হ্যা আমি সেই সত্যবাদীকে সত্যবাদী মনে করি হজ্ব বিষয়ক ভুল-ভ্রান্তি
মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া
হজ্বই একমাত্র ইবাদত, যার নিয়ত করার সময়ই আল্লাহ তাআলার নিকট সহজতা ও কবুলের দুআ করা হয়। অন্যান্য ইবাদত থেকে হজ্বের আমলটি যে কঠিন তা এ থেকেই স্পষ্ট। হজ্বের সঠিক মাসআলার জ্ঞান যেমন জরুরি, তেমনি তা আদায়ের কৌশল এবং পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে করণীয় বিষয়গুলোর প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখাও জরুরি। হজ্বে যে সকল ভুল হতে দেখা যায় তা সাধারণত উদাসীনতার কারণেই হয়ে থাকে। তাই নিম্নে সচরাচর ঘটে থাকে এমন কিছু ভুল উল্লেখ করা হচ্ছে।
যেন হাজ্বীগণ এ সকল ভুল-ভ্রান্তি- থেকে বেঁচে সুষ্ঠুরূপে হজ্ব আদায়ে সক্ষম হন। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
ইহরামের দুই রাকাত নামাযের জন্য ইহরাম বিলম্বিত করা
ইহরাম বাঁধার আগে দুই রাকাত নামায পড়ার নিয়ম আছে। তাই অনেককে দেখা যায়, এই দুই রাকাত নামাযের সুযোগ না পাওয়ার কারণে ইহরাম বিলম্বিত করতে থাকে। এমনকি এ নামায পড়তে না পারার কারণে কেউ কেউ ইহরাম ছাড়াই মীকাতে র ভেতরে পর্যন- চলে যায় অথচ ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করা জায়েয নয়।
তারা যেহেতু ইহরামের আগে দুই রাকাত নামায আদায়কে জরুরি মনে করে তাই তারা এমনটি করে থাকে। অথচ ইহরামের আগে নামায পড়া সকল মাযহাবেই মুস্তাহাব; জরুরি কিছু নয়। পক্ষান-রে ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করা নাজায়েয। সুতরাং ইহরামের আগে নামাযের সুযোগ পেলে তো তা আদায় করা চাই, কিন্তু সুযোগ না পেলে সে কারণে ইহরাম বাঁধাকে বিলম্ব করবে না। -সহীহ মুসলিম ১/৩৭৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১২৯০০; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ৯৮; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/৮১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৩; রদ্দুল মুহতার ২/৪৮১-৪৮২
ইহরাম বাঁধার নিয়ম সংক্রান্ত- ভ্রান্তি-সমূহ
অনেকে মনে করে থাকে যে, ইহরামের কাপড় পরে নামায পড়ার পর নিয়ত করলেই ইহরাম সম্পন্ন হয়ে যায়।
এ ধারণা ভুল। এগুলো দ্বারা ইহরাম সম্পন্ন হয় না। নিয়ত আরবীতে করা হোক বা বাংলাতে, সশব্দে করা হোক বা মনে মনে এর দ্বারা ইহরাম সম্পন্ন হয় না; বরং নিয়তের পর তালবিয়া পড়লে ইহরাম পূর্ণ হয়। অতএব বোঝা গেল, ইহরাম সম্পন্ন হয় দুই বস'র সমন্বয়ে : ১. হজ্ব বা উমরার নিয়ত করা ও ২. তালবিয়া পড়া। -জামে তিরমিযী ১/১০২; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ৬৫; মানাকি মোল্লা আলী কারী পৃ. ৮৯
মক্কাগামীদের জন্য জিদ্দায় ইহরাম বাঁধা
কেউ কেউ আগে থেকেই ইহরাম বাঁধা ঝামেলা মনে করে এবং ভাবে যে, ইহরাম বেঁধে নিলেই তো ইহরামের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়ে যাবে।
বিমান যেহেতু জিদ্দায় অবতরণ করবে তাই জিদ্দায় ইহরাম বাঁধার ইচ্ছায় ইহরামকে বিলম্বিত করে। অথচ মীকাতের বাইরের হাজ্বীদের জন্য ইহরাম ব্যতীত মীকাত অতিক্রম করা জায়েয নেই। উপমহাদেশ থেকে গমনকারী হাজ্বীদের জন্য মীকাত হল কারনুল-মানাযিল ও যাতু ইরক যা অতিক্রম করেই জেদ্দায় যেতে হয়। যদি কেউ বিনা ইহরামে মীকাত অতিক্রম করে তবে তার জন্য পুনরায় মীকাতে ফিরে এসে ইহরাম বেঁধে যাওয়া জরুরি। যদি তা না করে তবে দম ওয়াজিব হবে।
যেহেতু বিমানে থাকা অবস্থায় মীকাতের জায়গা নির্ধারণ করা কঠিন বা ঐ সময় ঘুমিয়ে পড়া, অন্যমনষ্ক থাকা ইত্যাদি হতে পারে। তাই বিমানে চড়ার আগে কিংবা বিমানে উঠেই ইহরাম বেঁধে নেওয়ার কথা বলা হয়। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৭০২; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ৮৪; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ৬০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২১; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/৭৬; রদ্দুল মুহতার ২/৪৭৭
সেলাইবিহীন কাপড় বা চপ্পলের জন্য ইহরাম বিলম্বে বাঁধা
কেউ কেউ ইহরামের কাপড় না পরে বিমানে উঠে যায়। অথবা মদীনা থেকে গাড়িতে উঠে পড়ে। এরপর যখন গাড়ি বা বিমানের মধ্যে পরিধানের কাপড় বদলিয়ে ইহরামের কাপড় পরা কষ্টকর হয় কিংবা কাপড় লাগেজে থেকে যায়।
