আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাদ্দাফি হত্যা : পুতুল নাচের ইতিকথা

লিবীয় নেতা গাদ্দাফিকে মরুভূমির অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হয়েছে। গত ২৫ অক্টোবর শেষ রাতে মিসরাতা শহরের সনি্নকটে এক ধূসর মরুভূমিতে তাকে কবর দেওয়া হয়। অনুমান করা হয় কবর বালু দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ তার হদিস না পায়। দুনিয়ার ইতিহাসে অনেক বিশিষ্টজনকে গোপনে সমাহিত করার নজির রয়েছে। আব্বাসীয় খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবু আব্বাসের মৃত্যুর পর বিভিন্ন স্থানে গোপনে ১০০টি কবর খোঁড়া হয়।

এর একটিতে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। মৃত্যুর পর ভবিষ্যতে কেউ যাতে কবর অবমাননার সুযোগ না পায় সে জন্য এ কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়। মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খানকে কবর দেওয়া হয় নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তার মধ্যে। তার শেষকৃত্যের মিছিলে রাস্তায় যাকে পাওয়া যায় তাকেই হত্যা করা হয়। মোঙ্গল বীরের সমাধি আবিষ্কারে পরে অনেক চেষ্টাই চলে।

এমনকি এই আধুনিক যুগেও এ নিয়ে কম গবেষণা হয়নি। কিন্তু গ্রেট খানকে কোথায় দাফন করা হয়েছিল সেটি এখনো অজ্ঞাত। খলিফা আবু আব্বাস এবং মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খান তাদের কবর গোপন রাখতে চেয়েছিলেন প্রতিপক্ষের অবমাননার ভয়ে। মুয়াম্মার গাদ্দাফির জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও তিনি চেয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর আত্মীয়-স্বজনের পাশে যেন কবর দেওয়া হয়। নিজ শহর সিরতে শেষ শয্যা পাতার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এই লিবীয় শাসক।

চারদিকের বিদ্রোহ আর ন্যাটো বাহিনীর বিমান হামলার মুখে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেও গাদ্দাফি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন দৃঢ়ভাবে। বলেছেন যে মাটিতে তার জন্ম সে মাটিতেই তিনি মরতে চান। গাদ্দাফিকে তার জন্মস্থান সিরত শহরে কবর দিতে রাজি হয়নি লিবিয়ার নব্য শাসকরা। সমর্থকরা তার কবরকে স্মৃতির স্মারক হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এই ছিল তাদের ভয়। গাদ্দাফিকে গ্রেফতার করা হয় গত ২০ অক্টোবর।

সিরত শহর থেকে গাড়িবহর নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছিলেন ওই লিবীয় নেতা। ন্যাটো বাহিনীর বোমাবর্ষণে এ শহরের একটি বাড়িও অক্ষত ছিল না। সকালে গাদ্দাফির গাড়িবহর শহর ছেড়ে এগুতেই ন্যাটোর বিমান হামলার সম্মুখীন হন। বেশক'টি গাড়ি ধ্বংস হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বোমা হামলা থেকে রেহাই পেতে আশ্রয় নেন এক সুড়ঙ্গ পথে।

সেখানে চড়াও হয় গাদ্দাফিবিরোধী মিলিশিয়ারা। সুড়ঙ্গ থেকে তাকে টেনে বের করে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। লাথি, ঘুষি, জুতাপেটা কোনো কিছুই বাদ যায়নি। শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পশ্চিমা জোট সমর্থিত লিবীয় সরকারের দাবি গাদ্দাফি ক্রসফায়ারে মারা গেছেন।

কিন্তু মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা চিত্রে দেখা গেছে এ বক্তব্য ডাহা মিথ্যা। গাদ্দাফি মৃত্যুর পরও প্রতিহিংসা থেকে রক্ষা পাননি। ইসলামে মৃতের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণতা অনুমোদন করা হয় না। তবে যুগে যুগে ক্ষমতাধররা ধর্মীয় বিধানকে থোড়াই কেয়ার করেছে। মুবাইয়াপুত্র ইয়াজিদ রাসূলে (সা.)-এর বংশধরদের ওপর জঘন্য প্রতিহিংসার পরিচয় দেন।

কারবালার ঘটনা তারই সাক্ষী। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মুণ্ডু বর্শায় বিদ্ধ করে উমাইয়ারা উল্লাস করেছে। তাদের শাসনামলে ৫৯ বছর ধরে জুমার খুৎবায় রাসূল (সা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.) ও তার স্বামী হজরত আলী (রা.)-এর বংশধরদের অভিসম্পাত দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কাবাঘরে হামলা চালাতেও তারা পিছপা হয়নি। আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর উমাইয়ারাও প্রতিহিংসারর্ িশকার হয়।

জীবিতদের হত্যাই শুধু নয়, কবর থেকে মৃত উমাইয়াদের লাশ বা হাড় উঠিয়ে তা হাতুড়ি দিয়ে পেটানো বা পোড়ানো হয়েছে। মৃতের ওপর প্রতিহিংসা ছিল আইয়ামে জাহেলিয়ার রেওয়াজ। ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হন রাসূল (সা.)-এর প্রিয় চাচা হজরত হামজা (রা.)। মহাবীর হামজা ছিলেন মক্কার পৌত্তলিকদের কাছে আতঙ্কের নাম। মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন সাহস ও নির্ভরতার প্রতীক।

