আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারায়নগঞ্জের চেতনা আর নরসিংদীর খুন

নারায়নগঞ্জের চেতনা আর নরসিংদীর খুন শওগাত আলী সাগর সন্ত্রাস আর পেশিশক্তির বিরুদ্ধে আর শান্তির স্বপক্ষে নারায়নগঞ্জের সর্বস্তরের জনতার নিরব জনঅভ্যুত্থানের আনন্দ উল্লাসের রেশ এখনো শেষ হয়নি। তারমধ্যেই সন্ত্রাসের ভয়াল ছোবল। না, নারায়নগঞ্জে নয়, পার্শ্ববর্তী জেলা শহর নরসিংদীতে। নারায়নগঞ্জে শান্তির স্বপক্ষে জনঅভ্যুত্থান ঘটেছে মেয়র নির্বাচনকে ঘিরে। আর নরসিংদীতে সন্ত্রাসের ভয়াল থাবা ছোবল হেনেছে একজন নির্বাচিত মেয়রের প্রাণ হরনে।

দুটো ঘটনাই ঘটেছে দেশের প্রধান এবং বৃহত্তম রাজনৈতিকদল আওয়ামী লীগকে ঘিরে। মুখোশধারীদের গুলিতে নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিশেষ করে দলীয় রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সর্বশেষ পৈশাচিক সংযোজন। সত্যি বলতে গিয়ে পত্রিকার খবরে লোকমানের নিহত হওয়ার খবরটি দেখে বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি, বারবারই মনে হয়েছে ভুল দেখছি, কিংবা ভুল ছাপা হয়েছে। হয়তো মরেই যায়নি লোকমান,আহত হয়ে হাসপাতালে আছে, ঠিকই সেরে উঠবে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক প্রাণবন্ত তরুনের প্রতিচ্ছবি।

এই তারুন্য কিভাবে মরে যায়? তা হতেই পারে না! কিন্তু মানুষের মনের ভাবনার মতো সবকিছুইতো আর ঘটে না। লোকমান বেঁচে নেই- এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। ঢাকার প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লাম। লোকমানকে কেন মরতে হলো- সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই হন্নে হয়ে এভাবে পত্রিকার খবরের পোষ্টমর্টেম করা। আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম মফস্বলে থেকে মফস্বলের সাংবাদিকদের অনেক সত্যকথাই প্রকাশ করা কঠিন।

হয়তো ঢাকার ক্রাইম রিপোর্টাররা ব্যক্তিগতভাবে নরসিংদী গিয়ে স্বাধীনভাবে খোঁজখবর করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। সেটি না হওযা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বইকি! লোকমানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে। ঠিক সন তারিখটা এখন আর মনে করতে পারছি না। বিষাক্ত মদ খেয়ে বহুলোকের প্রাণহানির কারনে নরসিংদী তখন জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম,আলোচনার বিষয়বস্তু। আমি তখন প্রথম আলোয় কাজ করি।

সম্পাদক মতিউর রহমান কি ভেবে ক্রাইম রিপোর্টারের বদলে আমাকেই পাঠালেন নরসিংদীতে। একজন অর্থনৈতিক রিপোর্টারকে কি না করতে হবে বিষাক্ত মদ খেয়ে পাখির মতো মানুষ মরে যাওয়ার ঘটনার ফলো আপ রিপোর্ট। সেই সময়েই লোকমানের সঙ্গে পরিচয়। তখন সে সম্ভবত জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক। খবরের পেছনের খবরের অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো নরসিংদীর দুই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রনে মাদকের বিশাল নেটওয়ার্কের চিত্র।