তখন তারা সেলাইবিহীন কাপড় পরতে না পারার কারণে ইহরাম বিলম্বিত করতে থাকে। এমনকি ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করে ফেলে। ফলে দম ওয়াজিব হয়ে যায়। অথচ মীকাত অতিক্রমের আগে সেলাইযুক্ত কাপড়ের অবস্থায়ই যদি ইহরাম বেঁধে নিত এবং গাড়ি বা বিমান থেকে অবতরণের পরেই ইহরামের কাপড় পরে নিত তবে তার অন্যায়টা দম ওয়াজিব হওয়ার মতো বড় হত না। ইহরাম অবস্থায় এ কয়েক ঘণ্টা (১২ ঘণ্টার কম) সেলাই করা কাপড় পরে থাকার কারণে একটি পূর্ণ সদকা ফিতর আদায় করে দিলেই চলত।
-জামে তিরমিযী ১/১৭১; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ৩০০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৪২; রদ্দুল মুহতার ২/৫৪৭
ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করা যাবে না
কেউ কেউ মনে করে, যে কাপড়ে ইহরাম বাঁধা হয়েছে সে কাপড় হালাল (ইহরাম শেষ) হওয়ার আগ পর্যন- বদলানো যাবে না। এটা একটা ভুল ধারণা। ওই কাপড় নাপাক না হলেও বদলানো যাবে। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫০১০, ১৫০১১; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ৯৮; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ৭১
তাওয়াফের সময় ছাড়াও ইযতিবা করা
অনেককে দেখা যায়, ইহরামের প্রথম থেকেই ইযতিবা (বাম কাঁধের উপর চাদর রেখে ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে পরিধান করা) করে থাকে এবং হালাল হওয়া পর্যন- এ অবস্থায় থাকাকে শরয়ী হুকুম মনে করে। এটি ভুল।
এভাবে নামায পড়লে নামায মাকরূহ হবে। আবার কেউ কেউ তাওয়াফের সময় ইযতিবা করে এবং এ অবস্থায় সায়ীও করে থাকে এবং তাওয়াফের মতো সাঈতেও তা করা শরয়ী বিধান মনে করে। অথচ সাঈতে ইযতিবা’র বিধান নেই। এমনকি সকল তাওয়াফেও এটি সুন্নত নয়; বরং যে তাওয়াফের পর সাঈ করতে হয় শুধু সেই তাওয়াফেই ইযতিবা করতে হয়। সুতরাং নফল তাওয়াফে ইযতিবা নেই।
কেননা নফল তাওয়াফের পর সাঈ নেই। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৫; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১২৯; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২১৭
তামাত্তুকারীর একত্রে হজ্ব ও উমরার ইহরামের নিয়তে তালবিয়া পড়া
কোনো কোনো তামাত্তু হজ্বকারী প্রথমে ইহরাম বাঁধার সময় একত্রে হজ্ব ও উমরার নিয়ত করে ফেলে। এ ভুলটি ব্যলটি হাজ্বীদের ক্ষেত্রে বেশি হতে দেখা যায়। কেননা, তারা প্রায় নিজেরাই পরস্পর দেখাদেখি করে ইহরাম বেঁধে থাকে।
হজ্বে-তামাত্তুর ক্ষেত্রে নিয়ম হল, প্রথমে শুধু উমরার নিয়ত করবে।
বাইতুল্লাহ পৌঁছে উমরার কাজ সেরে হালাল হবে। তারপর আবার হজ্বের সময় হজ্বের নিয়তে ইহরাম বাঁধবে। -সহীহ বুখারী ১/২১২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩৮; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২৭১; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/৮২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫৩৫-৫৩৭
ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের চেহারা খোলা রাখা
ইহরাম অবস্থায়ও মহিলাদের চেহারার পর্দা করা জরুরি। যেহেতু নারী-পুরুষ সকলের জন্যই এ অবস্থায় চেহারায় কাপড় লাগানো নিষেধ, তাই অনেক মহিলা মনে করে যে, ইহরাম বাঁধার পর চেহারা খোলা রাখতে হবে। চেহারার পর্দা করা যাবে না।
ফলে পর্দানশীন মা-বোনদের অনেককেই পুরো হজ্বের সফরে ইহরাম অবস্থায় চেহারা খুলে চলাফেরা করতে দেখা যায়। অথচ এ ধারণা ঠিক নয়। চেহারায় কাপড়ের স্পর্শ ছাড়াও চেহারার পর্দা করা সম্ভব। এজন্য আজকাল ক্যাপ পাওয়া যায়, যা পরিধান করলে মুখের পর্দাও হয়ে যায়, আবার মুখে কাপড় না লাগানোর উপরও আমল হয়ে যায়। প্রকাশ থাকে যে, ক্যাপের উপর দিয়ে নেকাব পরিধান করলে বাতাসে কিংবা চলাফেরার সময় অনেক ক্ষেত্রে নেকাবের কাপড় চেহারায় লেগে যায়।
এতে অনেকে বিব্রত হন যে, না জানি ইহরাম পরিপন্থী হয়ে গেল কি না। কিন্তু মাসআলা হল, এত অল্প সময় লাগলে কোনো অসুবিধা হয় না। তাই এই পন্থা অবলম্বন করে হলেও চেহারার পর্দা করা জরুরি। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৫৩৯, ১৪৫৪০; সুনানে আবু দাউদ ১/২৫৪; হিন্দিয়া ১/২৩৮; মানাসিক ১১৫; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/১৫৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪৮৮, ৫২৭
