উন্নয়নের বিষাক্ত আঁচড়ের রেখা দেখা যায় ঢাকা- সিলেট মহাসড়কের দুপাশে গজিয়ে উঠা শিল্পকারখানায়- আমরাও টেকসই উন্নয়নের পক্ষে কথা বলতে চাই- আমরাও মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াক এমনটা চাই- অন্য সবার মতো আমার দেশপ্রেমের কাঁটা একটু নীচে থাকলেও অনেক রকম শর্ত সাপেক্ষে আমিও মধ্য আয়ের বসবাসযোগ্য বাংলাদেশ চাই- চাই দেশে বিনিয়োগ বারুক- চাই দেশে শিল্প নির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠুক- চাই আমাদের কৃষিনির্ভরশীল অর্থনীতিতে প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করে আমাদের কৃষকেরাও অন্তত সচ্ছল জীবন যাপন করুক-
তবে সেই শর্তগুলো পুরণ হওয়া সাপেক্ষে আমরা অন্তত আমরার মতো বিভ্রান্তিকর শব্দ পরিহার করে আমি উন্নয়নের রাজপথে নামতে চাই-
একই অবস্থা গাজীপুরের সন্নিকটে গড়ে উঠা নতুন শিল্পাঙ্গনের- সেখানেও কল কারাখানা স্থাপিত হচ্ছে- শাল বন দখল করে সেখানে কারখানা নির্মিত হচ্ছে- এবং বাংলাদেশ ক্রমশ দর্জিজাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠার কারণে অনেক রকম তৈরি পোশাক শিল্পের সহায়ক কারখানাই মূলত নির্মিত হচ্ছে- যন্ত্রাংশ আমদানী সেটাও মুলত তৈরি পোশাক হিসল্পের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানী- সেলাই ম্যাশিন- সুঁই- কাঁচি- এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ অব্যহত রাখা যেনো উৎপাদন কমে না যায় তাই বিকল্প শক্তি সরবরাহ ব্যবস্থা- জেনারেটর এবং বেশ বড় মাপের বড় পুঁজির কারখানা হলে নিজস্ব বিদ্যুত উৎপাদন ব্যবস্থা-
বিনিয়োগ আসছে- দেশে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানি আসছে- বিভিন্ন ইপিজেড এ তাদের ভালো রকম সুযোগ সুবিধা দিয়েই আমরা বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চাইছি-
তবে কতটা মূল্য দিতে আমরা প্রস্তুত-
এন ২- ঢাকা সিলেট মহাসড়কের দুই পাশের নালা দিয়ে বয়ে চলা পানি যা অবশ্য একটু দুরে গিয়ে মিলেছে মেঘনার সাথে- মেঘনার দুই পাশ দিয়ে গড়ে উঠা সিমেন্ট কারখানার বর্জ্য নিস্কাশনের কোনো সুবন্দোবস্ত রাখা হয় নি- তবে এখানে বিশাল যে বিদেশী সিমেন্ট কারখানা রয়েছে সেটার দাবী- তারা সম্পূর্ন পরিশুদ্ধ করেই পানি নির্গম করে মেঘানায়- কল কারাখানর বর্জ্যে বিষাক্ত হয়েছে নদী- আমাদের প্রাকৃতিক অবকাঠামো হুমকির সম্মুখীন- আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র ধ্বংস হয়ে গেছে- আমাদের নদীগুলোতে মাছের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে কমে গেছে- তবে পরিবেশ বিপর্জয়ের কারণ এই সব কলকারাখানার মালিকেরা নয়- কারণ তাদের প্রত্যেকেরই পরিবেশ অধিদপ্তরের সনদ আছে- সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সচিবের সাক্ষর আছে- আছে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং প্রযুক্তিবিদদের পাঠানো তথ্য এবং তদন্ত রিপোর্ট- তাদের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে- সেটা কর্মক্ষম এবং সেটাতে পানি শিধন করেই তারা সে পানি বাইরের পরিবেশে ছাড়ছে-
