অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা শ্রম বিষয়ে গুরুতর আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে এমনটা নিশ্চিত দাবী করা যাবে না, শ্রমিক হিসেবে কাদের চিহ্নিত করা হবে, তাদের শ্রমের ধরণ কিভাবে নির্ধারিত হবে, দক্ষতা এবং সেবার পরিমাণের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত শ্রমের মজুরি কি হওয়া বাঞ্ছনীয়, এইসব নানাবিধ জটিলতা স্বত্তেও আলোচনা শুরু করা জরুরি।
কে দেবে আত্মস্যাৎকৃত শ্রমের মজুরি?
বিভিন্ন ভাষ্যে শ্রম শোষণ এবং শ্রম আত্মস্যাৎ এর অভিযোগ উত্থাপিত হয়, প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য মজুরি প্রদান, প্রচন্ড শ্রমঘন কাজের পরও উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ার উপরে মালিকের লাভের অঙ্ক নির্ভর করে, খুব সরলীকৃত বক্তব্য এটা। যে সময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক এবং শ্রমের মূল্য নির্ধারণের আলোচনা চলছে সে সময়ে শ্রমিকের জীবন ধারণ এবং সামান্য স্বচ্ছলতার প্রয়োজনীয়তাটুকু উপলব্ধ হয়েছিলো। কৃষি শ্রমিক এবং শিল্পশ্রমিকের সময়ে শুরু হওয়া আলোচনার মাঝে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের শ্রমিক না কি মালিক পক্ষের নিযুক্ত ভাড়াটে ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত সে সংক্রান্ত জটিলতাও ছিলো।
এই বিদ্যমান অস্পষ্টতা খোলাসা না করেই কার্ল মার্ক্স বিশ্বকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিলেন, সেখানে শ্রমিক এবং মালিক'এর বাইরে পৃথক কোনো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব নেই।
[ Economic and Philosophical Manuscripts of 1844. Karl Marx] শ্রমিক শ্রম বেচতে বাজারে যায়, একেবারে সহায়সম্বলহীন শ্রমিক এবং সামান্য ভূসম্পত্তি থাকা শ্রমিকের ভেতরেও কার্যকত তফাত থাকে, জীবিকার প্রয়োজনে সহায়সম্বলহীন শ্রমিককে যেকোনো মূল্যেই জীবনের প্রয়োজনে শ্রম বেচতে হয় এবং অপরপক্ষের সে বাধ্যবাধকতা থাকে না।
জীবনের প্রয়োজনে শ্রম বেচবার বাধ্যবাধকতা কখনই শ্রমিককে উৎপাদনের চালকের আসনে বসায় না, এমন কি শ্রমিক যখন কারখানায় শ্রম দিচ্ছে সেখানেও সে নিজের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে যে পরিমাণ বাড়তি সম্পদ উতপাদন করছে সেটাই মালিকের মুনাফা। মুনাফালোভী মালিক শ্রমিককে শোষণ করছে প্রতিনিয়ত। মালিক যেহেতু একক প্রচেষ্টায় বৃহৎ উৎপাদনে যেতে পারবে না সুতরাং শ্রমিকের ক্ষমতা আছে নিজের অধিকার আদায়ে শ্রম প্রদান করা থেকে নিজেকে বিরত রাখার। মূলত অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে এ কারণেই বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক হরতাল কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে।
যে সময়ে কার্ল মার্ক্স অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং সমাজ বিষয়ে নিজের বিশ্লেষণগুলো লিখছেন তখনও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতা আজকের পর্যায়ে পৌঁছায় নি। সুতরাং শ্রমিকের শোষণ, মালিকের মুনাফা এবং মুনাফাকেন্দ্রীক কারখানাপরিচালনার নীতিগুলো তখনও কার্যকরি ছিলো, তবে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পরিস্থিতির ভয়াবহ পরিবর্তন ঘটেছে, এ মুহূর্তে অব্যহত উৎপাদন বজায় রাখার স্বার্থে মালিককে শ্রমিকের উপস্থিতির উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে না, যন্ত্র এবং প্রযুক্তির দাপটে শ্রমিক অধিকারগুলো অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
তিন শিফটে শ্রমিক না রেখে ১০ জন ম্যাশিন অপারেটরকে উচ্চমূল্যে নিয়োগ দিয়ে ২৪ ঘন্টা উৎপাদন বজায় রাখা সম্ভব ,সদ্য বিকশিত যান্ত্রিক যুগে যেসব ধ্যান ধারণা প্রচলিত বাস্তবতার প্রেক্ষিতে গৃহীত হয়েছিলো সেসব পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাও উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। উদ্বৃত শ্রম, আত্মস্যাৎকৃত শ্রমের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হচ্ছে সময়ের প্রেক্ষিতে।
এ সময়েই নারীর উপেক্ষিত এবং অসংজ্ঞায়িত গেরোস্থালী শ্রমের পারিশ্রমিক বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