ইহরাম অবস্থায় বাইতুল্লাহ স্পর্শ করা
বাইতুল্লাহর দেয়ালে ও গিলাফে নিচ থেকে প্রায় ৭/৮ ফুট পরিমাণ চতুর্দিকেই সুগন্ধি লাগানো থাকে, তাই যে কোনো অংশে হাত লাগানোর দ্বারা হাতে সুগন্ধি লেগে যায়, যা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ।
মুমিন বান্দা যখন বিরাট ত্যাগ-তিতিক্ষার পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাইতুল্লাহ শরীফের একেবারে নিকটে পৌঁছে যায় তখন আবেগের বশবর্তী হয়ে ইহরামের অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে বাইতুল্লাহয় হাত লাগায়, আলিঙ্গন করে।
ফলে ইহরাম অবস্থায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সুগন্ধি লেগে যায়। তাই ইহরাম অবস্থায় গিলাফে বা কাবা ঘরে হাত দিবে না। এ সময় আবেগের বশবর্তী না হয়ে হুঁশকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। একটু সতর্ক হলেই এ বড় ভুল থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। -সহীহ মুসলিম ১/৩৭৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২৪; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/১৪০; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৮৭
বাইতুল্লাহর যত্রতত্র চুম্বন, স্পর্শ ও আলিঙ্গন করা
অনেককে বাইতুল্লাহর কোনো স্থান ফাঁকা পেলেই গিলাফ ধরতে, দেয়ালে চুমু দিতে, সীনা লাগাতে ও স্পর্শ করতে দেখা যায়।
অথচ বাইতুল্লাহর সব স্থান স্পর্শ করা বা চুমু খাওয়া ছওয়াবের কাজ নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে কেবল সীমিত কিছু স্থান স্পর্শ করা আর কিছু ক্ষেত্রে চুমু খাওয়ার কথা বর্ণিত আছে। যা নিম্নরূপ : ১. হাজরে আসওয়াদ। হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করা, চুমু খাওয়া হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ২. রুকনে ইয়ামানী।
বাইতুল্লাহর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ হল রুকনে ইয়ামানী। এই কোণে ডান হাত বা উভয় হাত দ্বারা স্পর্শ করা সুন্নত। কেউ কেউ চুমু খাওয়ার কথাও বলেছে। ৩. মুলতাজাম। এটি হাজরে আসওয়াদ থেকে বাইতুল্লাহর দরজা পর্যন্ত- স্থান।
এখানে সীনা, গাল ও উভয় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে দুআ করার কথা হাদীসে বর্ণিত আছে। ৪. কাবা ঘরের দরজার চৌকাঠ ধরা এবং দুআ করা। -জামে তিরমিযী ১/১৭৪; সহীহ মুসলিম ১/৪১২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৯৬৪; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১৩৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৫; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২২৭
তাওয়াফ অবস্থার ভ্রান্তি-সমূহ
তাওয়াফে নির্দিষ্ট দুআকে জরুরি মনে করা
তাওয়াফের প্রতি চক্করের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট দুআ পড়াকে জরুরি মনে করে। ফলে নির্দিষ্ট ঐ দুআ শেষ হয়ে গেলে অন্য দুআ পড়ে না। নির্দিষ্ট দুআটি নিজের মুখস্থ না থাকলে অন্যের সাহায্য নেয়।
এ ধারণা ভুল। তাওয়াফ অবস্থায় নির্দিষ্ট দুআ পড়া জরুরি নয়। রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মাঝে ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্ দুনিয়া হাসানাহ ... ’ এই দুআ পড়া উত্তম। এটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ ছাড়া পুরো তাওয়াফে মাছূর দুআ তথা কুরআন-হাদীস বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত যে কোনো দুআই পড়া যেতে পারে।
এমনিভাবে অন্য যে কোনো ভালো অর্থবোধক দুআও পড়া যেতে পারে। দুআ আরবীতে করাও জরুরি নয়। নিজের ভাষায় করা যেতে পারে।
জামাতবদ্ধ হয়ে তাওয়াফ করা
অনেকে জামাতবদ্ধ হয়ে তাওয়াফ করে এবং জামাতের মধ্যে একজন মুখস' বা দেখে দেখে উঁচু আওয়াজে দুআ পড়ে আর তার সঙ্গে পুরো জামাত সমস্বরে দুআ পড়তে থাকে। এ নিয়মে একাধিক আপত্তিকর বিষয় রয়েছে-
ক) সমস্বরে দলবদ্ধভাবে দুআ পড়ার কারণে অন্যদের একাগ্রতা বিঘ্নিত হয়।