ওয়াটার ট্রিটমনেন্ট প্ল্যান্টের ক্ষমতা নিয়ে বক্তব্য নেই- কিংবা আদতে পরিশুদ্ধ এই পানি যা কোনো কোনো কারখানার প্রযুক্তিবিদদের মতে পানযোগ্য এই পানিতে আসলে কি পরিমান রাসায়নিক বর্জ্য বিদ্যমান সে সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন নেই-
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত রাসায়নিক যৌগগুলোর ভেতরে আছে- সালফিউরিক আসিড- হাইড্রোক্লোরিক আসিড- হাইড্রোজেন পার অক্সাইড- জিংক- লেড- বিভিন্ন রকম ডাই- এবং সবগুলো ডাই বা কাপড় রংয়ের উপকরণই কম বেশী বিষাক্ত- আর আছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড- আরও অনেক রাসায়নিক উপাদান হয়তো ব্যবহৃত হয় তবে সেগুলোর বিশদ তালিকা এবং এ সবের গ্রহনযোগ্য পরিমাণ বিষয়ে তথ্য উপাত্ত চাইলেও পাওয়া যাবে না-
ঢাকার বাতাসে নির্ধারিত মাত্রার ৪ থেক পাঁচগুণ লেড আর সালফার ভাসে-ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের শরীর সাস্থ্য ঠিক রাখবার জন্য আমাদের ঢাকা শহর থেকে নির্বাসিত স্কুটার আর পুরোনো বাসগুলো এবং টেম্পুগুলোর সদগতি হয়েছে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোটো ছোটো জেলা উপজেলায় পরিবহনের কাজে নিয়োজিত হয়েছে- ঢাকা শহরের মানুষের মতো সবার শরীর আর সমস্ত বাংলাদেশের আকাশ একই পরিমাণ বিষাক্ততায় লেপে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার-
গাজীপুরের আশেপাশের জমিগুলোর উর্বরতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে- এবং সেখানে সেসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে সেসবের ভেতরে আছে এইসব বিষাক্ত উপাদান- তবে আমাদের পরিবেশের এই নীরব হত্যা নিয়ে কেউ সোচ্চার হয়ে উঠে নি এখনও- আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সকল রাসায়নিক উপাদানই আমাদের কারখানায় ব্যবহৃত হয় তবে এদের কোনো কোনো সংযোগ পরিবেশের জন্য হানিকারক-
আমাদের নিয়মিত হাইড্রোক্লোরিক এসিড প্রয়োজন হয়- আমাদের জিংক- লোহা- সালফারের প্রয়োজন আছে- আমাদের শরীরের মূল গঠন উপাদান কার্বন- তবে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বিষাক্ত একটা দ্রব্য- এটা কিংবা ডিডিটি কিংবা এমন অনেক রাসায়নিক যৌগের নাম করা যায় যা উপজাত হিসেবে তৈরি হচ্ছে তবে এটা বিষাক্ত- প্রাণী এবং উদ্ভিদ উভয়ের জন্যই বিষাক্ত- তবে সত্য হচ্ছে প্রকৃতি অনেক বেশী অভিযোজনবাদী- এটা সহজেই অভিযোজিত হয়- এবং আমাদের শরীরে কিংবা উদ্ভিদের শরীরে এই যৌগগুলো জমা হতে পারে- আমদের পুষ্টির প্রয়োজনে আমরা যে খাদ্য গ্রহন করি সেটার বিষাক্ত উপাদান এবং উপকারী উপাদান সবই শরীরের সঞ্চিত হয়- আমরাও অভিযোজিত হয়ে যাই- তবে যখন জমি বন্ধ্যা হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে এখানে বিষাক্ততার মাত্রা এমন যে উদ্ভিদ ভ্রূন সেটা সহ্য করতে পারছে না-
আমাদের অবশ্য এটাতে মাথা ঘামানোর কিছু নেই- উন্নয়নের চলতি পথে বাড়তি মুনাফার নেশায় আমাদের কিছু পরিমাণ পরিবেশ দুষণ মেনে নিতেই হবে- আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে আছে যুক্তরাষ্ট্র- বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ দুষণ নির্গমকারী দেশ- উন্নত বিশ্বের মডেল হিসেবে আমাদের সামনে আসা এই যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশের ক্ষতি করছে আমরা করলে কোনো ক্ষতি নেই আদতে-
