দুঃখের জল,করে ছল-ছল... প্রথমে সাদ্দাম। এবারে গাদ্দাফি। এরপর কে?
পশ্চিমের পছন্দের তুঘলকি স্বৈরশাসকদের জন্য এখন রয়েছে মহার্ঘ শূন্যপদ।
বাগদাদে মার্কিন দখলদারির আট বছর। এই সময়ে ইরাকের সার্বভৌমত্বকে বেআব্রু করে খোঁজা হয়েছে গণ মারণাস্ত্র।
প্রতি ইঞ্চি জমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মেলেনি তার সুলুক সন্ধান। ছয় লক্ষ ইরাকি নথি, ক্যাসেট, ভিডিও রেকর্ড ঘেঁটেও মেলেনি আল কায়েদার সঙ্গে সাদ্দামের যোগাযোগের কোনও তথ্য-প্রমাণ।
লিবিয়া-মিশর কিংবা তিউনিশিয়া নয়।
লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি মুবারক, কিংবা বেন আলির মতো সাম্রাজ্যবাদের পুতুলও নন। বহু বছর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে।
মানবউন্নয়ন সূচকে গোটা আফ্রিকায় শীর্ষে লিবিয়া। এক নম্বরে। শুধু তাই নয়, গোটা মহাদেশে লিবিয়ার মানুষের গড় আয়ু সর্বোচ্চ। এখানে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। সুনিশ্চিত জরুরি সামাজিক পরিষেবা।
রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষার গ্যারান্টি। গোটা আফ্রিকায় সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় এই দেশেরই।
পাশাপাশি আফ্রিকার দেশগুলির ভেতর, এই দেশটির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সব থেকে উন্নত।
বাস্তবেই লিবিয়ার সমস্যা স্বতন্ত্র।
লিবিয়া মানে আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এখন এখানে মেলে উচ্চমানের হালকা তেল। লিবিয়া মানে ৪৬.৪ বিলিয়ন ব্যারেলের আফ্রিকার বৃহত্তম তেলভাণ্ডার। বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ শীর্ষ দশটি দেশের একটি। লিবিয়া মানে দুনিয়ার ১২তম তেল রপ্তানিকারক দেশ। ইউরোপের বৃহত্তম তেল রফতানিকারী দেশ।
লিবিয়া মানে প্রতিদিন ১.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন, যার গুণমান অসাধারণ, শোধন করতে হয় কম। পশ্চিমের শক্তি, বিশেষ করে ইউরোপীয় শক্তিগুলির তাই লিবিয়াকে নিয়ে এত আগ্রহ। তিনটি দেশ লিবিয়ার তেলের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেন। লিবিয়ার তেল রফতানির ২৮ ভাগই যায় ইতালিতে, ১৫ ভাগ ফ্রান্সে, ১০ ভাগ স্পেনে।
তাছাড়া, ১০ ভাগ জার্মানিতে, চার ভাগ বৃটেনে, তিন ভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস তাই লিবিয়ার তেলের ওপর কর্তৃত্ব রাখতে মরিয়া। প্রয়োজনে পশ্চিমের শক্তি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়াকে ভাগ করতেও দ্বিধা করবে না। লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় রয়েছে পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ তেলের মজুত।
ঠিক যেমন ছিল সাদ্দামের ইরাক।
দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ভাণ্ডার। ২০০২ সালের তথ্য, প্রমাণিত তেল সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১,২৫০ কোটি ব্যারেল। তাবৎ বিশ্বের ১১ শতাংশ।
পেট্রোলিয়ামকে যথার্থভাবেই বলা হচ্ছে পুঁজিবাদের প্রাণরস- ব্লাডপ্লাজমা।
সেকারণে, ‘মিশর ও তিউনিশিয়ার সঙ্গে লিবিয়ার পরিস্থিতিকে মিলিয়ে ফেলা অনুচিত’।
বলেছেন ফিদেল কাস্ত্রো।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পর গাদ্দাফি মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিবিয়ার বিদেশনীতিতে অনেকটা পরিবর্তন আনেন। বরং বলা ভালো, পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন। কট্টর মার্কিন স্বার্থ-বিরোধী নীতি থেকে নিজেকে ক্রমান্বয়ে গুটিয়ে আনেন। পশ্চিমের দেশগুলিকে বিরাট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ছাড় দেন।
কিন্তু, সবকিছুর পরেও গাদ্দাফি ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত বাদশাহ ইদ্রিশ নন। যাকে হটিয়ে ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্ষমতা দখল করেছিলেন ২৭ বছরের তরুণ গাদ্দাফি।
ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস চায় নিজেদের পছন্দের সরকার। যা হবে ইদ্রিসের সরকারেরই অনুরূপ। এতে মানুষের আখেরে কোনো লাভ হবে না, হবে সাম্রাজ্যবাদের।
যেমন হয়নি ইরাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের সব স্কোয়ারই এখন তাহরির স্কোয়ার।
বিপরীতে, আরব দুনিয়ায় ওঠা এই বিপ্লবী ঝড়ে আতঙ্কিত সাম্রাজ্যবাদ। উদ্বিগ্ন ন্যাটো। স্বাভাবিক।
এই দেশগুলি থেকে পাওয়া খনিজ তেলকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে উন্নত ধনী দেশগুলির ভোগবাদের অর্থনীতি। এই মধ্যপ্রাচ্য মানে বিশ্বের প্রমাণিত তেলভাণ্ডারের ৫৫.৬ শতাংশ। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ, বিশ্বের চারভাগের মধ্যে একভাগ তেল ব্যবহার করে তারাই। এটা ঠিক, গত শতকের সাতের দশক থেকেই ওয়াশিংটন ওপেক এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো চিরায়ত ক্ষেত্র ছেড়ে বেরিয়ে তেলের নতুন উৎস সন্ধানের কাজ শুরু করেছে।
আবার এও ঠিক, মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্ষেত্র।
তেলসমৃদ্ধ এই অঞ্চলে আধিপত্য আটুট রাখতে তাই মরিয়া সাম্রাজ্যবাদ। এই অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী কোনোরকম শক্তিবিন্যাস রুখতে বদ্ধপরিকর।
সেকারণেই সাদ্দাম। এবারে গাদ্দাফি।
লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ বিরোধের সুযোগকে সদ্ব্যবহারে তৎপর ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস। সহজেই যাতে কবজা করা যায় লিবিয়াকে। গাদ্দাফিকে ‘সাদ্দাম’ বানিয়ে ইরাকের মতো দখল করা যায় লিবিয়াকে।
গাদ্দাফি, কিংবা লিবিয়ার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা ঠিক করার কথা ছিল লিবিয়ার মানুষের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা অন্য কোনো দেশ নয়।
ওবামার দ্বিচারিতা এর মধ্যেই স্পষ্ট।
লাদেন হত্যায় আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বেপরোয়া লঙ্ঘন দেখেছে বিশ্ব। যুদ্ধ এখন ‘মানবতা’র নামে। লিবিয়া ‘মানবিক আগ্রাসনের’ সর্বেশষ দৃষ্টান্ত।
ওয়াশিংটন চায় লিবিয়ায় জমানা বদল।
আবার একই ওয়াশিংটন চায় বাহরাইনে জমানা সুরক্ষিত থাক।
যে হোয়াইট হাউস লিবিয়ায় যুদ্ধে যায় বিরোধীদের আন্দোলনকে ‘নিরাপত্তা’ দিতে, সেই হোয়াইট হাউসের মদতেই সৌদি আরব দুই হাজার সেনা আর ট্যাঙ্ক পাঠায় বাহরাইনে। গণ-প্রতিরোধ থেকে দ্বীপরাষ্ট্রের আল খলিফা রাজ পরিবারকে বাঁচাতে।
পরিহাস হলো, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দু’টি হস্তক্ষেপই সাধারণ মানুষের ‘সুরক্ষার’ নামে।
কারণ, বাহরাইনের এই একরত্তি দ্বীপভূমি একসময় ছিল বৃটিশ উপনিবেশ।
বাহরাইন ছিল পারস্য উপসাগরে রাজার নৌসেনার ঘাঁটি। আর এখন তা ব্যবহার করছে মার্কিন পঞ্চম নৌবহর। তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে বাহরাইন এক বড় আর্থিক কেন্দ্র। বাহরাইন মানে ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত মিত্র। অন্যদিকে, লিবিয়া পুরোপুরি বিশ্বস্ত নয়।
তাছাড়া, লিবিয়ায় রয়েছে বিপুল তেলভাণ্ডার।
লিবিয়ায় জমানা বদল মানে সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে। বাহরাইনে তা নয়।
লিবিয়ায় তাই মার্কিন-বৃটিশ-ফ্রান্সের সামরিক অভিযান।
সর্বস্ব লুটের জন্য মরিয়া ‘মুক্তিদাতারা’।
পেট্রোলিয়ামের লোভ। সম্পদ বাটোয়ারার লোভ। লোভ বিশ্বশাসনের।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার প্রয়োজনে কখনো কাউকে মিত্র বানাচ্ছে। আবার কখনো ওই একই ব্যক্তিকে শত্রু।
সাদ্দাম, গাদ্দাফি ক’দিন আগেও ছিল বন্ধু। নিজেদের শত্রু মোকাবিলায় নিয়মিত সাহায্য পেত পশ্চিমের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে। সেই বন্ধুরাই আজ শত্রুতে পরিণত। এ কারণেই বলা হয় আমেরিকা যার মিত্র, তার শত্রুর দরকার হয় না।
আর ঠুঁটো জগন্নাথ জাতিসংঘ।
(বার্তা২৪ ডটনেট থেকে সংকলিত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।