খ) এভাবে দুআ পড়া-পড়ানোর রেওয়াজ সালাফ থেকে প্রমাণিত নেই। এজন্যও তা ত্যাগ করা দরকার। গ) আরো একটি বড় ক্ষতি হল, দলবদ্ধভাবে চলার কারণে মাতাফে ভিড় সৃষ্টি হয়। অন্যদের উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। এতে অন্যদের ভীষণ কষ্ট হয়।
অপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য এ ধরনের পরিসি'তি সৃষ্টি করা খারাপ।
যদি সকলেই নিজে নিজে চলত এবং দেখে দেখে দুআ না পড়ত, যা মুখস' আছে তা-ই পড়ত তাহলে মাতাফে হঠাৎ যে চাপ সৃষ্টি হয় তা অনেক কমে যেত এবং সকলেই একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার ধ্যানে নিমগ্ন থেকে দুআ ও তাওয়াফ করতে পারত। -ইলাউস সুনান ১০/৮২; বাদায়েউস সানায়ে ২/৩৪০; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১৩৫; রদ্দুল মুহতার ২/৪৯৭-৪৯৮
পুরো তাওয়াফে রমল করা
অনেককে দেখা যায়, তাওয়াফের ৭ চক্করেই রমল করে থাকে। আবার কেউ কেউ নফল তাওয়াফেও রমল করে। মনে করে, রমল সকল তাওয়াফে এবং তাওয়াফের সব চক্করেই করতে হয়।
অথচ এটি ভুল। রমল শুধু ওই তাওয়াফেই করতে হয় যে তাওয়াফের পর সাঈ আছে। আর এই তাওয়াফেরও সব চক্করে নয় শুধু প্রথম তিন চক্করে।
অন্যকে কষ্ট দিয়ে রমল করা
রমল করা সুন্নত। মাতাফে কোন কোন সময় অস্বাভাবিক ভিড় হয়।
বিশেষ করে হজ্বের আগে দু’এক দিন এবং যিলহজ্বের ১০-১১ তারিখে। তখন মাতাফে চলাই মুশকিল হয়। সামান্য নড়া-চড়ার প্রভাব পড়ে অনেক দূর পর্যন-। কিন্তু আশ্চর্য হল, ওই কঠিন ভিড়েও কাউকে কাউকে রমল করতে দেখা যায়। এতে নিজেরও প্রচুর কষ্ট হয়।
বিশাল জনসমুদ্রকেও কষ্ট দেওয়া হয়। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয়, রমলটা তাওয়াফের ফরয অংশ। এজন্যই বুযুর্গগণ বলেন, ‘যথাযথ হজ্ব করতে হলে সামান্য ইলম যথেষ্ট নয়; বরং প্রচুর ইলম এবং তার সঙ্গে অনেক বেশি আকলের প্রয়োজন। ’’ রমল ছাড়াও তাওয়াফ আদায় হয়ে যায়। তাই প্রচণ্ড ভিড়ে অন্যকে কষ্ট দিয়ে রমল করা যাবে না; বরং তখন স্বাভাবিকভাবে চলবে।
চলতে চলতে কখনো সামান্য ফাঁকা পেলে এবং অন্যের কষ্ট না হলে স্বাভাবিক গতিতে রমলের চেষ্টা করবে। -সহীহ মুসলিম ১/৪১০; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১৩৩-১৩৪; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২১৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৬
মহিলাদের রমল
রমল শুধু পুরুষের জন্য। এ বিধানটি মহিলাদের জন্য নয়। কিন্তু কখনো কখনো মহিলাদেরকেও তা করতে দেখা যায়। এটি ভুল।
-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩১১০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৩৫; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২৩৬
তাওয়াফ অবস্থায় কাবা শরীফের দিকে সীনা করা
তাওয়াফকারী পুরো তাওয়াফ অবস্থা্য় বাইতুল্লাহকে বাম পাশে রেখে চলবে। শুধু রুকনে ইয়ামানী ছোঁয়ার সময় (যদি ছোঁয়া সম্ভব হয়) যেহেতু উভয় হাত কিংবা ডান হাতে বাইতুল্লাহ স্পর্শ করতে হবে তাই তখন বাইতুল্লাহর দিকে সীনা ফিরানো যাবে। কিন্তু সীনা বাইতুল্লাহর দিকে করলে ওই স্থান থেকেই আবার বাইতুল্লাহ বাম দিকে রেখে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। তারপর হাজরে আসওয়াদের নিকট গিয়ে আবার সেদিকে ফিরবে। কিন্তু অনেক তাওয়াফকারীকেই এর ব্যতিক্রম করতে দেখা যায়।
যেমন :
ক. হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানী ছাড়াও অন্য দুই কোণে বা ফাঁকা পেলেই বাইতুল্লাহর দেয়ালে চুম্বন করে থাকে বা আলিঙ্গন করে থাকে। ফলে তাদের সীনা বাইতুল্লাহর দিকে হয়ে যায়। অথচ তাওয়াফের অল্প অংশও যদি কাবা ঘরের দিকে সীনা ফিরিয়ে করা হয় তবে তা শুদ্ধ হবে না। প্রকাশ থাকে যে, তাওয়াফ অবস্থায় হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানী ব্যতীত অন্য স্থানে বাইতুল্লাহর দিকে সীনা ফিরানো নিষিদ্ধ। খ. দলবদ্ধভাবে চলতে গিয়ে বা দলের অন্যদের খবর নিতে গিয়ে কিংবা ভিড়ের কারণে বাইতুল্লাহর দিকে সীনা ঘুরে যায় এবং ওইভাবেই কিছু দূর চলতে থাকে এতে ঐ অংশের তাওয়াফ সহীহ হয় না।
তাই কখনো এমন ঘটে গেলে যেখান থেকে ঘুরে গেছে সেখান থেকে যথানিয়মে পুনরায় তাওয়াফ করতে হবে। -সহীহ মুসলিম ১/৪০০; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১৫৩; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১১৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৫; আলমুগনী ৫/২২৫; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৯৪