প্রকৃতিকে কতটুকু আহত করলে তা নিরাময়যোগ্য এটা এখনও নিরুপিত নয় তাই সহনশীল মাত্রায় পরিবেশ দুষণ যা নিরাময়যোগ্য তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে- তবে গাজীপুর এবং ঢাকার সন্নিকটে গড়ে উঠা নানা শিল্প কারখানায় বর্জ্য আদতে সেই মাত্রার তুলনায় বেশী রাসায়নিক বর্জ্য ঢালছে প্রকৃতিতে-
চামড়া করখানার বর্জ্যে ভারী হয়ে থাকা ঢাকা থেকে সরে গেছে অনেক চামড়া প্রসেসিং কারখানা- তাদের নির্গত বর্জ্যে এবং প্লাস্টিক কারখানার নির্গত বর্জ্যে বন্ধ্য বুড়িগঙ্গা- আর একই বিষাক্ত উপাদান বয়ে যাচ্ছে মেঘনায়- শীতলক্ষ্যায়- ধলেশ্বরীতে-
আমাদের খুন হয়ে যাওয়া নদীগুলোর জন্য আর বিষাদগাঁথা রচনার প্রয়োজন নেই- আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ- তাদের ছাড়পত্র নিয়েই নদীখুন করে যাচ্ছে পূঁজির লোভে মরিয়া মালিকেরা-
আমাদের উন্নয়নের জন্য আমরা কতটুকু ছাড় দিতে পারি- আমরা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য কান্নাকাটি করছি- তারা নিজেদের দেশে পরিবেশ সচেতন আচরণ করলেও আমাদের দেশে একই মানসিকতা দেখাতে নারাজ- এমন কি প্রবাসী বাংলাদেশিদের কারখানাগুলোতেও এই নিয়ম মানা হয় না- দেশের মাটিতে ইচ্ছামতো দুষণ ঘটালেও কোনো ক্ষতি নেই এমন মানসিকতার কারণ ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ-
তবে আমার আশ্চর্য লাগে বাংলাদেশের মোট বাজেটের ৬ ভাগের ১ ভাগ টাকা অলস পড়ে আছে- অর্থ্যাৎ উপযুক্ত স্থানে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না- এর পরও আমরা ১০০ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ পেলে এমন উলম্ফন করি যেনো বিশ্ব জয় হয়ে গেলো- আমাদের নিজস্ব সম্পদের বিনিয়োগ না করে আমরা বিদেশী উদ্যোক্তাদের হাত ছানি দিয়ে ডাকলে সেটা সংশয়ের জন্ম দেয়-
শ্রীলঙ্কার পরিচয় যুদ্ধপীড়িত দেশ- সেখানের ব্যাংকগুলো অর্থ নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে এবং সেখানে বিনিয়োগ করছে আর আমরা এমন কিছু বিনিয়োগকারীর অপেক্ষায় আছি - আমাদের যে পরিমাণ অলস টাকা পড়ে আছে সেগুলো বিনিয়োগ করে যদি মাত্র ২ শতাংশ লাভ হয় তাহলেও আমাদের জিডিপি বাড়বে ৩ শতাংশ- আমাদের এই লক্ষ্য পূরণে নতুন নতুন বিনিয়োগ ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে- আমাদের এই টাকা বিনিয়োগের সাথে সাথে নির্মাণাধীন কারখানায় এমন পরিশোধন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেনো এখানের নির্গত বর্জ্য আশেপাশের মানুষেরা এবং পরিবেশ বিনষ্ট না হয়-
আমিও টেকসই দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের পক্ষে সাক্ষর করতে চাই তবে তার আগে চাই এমন নিশ্চয়তা যে এই উন্নয়নের গোলকধাঁধাঁয় পড়ে আমরা সামগ্রীক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়-
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।