সেই সময়কার এমপি (বিএনপি দলীয়) নিয়ন্ত্রন করতেন শহরের মদের ব্যবসা। আর পৌরসভার (আওয়ামী লীগ দলীয়) নিয়ন্ত্রনে ছিলো ফেন্সিডিলের নেটওয়ার্ক। দুই জনপ্রতিনিধির ভাগবাটোয়ারায় একটা শহরকে মাদকের চারণভূমিতে পরিণত করার ধারাবাহিক রিপোর্টটি যথেষ্টই আলোচিত হয়েছিলো। বিএনপি দলীয় সেই এমপি এখন আর বেঁচে নেই। আওয়ামী লীগ দলীয় সেই পৌরসভা চেয়ারম্যানকে পরাজিত করে নরসিংদীর পৌর মেয়র হয়েছিলেন লোকমান।

লোকমানের সঙ্গে যখন আমার পরিচয়,তখন সে শহরের প্রভাবশালী ছাত্রনেতা। ‘ক্যাডার’ হিসেবেও তার একটা পরিচিতি ছিলো। ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদকের ক্যাডার পরিচিতি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক বিবেচনায়। তবুও তার শহরের বাসায় দীর্ঘ আড্ডায় তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার ক্যাডার পরিচিতি নিয়ে।

প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে লোকমান জবাব দিয়েছিলো,আপনি শহরের যে কোনো এলাকায় যে কোনো লোককে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, তারা যদি আমার সম্পর্কে মন্দ বলে, আমাকে সন্ত্রাসী বলে,তাহলে আপনি সেটা পত্রিকায় ছেপে দেবেন। তবে বলি রাখি শহরের দুই জনপ্রতিনিধি অবশ্যই আমাকে সন্ত্রাসী বলবে। সংবাদ সংগ্রহে শহরের অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে ফাকেঁ ফাকেঁই আমি লোকমানকে নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছি। বিস্মিত হয়েছি,শহরের সাধারন মানুষের মনে লোকমানের অবস্থান থেকে, লোকমানের জন্য ভালোবাসা দেখে। সেই আড্ডায়ই লোকমান বলেছিলো, এলাকার মানুষ কিন্তু চায় আমি ইলেকশন টিলেকশন করি।

আমি ইলেকশন করলে কেন্দ্র দখল, ব্যালট বক্স হাইজ্যাক করতে হবে না। আমি ঘরে বসে থাকলেও শহরের লোকজন আমাকে নির্বাচিত করবে। লোকমানের নির্বাচন আমার দেখে আসা হয়নি। তার আগেই আমি দেশ ছাড়ি। তবে দুই দুইটা নির্বাচনেই তার নিরংকুশ জনপ্রিয়তা প্রমানিত হয়েছে।

টরন্টোয় বসে লোকমানের জনপ্রিয়তার কথা প্রায়শ:ই শুনতাম। পৌরসভার মেয়র হওয়ার পর লোকমান নাকি শহরের চেহারা পাল্টে ফেলেছে। একটা জেলা শহর এতোটা ঝকমকে হতে পারে ভাবাই যায় না, এমনসব কথা শুনেছি কানাডায় বসবাসরত নরসিংদীর লোকজনদের কাছে। লোকমানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ একজনকে মুখের উপর একবার বলেছিলাম,লোকমান তো সন্ত্রাসী। বয়ো:বৃদ্ধ ভদ্রলোক এতোটাই রেগে গেলেন যে তিনি ঘোষনা দিলেন, তিনি আর আমার সঙ্গে কথাই বলবেন না।

আমি হেসে দিতেই তিনি বললেন, আমরা রাজনীতি করি না, সাংবাদিকতাও করি না। কিন্তু লোকমানকে নিয়ে কিছু বললে আমাদের প্রাণে আঘাত লাগে। নরসিংদীর যে কোনো লোকেরই মনেই আঘাত লাগে। লোকমান এখন নরসিংদীর গনমানুষের নেতা, নন্দিত নেতা। আমি অবাক বিস্ময়ে তারদিকে তাকিয়ে থাকি।

