দারুন লাগে এসব দেখতে, চোখে মাখতে। মিনিট পচিঁশেক পরে এসে যায় লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট।

আমি নেমে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবুজ দেখি। মিশু মোবাইল দেখে আমাকে বলে ওঠে, ' জি পি এস গায়েব। অত্র অঞ্চলে নেটওয়ার্ক নাই মোবাইল এর। ' আমি ছোট্ট করে বলি, 'সাবাশ। ' চারদেয়ালের দৃষ্টিসীমায় যারা আটকে আছেন নিজের অজান্তেই, বেড়িয়ে আসুন অন্তত একদিনের জন্য হলেও লাউয়াছড়া থেকে।

চারপাশে নিখাদ বন, বনের নিজস্ব মন্দ্রসপ্তক আর বন্য প্রাণী দেখার রোমাঞ্চ- এ সবেই নাগরিকের অন্তরে টংকার জাগায়। মন শান্ত করে দেয়। মন একলা করে দেয়... একলা হতে চাইছে আকাশ, মেঘগুলিকে সরিয়ে দিয়ে... ভাবনার আকাশে যত কালো মেঘ জমা হয়েছিলো লাউয়াছড়ায় গিয়ে একে একে সব সরে যেতে থাকে আমার। রেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার অমায়িক মানুষ। আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বাজার করতে চলে যায় শ্রীমঙ্গলে।

সেই দুপুরের ঘুমটা ছিলো অদ্ভুত। চারপাশে সবুজের নিজস্ব ধ্বনি, নানারকম পাখির কলতান- আমার মনে হচ্ছিলো আমার চারপাশে কোনো দেয়াল নেই। আমি বনের ঠিক মাঝখানে শুয়ে আছি নির্ভার হয়ে। কিছু কিছু ঘুম শান্তির হয়। সেইসব ঘুমে স্বপ্ন থাকে না কোনো... আমরা চা খোর।

ঘুম থেকে উঠতেই আমরা চা এর জন্য মুখিয়ে থাকি। আর এখন তো আছি চা এর সম্রাট শহরে। কখন চা খাবো এই তাড়াতে যখন রেডি হচ্ছি, শুনি বুক হিম করা আওয়াজ। বনের মধ্য যেনো হুলুস্থুল লেগে গেছে। সভয়ে রেস্ট হাউজের বাইরে গিয়ে দাড়াই।

দুরেই বিশাল সব গাছ। লুটোপুটি দেখতে পাই। কাহিনী কি জানতেই এগিয়ে আসে কেয়ারটেকার। 'কি ব্যাপার, ভাই? কিসের আওয়াজ?' 'এই আর কি। উল্লুক এগুলো।

' 'এরকম বিকট আওয়াজ?' 'এরা এ রকমই আওয়াজ করে। কিন্তু এত কাছে তো আসে না। আজ দেখছি অনেক কাছে চলে এসেছে। ' -নির্লিপ্ত মুখে কেয়ারটেকার জানায়। আমি মনে মনে প্রমোদ গুনি।

বনের ভিতরেই দু মিনিট হাটা দুরত্বে রেললাইন। সেটায় কোনো গেটম্যান নেই। সেখানে দাড়াতেই বিশাল এক গাছের উপর চশমা পড়া হনুমানের পরিবারবর্গের সাথে দেখা হয়। অমায়িক তারা। ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলতেই ফটোজেনিক হনুমান-রা একের পর এক পোজ দিতে থাকে।

ছবি তোলা শেষে রেললাইন অতিক্রম করে আমরা একটা টিলার উপর উঠে যাই। শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত সাত লেয়ারের চা খাই। সেখানে দেখা হয়ে যায় এক কান কাটা অদ্ভুত কুকুরের সাথে। (সে গল্প পরে)। খানিক বাদে নিসর্গ প্রকল্পের ইকো গাইড আহাদ মিয়ার সাথে পরিচয় হয়।