নফল তাওয়াফের পর দুই রাকাত নামায না পড়া বা বিলম্বে পড়া
অনেককে দেখা যায় একের পর এক নফল তাওয়াফ করতেই থাকে। একটি তওয়াফ শেষ হলে তাওয়াফের দুই রাকাত নামায পড়ে না। তাদের এ আমল দেখে মনে হয়, শুধু ফরয ও ওয়াজিব তাওয়াফের পরই এই দুই রাকাত নামায পড়তে হয়। এ ধারণা ভুল।
ফরয ও ওয়াজিব তাওয়াফের মতো নফল তাওয়াফের পরও দুই রাকাত নামায পড়া ওয়াজিব এবং বিনা ওজরে একাধিক তাওয়াফের নামাযকে একত্রে পড়া মাকরূহ। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৭০৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৭; রদ্দুল মুহতার ২/৪৯৯; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১৫৫; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১১৭
তাওয়াফ পরবর্তী দুই রাকাত পড়ার স্থান নিয়ে বিভ্রান্তি-
এই দুই রাকাত নামায মাকামে ইবরাহীমীকে সামনে রেখে পড়া সুন্নত। কিন্তু অনেককে দেখা যায়, মাকামে ইবরাহীমীকে পেছনে রেখে মাকামে ইবরাহীমী ও বাইতুল্লাহর মাঝের ফাঁকা জায়গায় পড়ে। এক তো এই স্থানে নামায পড়লে তওয়াফকারীদের চলাচলে খুব সংকীর্ণতা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত এই দুই রাকাত নামায যে মাকামে ইবরাহীমীর পেছনে পড়া সুন্নত সে সুন্নতটিও আদায় হয় না।
-সুনানে নাসাঈ ২/৩১; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক হাদীস : ৮৯৬০; মানাসিক ১৫৬; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১১৬; আলমুগনী ৫/২৩১; রদ্দুল মুহতার ২/৪৯৯
মাকামে ইবরাহীমীর পেছনে তাওয়াফের নামায পড়াকে জরুরি মনে করা
অনেকে এই স্থানেই নামায আদায় করাকে জরুরি মনে করে বা কার্যত এই জায়গাকেই নামাযের একমাত্র জায়গা মনে করে। ফলে তাদেরকে জানবাজি রেখে সেখানে নামায আদায় করতে দেখা যায়। কেউ কেউ দুই তিনজনের সহযোগিতা ও বেষ্টনীতে নামাযে দাঁড়ায়। ফলে হাজার হাজার তাওয়াফকারী ভীষণ চাপের মুখে পড়ে। এগুলো হল মূর্খতা ও ইবাদতের নামে বাড়াবাড়ি।
এতে ছওয়াব হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আরো গুনাহ হয়। তাওয়াফের পর দুই রাকাত নামায পড়া ওয়াজিব। কিন্তু মাকামে ইবরাহীমী সামনে রেখে পড়া সুন্নত। এ সুন্নত যেমন মাকামে ইবরাহীমীর নিকট পড়লে আদায় হয়, তেমনি মাকামে ইবরাহীমীকে সামনে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে পড়লেও আদায় হয়। অবশ্য ওই বরাবর ভিড় থাকলে মসজিদে হারামের যে কোনো স্থানে পড়া যেতে পারে।
এমনকি মসজিদে হারামের বাইরে হেরেমের এলাকায় পড়লেও কোনো অসুবিধা নেই। সুতরাং ওই স্থানে পড়ার সুন্নত আদায় করতে গিয়ে অন্যকে কষ্ট দিয়ে হারামে লিপ্ত হওয়া বোকামি। -ইবনে আবী শায়বা : ১৫২৬৭, ১৫২৬৮; সুনানে নাসাঈ ২/৩১; মানাসিক ১৫৬; হিন্দিয়া ১/২২৬; রদ্দুল মুহতার ২/৪৯৯
সাঈ সংক্রান্ত- ভুল-ভ্রান্তি-
সাঈতে নির্দিষ্ট দুআকে জরুরি মনে করা
তাওয়াফের মতো এখানেও প্রতি সাঈতে কিছু নির্দিষ্ট দুআকে জরুরি মনে করা হয়। ফলে জামাতবদ্ধ হয়ে একজন বলতে থাকে আর বাকিরা তার সঙ্গে সমস্বরে পড়তে থাকে। এতে ঠিক তাওয়াফের মতোই খারাবীগুলোর সম্মুখীন হতে হয়।
অথচ এখানেও নির্দিষ্ট দুআ পড়া জরুরি নয়। কুরআন-হাদীসের দুআ বা ভালো অর্থবোধক যে কোনো দুআই পড়া যেতে পারে। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৭১২, ১৪৭১৪; মানাসিক ১৮০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৬; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ.১২৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫০০
সাফা পাহাড়ের দুআ
অনেককে দেখা যায়, সাত চক্করেই সাফা পাহাড়ে এসে মাসনূন দুআটি- পড়ে, অথচ সাঈ শুরু করার সময় শুধু প্রথমবারই সাফা পাহাড়ে চড়ে এই দুআ পড়া সুন্নত। -সুনানে নাসাঈ ২/৩৩; মানাসিক ১৭১; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ.১২৯
সাঈতে ইযতিবা করা
অনেকে মনে করে তাওয়াফের মতো সাঈতেও ইযতিবা অর্থাৎ ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর চাদর পরিধান করা সুন্নত। তাই তারা সাঈতেও ইযতিবা করে থাকে।