যদিও এই উপেক্ষিত, অসংজ্ঞায়িত গেরোস্থালী শ্রমের পারিশ্রমিক কোথা থেকে আসবে তা নিশ্চিত নয় তবে বিদ্যমান অর্থনীতিতে নারীর উপেক্ষিত ও অসংজ্ঞায়িত শ্রমঘন্টার মূল্য দেশের জিডিপির এক তৃতীয়াংশের বেশী, আরও অধিক পরিমাণে নারী শ্রমিকের উপস্থিতিতে নারীর উপেক্ষিত গেরোস্থালী শ্রম এবং মজুরিতে বিক্রিত শ্রমের পরিমাণ নিয়ে আলোচনা চলছে।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বিদ্যমান মজুরি ও অন্যান্য বৈষম্য নিরসন করতে হবে এবং নারীদের পুরুষ সহকর্মীদের সমান বেতন প্রদান করতে হবে এই আন্দোলনে অবশেষে নারীরা বিজয়ী হয়েছে, এখন অনেক কর্মক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষ সহকর্মীর সমান বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু এরপরও ঘর গেরোস্থালী গুছিয়ে রাখবার দায়িত্বটাও তাদের পালন করতে হচ্ছে, বনা পারিশ্রমিকে পরিবারের জন্য শ্রম দেওয়া নারীর এই শ্রম উপেক্ষিত এবং সেটা খুবই গুরুত্বুপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
নারী সন্তান ধারণ করে, আদিমকালে নারী উর্বরতা শক্তির বাহক হিসেবে পূজিত হতো শুধুমাত্র এ কারণেই, এখনও অন্যান্য সকল চাহিদা পূরন করা সম্ভব হলেও রাষ্ট্রের অব্যহত প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় শ্রমিকের জোগান দেয় নারীর গর্ভ। রাষ্ট্র গর্ভধারণের জন্য নারীকে কোনো পারিশ্রমিক দেয় না, সন্তান জন্মদানের পর তাকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব, তাকে লালন পালনের জন্য নারী কোনো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না, এইসব বিভিন্ন বিষয়ে নারীবাদী আলোচনা হচ্ছে।
মালিক এবং শ্রমিকে বিভাজিত মার্ক্সীয় ব্যবস্থা এর কোনো সমাধান দিয়ে যায় নি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুচকে নারীর অবদান পরিসংখ্যান এবং জরিপে সম্পূর্ণ উঠে আসে না বাস্তবতাটুকু মেনে নিয়েই প্রশ্নটা উত্থাপন করা যায়
নারীর দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য এই শ্রমের মূল্য যোগাবে কারা? মমতার সেবামূল্য অনির্ধারিত, প্রেম ভালোবাসা ও জৈবনিক চাহিদা ও তৃপ্তির মূল্যও অনির্ধারিত, সুতরাং এইসব বিমূর্ত ধারণার প্রেক্ষিতে প্রদত্ত শ্রমের মূল্য কত হওয়া বাঞ্ছনীয় সেটা কেউ নির্ধারণ করতে পারেন নি।
একজ নারী নেপথ্যে আছেন বলেই একজন শ্রমিক সকাল বেলা স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে কর্পোরেটের দাসত্ব করতে পারছেন, তার ছেলে মেয়ের লালন পালনের জন্য বাসায় নারী নিয়োজিত বলে আরও বেশী মনোযোগ দিয়ে তারা কারখানার সেবা করে যেতে পারছেন। এমন কথা বলে কোনো কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকের নিবেদিত শ্রমের পেছনে যে নারীর অবদান তার অনুপস্থিত শ্রমের মূল্য যোগাতে কতৃপক্ষকে বাধ্য করা যাবে না।
রাষ্ট্রের শ্রমিকের প্রয়োজন মেটাচ্ছে বলে রাষ্ট্র নিজের তহবিল থেকে নারীকে পারিশ্রমিক প্রদান করবেন এ ধারণাও প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু কাগজে কলমে, সেমিনারে এইসব শ্রমের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হয়েছে, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থা এর স্বীকৃতি দিয়েছে।
শ্রমকে স্বীকৃতি দিলেই যে পারিশ্রমিক চিহ্নিত করা সম্ভব, সব সময় সেটা সঠিক নয়, নারীর শ্রমের মালিকানা নারীর কিন্তু তার ভোক্তা সমাজের সবাই, বিভিন্ন ভাবে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের প্রতিষ্ঠানগুলো এই শ্রমে লাভবান হলেও সেটার পারিশ্রমিক প্রদানের ভারটুকু কে বহন করবে তা অনির্ধারিত।
বস্তুত অনেক ধরণের জটিলতার ভেতরে পেট চুক্তি এবং মমত্ববোধের অলীক উপস্থিতিতে নারী যুগপত বেশ্যা এবং সেবিকা হয়ে গেরোস্থালী শ্রম দিয়ে যাবে অনির্ধারিত সময়। এখানে আত্মস্যাৎকৃত শ্রমগুলো, উদ্বৃত উৎপাদনগুলোকে কোনো পণ্যমূল্যে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সেমিনারে বক্তারা বড় গলায় বলবেন নারীর শ্রমের পরিমাণ কিন্তু সেই শ্রমের মজুরি নারী পাবে না। সেটা বিশাল একটা শূণ্যতার গর্ভে হারিয়ে যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।