লোকমানের সঙ্গে আমার চেনা জানা আছে সেটা তাকে আর বুঝতে দেই না্ । গত ঈদের পরে টরন্টোয় বসবাসরত নরসিংদীবাসীদের ঈদ পূণর্মিলনীর আড্ডায়ও উঠে এসেছিলো লোকমানের নাম। লোকমান কিভাবে শহর নরসিংদীকে বদলে দিয়েছেন, মাদক আর সন্ত্রাসের টুটি চেপে ধরেছেন সেই সব বয়ান। আমি শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম, নরসিংদী জেলায় পাঁচ পাঁচজন এমপি আছেন, মন্ত্রী আছেন, তাদের কারো নাম নয়, সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ের টরন্টোর এক উৎসবের আড্ডায় কী না আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একজন পৌরসভার মেয়র! সেই আড্ডায়ই জানানো হয়েছিলো লোকমান বেড়াতে আসবেন টরন্টোতে। প্রস্তাব উঠেছিলো লোকমান টরন্টো এলে তাকে বড় করে সংবর্ধনা দিতে হবে।

সবাই রাজিও হযেছিলো। কিন্তু লোকমান এখন সব সংবর্ধনার উর্ধ্ধে । লোকমানকে কারা মেরেছে সেটি আমজনতার কাছে এখনো পরিষ্কার নয়। তবে মিডিয়ার খবর বলছে এটি দলীয় কোন্দলের জের। লোকমান হত্যার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসা দলীয় নেতা কর্মীদের বক্তৃতা আর শ্লোগানে উচ্চারিত শব্দমালা জাতিকে জানিয়ে দিয়েছে এটি দলীয় কোন্দলের ঘুণ্যতম প্রকাশ।

সেটি যদি সত্য হয় তাহলে একটা দূর্ভাবনা আছে। দূর্ভাবনা এই খুনের বিচার নিয়ে। যে অংশটি ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি সেই অংশটিই জিতে যাবে এটাই স্বাভাবিক। লোকমানের খুনীরা যদি দলের হাই কম্যান্ডের স্নেহধন্য হয় তাহলে জনপ্রিয় এক জননেতার ঘাতকরা লোকমানের শান্তির শহরে দাপটে ঘুরে বেড়াবে, কোনো বিচারই হবে না। লোকমানের আত্মা হয়তো হয়তো গুমড়ে গুমড়ে কাঁদবে।

কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি আর রাজনীতির পৈশাচিকতার যে চিত্র তার কোনো রকমভেদ হবে না। নারায়নগঞ্জ আর নরসিংদী । পাশাপাশি দুটো জনপদ। একদা নারায়নগঞ্জেরই অংশ ছিলো এই জনপদটি। সেই নারায়নগঞ্জের জনতা যে প্রত্যাশার যে মশাল জ্বেলেছে ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে,সেই প্রত্যাশার স্ফুরন আমরা নরসিংদীতেও দেখতে চাই।

দেখতে চাই একজন জনপ্রিয়,দুই দুইবারের স্বর্ণপদক বিজয়ী জনপ্রতিনিধির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দাড়িয়েছে দেশের তাবত মিডিয়া, সুশীল সমাজ। দেখতে চাই অনলাইন এক্টিভিষ্টদের সক্রিয়তাও। নারায়নগঞ্জের নির্বাচনে যেমন অনলাইন বিশ্ব সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো সন্ত্রাসী.গডফাদারকে ঠেকাতে। একজন লোকমান নয়, নরসিংদীর পৌরমেয়র নয়, একজন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধির খুনীদের চিহ্নিত ও বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে নারায়নগঞ্জের যে জন অভ্যুত্থান তার মূল চেতনাকেই অপমান করা হবে। নরসিংদীর পৌর মেয়রকে হত্যার মধ্যদিয়ে একজন লোকমান হোসেনই কেবল খুন হলেন না, নারায়নগঞ্জের গনঅভ্যুত্থানের চেতনাও যেন খুন হয়ে গেলো।

বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর ডটকম এ প্রকাশিত(খানিকটা সম্পাদিত) Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.