অথচ সাঈতে ইযতিবা নেই। চাদর স্বাভাবিকভাবে পরে থাকতে হয়। -মানাসিক ১২৯; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ.১৩০; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২১৭; রদ্দুল মুহতার ২/৫০০
নফল সাঈ
কারো কারো ধারণা, নফল তাওয়াফ করা যেমন ছওয়াবের কাজ তেমনিভাবে নফল সাঈ করাও ছওয়াবের কাজ। অথচ সাঈ শুধু উমরা ও হজ্বের ক্ষেত্রেই ইবাদত। অন্য সময় সাফা মারওয়ার সাঈতে কোনো নেকি নেই।
-সহীহ মুসলিম ১/৪১৪; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ.১৩৫; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/৩১৭; রদ্দুল মুহতার ২/৫০২
সামান্য ওজরে হুইল চেয়ারে সাঈ ও তাওয়াফ করা
অনেকে সামান্য ওজরে কিংবা ভিড়ের ভয়ে পায়ে হেঁটে তাওয়াফ-সাঈ না করে হুইল চেয়ারে করে থাকে। সাধারণত ধনাঢ্য লোকদের মধ্যে এ রকম দেখা যায়। অথচ সামান্য অজুহাতে হুইল চেয়ারে তাওয়াফ ও সাঈ করা জায়েয নয়। এভাবে তাওয়াফ বা সাঈ করলে তা আবার পায়ে হেঁটে করা জরুরি। অন্যথায় দম ওয়াজিব হবে।
অবশ্য হাঁটতে অক্ষম কিংবা এমন রোগী যে হেঁটে তাওয়াফ বা সাঈ করলে তার অসুখ আরো বেড়ে যাবে তাদের জন্য ‘হুইল চেয়ারে’ তাওয়াফ করা বা সাঈ করা জায়েয। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৩০৩, ১৩৩১১, ১৩৩১৫; বাদায়েউস সানায়ে ২/৩১৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৪৭; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২৪৯-২৫০
সায়ীতে মহিলাদের দৌড়ানো
সবুজ দুই পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে মধ্যম গতিতে দৌড়ানো পুরুষের জন্য মুস্তাহাব। কিন্তু কোনো কোনো মহিলাও এ স্থান দৌড়ে পার হয়। অথচ মহিলাদের জন্য এখানেও দৌড়ানো নিষেধ।
হজ্বের ইহরামের স্থান নিয়ে বিভ্রান্তি-
হারামে অবস্থানকারীদের অনেকে হজ্বের ইহরাম মসজিদে হারামে গিয়ে করাকে জরুরি মনে করে অথচ সেখানে ইহরাম বাঁধা জরুরি নয়, উত্তম।
হজ্বের ইহরাম হোটেল বা অবস্থানের জায়গাতেও করা যাবে। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১৫৯৩১, ১৫৯৩৩; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১৮৭; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ.২১৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩৯; রদ্দুল মুহতার ২/৪৭৮
মিনার দ্বন্দ কলহ
মূলত ‘মিনা’ থেকে যেহেতু হজ্বের কাজ শুরু হয় তাই শয়তান সুযোগে থাকে যে, হজ্বের শুরুতেই এমন কাজ করিয়ে দিবে যার দ্বারা হজ্বের রূহ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন-মিনায় অবস্থানের জায়গা নিয়ে হাজীদের মধ্যে ঝগড়া এবং গালিগালাজ পর্যন- হতে দেখা যায়। আর এটা যেন মিনাতে হতেই হবে। ওই মাঠেও কি আরামে শোয়ার জন্য ঝগড়া করতে হবে? এটা কি অসম্ভব যে, নিজেদের বিছানা তাঁবুর বাইরে রেখে অন্য ভাইদেরকে ভালোভাবে জায়গা করে দিব।
সৌদির অনেক হাজ্বী রাস্তাতেই মিনার দিনগুলো অতিবাহিত করে দেন। আর আমরা সেখানে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হই। অথচ পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, তাঁবুর ভেতরেই সকলের ভালোভাবে জায়গা হয়ে যায়। কুরআন মজীদে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ইরশাদ হয়েছে-(তরজমা) ‘হজ্বের সময় কোনো ঝগড়া-বিবাদের অবকাশ নেই।
’ তাই এ ব্যাপারে খুব সাবধান থাকা উচিত। অনেক বুযুর্গই মিনাতে শয়তানের ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য খুব সতর্ক করে থাকেন। -সহীহ বুখারী ১/২৪৫; মানাসিক ১১৭; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ৮৫; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/১১২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৮৭
আরাফা সংক্রান্ত- ভুল-ভ্রান্তি-
তালবিয়া পড়া সংক্রান্ত- ভ্রান্তি-
মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় মানুষ দলে দলে চলতে থাকে, অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু খুব কমই সশব্দে তালবিয়া পড়তে শোনা যায়। অথচ ইহরাম বাঁধার পর থেকে ১০ তারিখ পাথর মারার আগ পর্যন- সশব্দে তালবিয়া পড়া গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত।