হামজা (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেলে তার লাশের ওপর পৌত্তলিকবাদীরা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও আমির মুবাইয়ার মা হিন্দা হামজার বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে প্রতিহিংসার পরকাষ্ঠা দেখায়। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ ছিলেন এই হিন্দারই পৌত্র। বলছিলাম মৃতের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থের কথা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনিচক্র তার লাশ দাফনের ক্ষেত্রেও ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় দেয়।

কাপড় কাঁচা সাবান দিয়ে লাশ গোসল করানো হয়। বঙ্গবন্ধুর মাজারকে ঘিরে মানুষের মাতম সৃষ্টি হতে পারে এই ভয়ে খুনিচক্র রাজধানী ঢাকার বদলে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। দাফন ছাড়াই তার লাশ পুঁতে রাখা হয় চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত এলাকায়। পরে অবশ্য তার সমর্থকরা লাশ সসম্মানে ঢাকায় এনে দাফনের ব্যবস্থা করে।

মৃতের প্রতি সম্মান দেখানো সভ্য সমাজের বিধান। ধর্মীয় বিধানেও এটি অলক্সঘনীয় নিয়ম হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু বর্বর যুগের প্রতিহিংসার রেওয়াজ থেকে সভ্য মানুষ এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তান থেকে গ্রেফতারের পর মার্কিন সৈন্যরা তাকে বন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করে। বিন লাদেন হাজার হাজার মানুষের প্রাণসংহারের জন্য দায়ী এমন অভিযোগ করা হয়।

কিন্তু তাকে বিচারের সম্মুখীন না করে মার্কিন সৈন্যরা যেভাবে হত্যা করেছে তা সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হবে। মৃত বিন লাদেনকে দাফন না করে তার লাশ সাগরে ডুবিয়ে দেওয়ার মধ্যেও প্রতিহিংসার মনোভাব স্পষ্ট। বলছিলাম গাদ্দাফির কথা। ৪২ বছর ধরে তিনি লিবিয়া শাসন করেছেন। কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাকে তিনি বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।

লিবিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ জ্বালানি তেলের মালিক ছিল সে দেশের প্রতিটি মানুষ। তেল বিক্রির একাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হতো প্রতিটি নাগরিকের ব্যাংক একাউন্টে। রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের বাড়ি করে দিয়েছে এমন নজির গাদ্দাফির শাসনামলে ছাড়া দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোথাও ঘটেনি। বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা ছিল প্রতিটি লিবীয়র অধিকার। তবে এটি ছিল মুদ্রার এক পিঠ।

অন্য পিঠ হলো গাদ্দাফি তার বিরোধী মতামতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন। তার আমলে বিক্ষোভের দায়ে শত শত ছাত্রকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কারাগারে মাত্র তিন ঘণ্টায় ১২শ বন্দীকে হত্যা করা হয়। নিজের শক্তি বাড়াতে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসীদের হাতে রাখার 'ফাউল গেমে' জড়িয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক, রশিদ ও অন্যদের আশ্রয় দিয়েছিলেন গাদ্দাফি।

মনে করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে হলেও এই লিবীয় নেতার হাত ছিল। যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বোমাবাজির ঘটনার পেছনেও গাদ্দাফির ইন্ধন ছিল ওপেন সিক্রেট। এ জন্য তার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে সেটিই হতো যথার্থ। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে গাদ্দাফিকে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হতে হলো কেন? কেন বিন লাদেনের মতো গ্রেফতার করার পর তাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হলো? এর জবাব একটাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি বিন লাদেন বা গাদ্দাফিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সাহসী হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুটের জন্য তারা যে যুদ্ধ শুরু করেছে সে যুদ্ধের শিকার বিন লাদেন ও গাদ্দাফিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে নিজেদের জারিজুরিই ধরা পড়তো। বিন লাদেনকে জঙ্গিনেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই গড়ে তুলেছিল। এমনকি ১৯৬৯ সালে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন গাদ্দাফির ক্ষমতা দখলের পেছনেও ছিল পশ্চিমা শক্তির কালো হাত। দু'জন পশ্চিমাদের নোংরা খেলায় শেষ পর্যন্ত জড়িত থাকতে চাননি বলেই তাদের নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার হতে হয়। বিন লাদেনের আল-কায়দা নাকি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের জানি দুশমন।

কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফিবিরোধী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছে মূলত আল-কায়দা পন্থিরাই। যে আল-কায়দার আস্তানা ধ্বংস করতে মার্কিনিরা দেশে দেশে ড্রোন বিমান পাঠাচ্ছে লিবিয়ার সেই লাদেন পন্থিদের মদদ দেওয়ার পেছনে রহস্য কি? পুতুল নাচের ইতিকথা হয়তো একেই বলে। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট ই-মেইল : Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।