মিশু আগেই একবার লাউয়াছড়া গিয়েছিলো। সেই সুত্রে ওর পরিচয় ছিলো নিসর্গের এক ভাইয়ার সাথে। পরিচিত থাকায় সুবিধে হয়। আহাদ মিয়া স্বপ্রনোদিত হয়ে আমাদের গাইড করে নিয়ে যায় এক ঘন্টার ট্রেইল-এ । এই ট্রেইল ধরে যাওয়া যায় খাসিয়া পল্লীতে।

সেই সময়গুলো দারুণ ছিলো। এখন ফিরে এসে আক্ষরিক অর্থেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি। ট্রেইল ধরে এগিয়ে যাওয়া, চারপাশের সবুজ আর সবুজ, বিশাল সব গাছ, হঠাৎ নাম না জানা পাখির ডেকে ওঠা- সব মিলে একটা অন্যরকম আনন্দ ছিলো সময়টায়। মিনিট চল্লিশেক পর আমরা ট্রেইল ধরে পৌঁছে যাই খাসিয়া পল্লীতে। খাসিয়ারা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বেছে নিয়েছে।

মেয়েরাই পরিবারের কর্তা। এ রকম কিছু কর্তার সাথে দেখা হয়। লটকন ভর্তি গাছ থেকে লটকন পেড়ে খাওয়া হয়। তারপর কিছু দারুন দৃশ্য দেখতে দেখতে ফিরে আসি রেস্ট হাউজে... বনের ভিতর সেই রেললাইন এ বিকেল কাটাই দুজন। রেল পথ ধরে একটা বাঁক মিশে যায় সুদূরে...তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বাঁকের ঠিক ওপাশেই পৃথিবীর তামাম রহস্য লুকিয়ে আছে।

ঠিক করি, এখন যদি কোনো ট্রেন আসে আমি রেললাইন এর মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবো। কথা শেষ না হতেই ট্রেনের সাইরেন শুনতে পাই। দুজন দুজনের দিকে তাকাই। চোখে চোখেই কথা হয় আমাদের। আমরা আমাদের করণীয় বুঝে নেই।

পরবর্তী মুহূর্ত কয়েক সম্মোহনী ছিলো। সেই গল্প আমি আমার কোনো এক আনকোড়া লিরিক-এ করবো বরং... সে-রাতে কেয়ারটেকার আলী ভাই এর স্ত্রী-র হাতের রান্না খেয়ে আমরা সামনের বারান্দায় বসে থাকি চুপচাপ। চারপাশে অজস্র ঝিঁ ঝিঁ ডাকে...একটা সুররিয়েল দৃশ্যকল্প তৈরি হয়। আমার ঘোর লেগে যায়... ভালোবাসা দাও, সবুজ বৃক্ষ ... পরদিন খুব সকালে গাইড আহাদ মিয়া চলে আসে আমাদের ডিপ ফরেস্ট এর ট্রেইলে নিয়ে যাবে বলে। আমি বনে, পাহাড়ে, সমুদ্রে আনন্দ নিয়ে ঘুড়ে বেড়াই।

শুধু সাপ আছে শুনলেই নিভে যাই একদম। তাই মোটামুটি ভয় তাড়িয়েই হাসিমুখে আর মনে মনে ভয়ে ট্রেইল শুরু করি। পথে যেতে যেতে আহাদ মিয়ার সাথে কথা হয় আমার। আমিঃ এই ট্রেইল কতদুর? আহাদ মিয়াঃ প্রায় ঘন্টা তিনেক এর। চা বাগান দেখতে পাবেন আধা ঘন্টা হাঁটলে।

আর ঘন্টা তিনেক হাঁটলে একদম ডিপ ফরেস্ট। হঠাৎ আওয়াজ হয় কিসের যেনো। আমি মনে মনে বলি,আল্লাহ সাপ যেনো না হয়। ভরসা পাওয়ার জন্য আহাদ মিয়ার দিকে তাকাই। তারপর দুজনেই দেখতে পাই একটা মায়া হরিণ এর চকিতে চলে যাওয়া।