এ সময় অন্যান্য যিকিরের চেয়ে এটিই অধিক পরিমাণে করতে বলা হয়েছে। আর সশব্দে পড়লেও এক-দু’বার পড়ে থেমে যায়। অথচ তালবিয়া যখন পড়বে তখন একত্রে তিনবার পড়া মুস-াহাব। -সহীহ মুসলিম ১/৪১৫; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১৪১৭৮; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ১০৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৩, ১/২৩৫; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/১০১; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৯১, ২/৪৮৩-৪৮৪
মসজিদে নামিরার মেহরাবে ও তার পাশে অবস্থান করা
মসজিদে নামিরার মেহরাবসহ সামনের কিছু অংশ ‘উকুফের’ জায়গা নয়। কিন্তু অনেক হাজ্বী সাহেবকে আরাফার পুরো সময়ই সেখানে অবস্থান করতে দেখা যায়।
আবার অনেক হাজ্বী সাহেব আরাফার বাইরেও অবস্থান করে থাকে। আরাফায় অবস্থান করা ফরয। এটা ছাড়া হজ্ব আদায় হবে না। তাই এ ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১৪০৬৩, ১৪০৬৮; মানাসিক ২০৪; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৫৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫০৬
সূর্যাসে-র আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করা
সূর্যাসে-র আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করা নাজায়েয।
সৌদি সরকারের পক্ষ থেকেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যেন বাসগুলো সূর্য ডোবার আগে না ছাড়ে। কিন্তু বহু লোক সূর্য ডোবার অনেক আগেই মুযদালিফার দিকে রওনা হয়ে যায়। এটা মারাত্মক ভুল। মনে রাখতে হবে, সূর্যাসে-র আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করলে দম ওয়াজিব হয়ে যায়। এমনভিাবে সূর্য ডোবার আগেই যাওয়ার প্রস'তি নিয়ে অনেককে ব্যস- থাকতে দেখা যায়।
অথচ ওই সময় তাসবীহ, দুআ ও মুনাজাতের মূল সময়। আর এ সময়টি অনেকেরই বড় উদাসীনতায় কাটে। যা মোটেও কাম্য নয়। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১৫৪১৯; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২১০; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫০৮
আবার কেউ কেউ মুযদালিফা নিশ্চিত না হয়েই নামায পড়ে নেয়। এটাও ভুল।
অথচ একটু সচেতন হলেই মুযদালিফায় অবস্থান করা ও নামায পড়া সম্ভব।
মুযদালিফায় অবস্থান সংক্রান্ত- ভুল-ভ্রান্তি-
মাগরিব ও ইশা পড়া নিয়ে ভ্রান্তি-
মাগরিব ও ইশা মুযদালিফায় গিয়ে একত্রে পড়া জরুরি। এটা তো ঠিক আছে। কিন্তু কখনো ভিড়ের কারণে গাড়ি ফজরের আগে মুযদালিফায় পৌঁছতে পারে না। তখন অনেকে মুযদালিফায় পড়ার আশায় এ দুই ওয়াক্ত নামায কাযা করে ফেলে।
অথচ মাসআলা হল, ইশার সময়ের মধ্যে মুযদালিফায় পৌঁছার ব্যাপারে আশঙ্কা থাকলে পথেই মাগরিব-ইশা পড়ে নেওয়া জরুরি। অন্যথায় এ দুই ওয়াক্ত কাযা করার গুনাহ হবে। -মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২১৬; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৬৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫১০
মুযদালিফার বাইরে অবস্থান
কোনো কোনো হাজ্বী সাহেবকে মুযদালিফার বাইরে অবস্থান করতে দেখা যায়। অথচ মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা এবং সুবহে সাদিকের পর কিছু সময় ‘উকুফ’ করা ওয়াজিব। তাই মুযদালিফার সীমানা ভালোভাবে দেখে তার ভেতরেই অবস্থান করা জরুরি।
-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১৪০৭১; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২২০; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৬৬-১৬৭; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২৮২; রদ্দুল মুহতার ২/৫১১
মুযদালিফায় পাথর সংগ্রহকে জরুরি মনে করা
প্রথম দিনের ৭টি কংকর মুযদালিফা থেকে নেওয়া মুস্তাহাব। কিন্তু অনেক হাজ্বী মুযদালিফা থেকে তিন দিনের সকল পাথর সংগ্রহ করা জরুরি মনে করে থাকে। ফলে মুযদালিফায় পৌঁছতে দেরি হয়ে গেলে সুবহে সাদিকের পরও অনেককে পাথর কুড়াতে দেখা যায়। অথচ সুবহে সাদিকের পর থেকে চারদিক ফর্সা হওয়া পর্যন- দুআ-দরূদ ও যিকির-আযকারে মশগুল থাকা সুন্নত। এটিই উকুফে মুযদালিফার প্রধান সময়।