আবার হাঁটি। মিশু একটু পিছনে। যথারীতি ক্লিক ক্লিক... 'এই ট্রেইল এ বন্য প্রাণী দেখা যায়?' 'ঐ যে বানর। একটু এগুলেই উল্লুক এর একটা পরিবার দেখতে পাবেন। ' 'বানর তো দেখলাম।

সাপ তো নাই, তাই না?' আহাদ মিয়া হাসে। 'আছে। তবে ভয়ঙ্কর এখানে বন্য শুকর। এরা খুব ভোরে পাল বেধে এই পথে বের হয়। কিছুদিন আগে এদের আক্রমণে এক ত্রিপুরা ছেলে মারা গেছে।

আপনারা একটা কুকুর দেখেছেন? এক কান নাই?' 'হু, দেখসি তো। চা খাবার সময়। ' 'বন্য শুকরের কাজ। এই ট্রেইল এই। কান কামড়ে নিয়ে চলে গেছে।

' ধুকপুক। ধুকপুক। এদিক ওদিক চাই। বনের ভিতর কিছু দেখা যায় না। চা বাগান দেখা শেষ না করে অর্ধেক পথে ফিরে আসি।

বন্য শুকরের সামনাসামনি পড়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই রে ভাই... আমি নির্বিরোধী মানুষ! এইসব রোমাঞ্চ, সবুজের আলিঙ্গন, গহীন বন, রাতের ঝিঁ ঝিঁ ডাক-সব চোখে থেকে আমার মাথায় ঢুকে যায়... বন্ধ চোখে তাকানো যায় একভাবে। সেই বন্ধ চোখে তাকাতেই আমি লাউয়াছড়া দেখতে পাই, রেললাইন দেখতে পাই, গহীন বন দেখতে পাই। একরাশ সবুজ মুগ্ধতায় আমরা সেইদিন শ্রীমঙ্গল থেকে নরসিংদির বাসে উঠে বসি। লাউয়াছড়ার হিট- সব কিছু, মানে সব! মিস- নাই! কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ সরকারী অফিসারের রেকোমেন্ডেশন লেটার সাথে থাকলে বন বিভাগের রেস্টহাউজের ভাড়া নামে মাত্র। মোটে চল্লিশ টাকা।

আর না থাকলে চারশো। কেয়ারটেকারের নাম- মোহাম্মদ আলী। ফোন নাম্বার-০১৮১৯৮২৬১৮৩। রাতে থাকলে আগে থেকে জানিয়ে উঠবেন। কারণ বাজার করার জন্য যেতে হয় শ্রীমঙ্গলেই।

গাইডের নাম আহাদ মিয়া। ফোন নাম্বার-০১৭৪২৭৯৫৫০৭। গ্রামে নয় স্বপ্নে নয়, নয়কো স্বপ্ন ঘুমে ... শ্রীমঙ্গল থেকে শ্যামলী বাসে ঘন্টা আড়াই জার্নি শেষে (আমাদের এ কদিনের জার্নিতে শ্যামলী ভর করেছিলো। যেখানেই গেছি বাস হলেই শ্যামলী) দুপুরে নরসিংদি নামি ক্লান্ত হয়ে। বিকেলে মেঘনা পাড়ে ঘোড়াঘুরি আর মফস্বল-গ্রামের নির্যাস উপভোগ।

কিন্তু মন পড়ে থাকে লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট-এ। দুদিন নরসিংদি থেকে লাগাতার জার্নিতে পানিশূন্যতায় ভুগে ঢাকায় ফিরে আসি একদিনের জন্য। ফেরা পথে লিরিক মাথায় ঘুরপাক খায়- 'মফস্বলের দুপুরগুলো শান্ত নাগরিকের মনটা কি সব জানতো! মফস্বলের দুপুরগুলো শান্ত...' ঢাকায় একদিন যাত্রা বিরতি শেষে চলে যাই পাবনায়। মিশু আর যাত্রাসঙ্গী হয় না। প্রবল জ্বরে জ্বরতে জ্বরতে থেকে যায় ঢাকাতেই।