আর এ সময় পাথর কুড়াতে ব্যস- থাকা অত্যন- ভুল কাজ। পাথর নেওয়ার উত্তম সময় হল মুযদালিফা থেকে মিনায় যাওয়ার পথে কিংবা মুযদালিফায় রাতে পৌঁছে গেলে তখনও কুড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৬২২, ১৩৬২৪; মানাসিক ২২২; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৬৮; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২৮৮; রদ্দুল মুহতার ২/৫১৫
রমী সংক্রান্ত- ভুল-ভ্রান্তি সাতের অধিক পাথর নিক্ষেপ করা অনেকে সাতের অধিক পাথর মেরে থাকে। এটি শরীয়ত পরিপন'ী কাজ। এ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৭৫; মানাসিক ২৫০; রদ্দুল মুহতার ২/৫১৩ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যকে দিয়ে পাথর মারানো সামান্য ওজর বিশেষত মহিলাদের পক্ষ থেকে বদলি হিসেবে অন্যকে দিয়ে পাথর মারানো হয়। অথচ দুর্বল ও মহিলারাও রাতের বেলা অনায়াসে পাথর মারতে পারে। জামরা পর্যন- হেঁটে বা গাড়িতে গিয়ে মারার ব্যবস্থা এবং সামর্থ্য থাকলে অন্যকে দিয়ে পাথর মারা জায়েয নয়। এতে কংকর মারার হক আদায় হবে না। এক্ষেত্রে পুনরায় কংকর মারা ওয়াজিব।
না মারলে দম ওয়াজিব হবে। -ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৩৯৪; মানাসিক ২৪৭; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৮৭ পাথর ছাড়া অন্য বস' নিক্ষেপ করা অনেকে মনে করে ওই স-ম্ভগুলোই শয়তান। তাই সেখানে জুতা-স্যাণ্ডেলও মারতে দেখা যায়। এটা মূর্খত। জুতা স্যান্ডেল মারা জায়েয নেই।
স-ম্ভগুলো তো হল পাথর নিক্ষেপের জায়গা নির্ধারণের আলামতমাত্র। এখানে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক পাথরই নিক্ষেপ করা জরুরি। ব্যতিক্রম করার অবকাশ নেই। -মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২৪৮; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৮৮; আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২৮৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫১৪ মাথা আংশিক হলক করা কেউ কেউ মাথার অর্ধেক হলক করে বাকি অর্ধেকে চুল রেখে দেয়। এমন একজনকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হল, উত্তরে সে বলল, ‘যেহেতু পরে আরেকটি উমরা করব তাই অর্ধেক হলক করেছি।
দ্বিতীয় উমরা করে বাকিটা হলক করব। ’ এটাও ভুল। হজ্বের সময় তো নয়ই অন্য সময়ও এভাবে অর্ধেক হলক করা নিষেধ। তাই পরবর্তী সময়ে আরো উমরা করলেও প্রথমবারেই পূর্ণ মাথা হলক করে নিবে। পরে উমরা করলে ওই হলকের উপর খুর বা ব্লেড ঘুরিয়ে নিলেই চলবে।
এছাড়া মাথার চুল যদি আঙ্গুলের করের চেয়ে বড় থাকে তাহলে প্রথমবার চুল একেবারে ছোট ছোট করে কেটে নিতে পারে। আর পরবর্তী উমরা করে হলক করে নিবে। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১৩৭৯৯, ১৪৭৮২; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২২৯; গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৭৪; রদ্দুল মুহতার ২/৫১৬ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে উমরা করা বা করানো অনেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের জন্য উমরা করে থাকে। এটা সম্পূর্ণ নাজায়েয। যে এমন করবে তার উমরা আদায় হবে না এবং যার পক্ষ থেকে করা হবে সেও কোনো ছওয়াব পাবে না।
-আলমুগনী ইবনে কুদামা ৫/২৩; রদ্দুল মুহতার ২/৬০১ ইহতিয়াতি দম হাজ্বীদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রচলন রয়েছে যে, হয়ত অজানে-ই কত ভুল হয়েছে, যে কারণে দমও ওয়াজিব হয়েছে। তাই সতর্কতামূলক অনেকেই দম দিয়ে থাকে। এটিও ভুল। শরীয়তে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে দম দেওয়ার কোনো বিধান নেই। এটি শরীয়তের হুকুমের মধ্যে নিজ থেকে সংযোজনের শামিল।
তাই তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ভুল আমলের কোনো শেষ নেই। মাসআলা না জানা বা অসচেতনতার কারণে কত শত ভুলই হয়ে যেতে পারে। তাই শুদ্ধ আমলের জন্য সঠিকভাবে মাসআলা জানা জরুরি। এখানে কেবল ঐসব ভুলই আলোচনা করা হল, যা ব্যাপকভাবে ঘটে থাকে।
আল্লাহ তাআলা সকল হাজী সাহেবকে সঠিকভাবে হজ্ব আদায়ের তাওফীক দিন। আমীন।
গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র মাসিক আলকাউসার নভেম্বর ২০০৯, যিলক্বদ ১৪৩০ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।