আমি এক দঙ্গল বই নিয়ে পাবনার হাইওয়েতে রওয়ানা করি। সেই ছোট্ট গল্প বলেই ভ্রমণ ব্লগ শেষ করবো। আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া, স্বপ্নের ঐ পাখি ধরতে চাই... গত মার্চ-এপ্রিলের দিকে পাবনার এক প্রাইমারী স্কুল আর মাদ্রাসার স্পোর্টস-এ গিয়েছিলাম আমরা। তখনই ভাবনাটা আসে মাথায়। মিশুকে জানাতেই ও সোৎসাহে সায় দেয়।

ঢাকা ফিরেই যোগাড়যান্তি-তে লেগে পড়ি দুজনে। খুব কাছে্র মানুষকে জানাই ভাবনাটা আর নিজেরা বই কেনা শুরু করি। দুজনে মিলে ঠিক করি পাবনার চকদুবলিয়া গ্রামের মাহমুদা প্রাথমিক বিদ্যালয় আর তার ঠিক পাশেই গড়া ওঠা আবদুল করিম মাদ্রাসার জন্য আমরা একটা লাইব্রেরি করে দিবো। নাম হবে লাল সবুজ বই ঘর। গ্রামের কোমলমতি শিশুরা পাঠ্যবই এর পাশাপাশি চমত্কার সব গল্পের বই পড়বে।

রুপকথার বই থেকে শুরু করে জাফর ইকবাল, উপেন্দ্রকিশোর রায় থেকে সুকুমার রায় হয়ে সত্যজিত রায়... মোস্তফা জামান আব্বাসীর অসাধারণ বই মুহাম্মাদের নাম এর পাশাপাশি পড়তে শিখবে জাহানারা ইমাম এর একাত্তরের দিনগুলো। একটা সুন্দর পাঠ্য পরিবেশ গড়ে উঠবে গ্রামে। বছরে একবার স্পোর্টস এর পাশাপাশি বই পড়া প্রতিযোগিতাও থাকবে। কোনো একটা বই পড়ে নিজের ভাবনা সুন্দর করে গুছিয়ে লিখবে শিশু বা কিশোর। আমরা উৎসাহ দিবো।

আমি নিশ্চিত এই কাজে একদল স্বপ্নবাজ পেয়ে যাবো আমাদের সাথে। উৎসাহ পেয়ে সে একজন ভালো লেখক হয়ে উঠবে, নতুন একটা পথিবী এক্সপ্লোর করবে...বেরিয়ে পড়বে আসল মুক্তো-মানিকের সন্ধানে... খুব ভালো লাগবে যদি অনেকদিন পর সেই গ্রামে গিয়ে দেখি একটা ছেলে মেঠোপথে যেতে যেতে খাস পাবনা ভাষায় একাত্তরের দিনগুলি নিয়ে উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে কথা বলছে বন্ধুর সাথে বা গ্রামের পুকুরপাড়ের আলসিতে বসে কোনো এক গ্রামবাসী হুমায়ুন আহমেদ এর এলেবেলে পড়ে ঠা ঠা করে হেসে এদিক ওদিক দেখে নিচ্ছে কেউ দেখে ফেললো কিনা... প্রাইমারী স্কুল হলো আমাদের সত্যিকারের দেশপ্রেমিক গড়ে তোলার আতুর ঘর। এই কথাটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আমি ভাগ্যবান পাশে এমন একজন মানুষকে পেয়েছি যার স্বপ্ন আর আমার স্বপ্ন এক স্বপ্নপথেই থাকে। যে মানুষটা আসলে স্বপ্নবাজ, যে একজন রিয়েল সোলজার... পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনায় উদ্ভাসিত হোক সবার অন্তর।

ভালো থাকুন বন্ধুগণ...  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।