আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কথাসাহিত্য যখন সময়কে ভয় করে

ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে............... এজরা পাউন্ড ১৯১৩ সালে লিখলেন মাত্র দুই লাইনের লাইনের পূর্ণ কবিতা: 'The apparition of these faces in the crowd; Petals on a wet, black bough.' (ভিড়ে মিশে যাওয়া মুখগুলো মিলে অভিন্ন ছায়ামূর্তি; ভিজে যাওয়া, কালো গাছের ডালে পাপড়িগুলো জমে আছে) -' In a Station of the Metro' সেখানে ২০ শতকের শুরু নিয়ে স্পষ্ট উল্লেখ নাই। বরং মোহের মতো অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া বা আবেগের মতো ঝাপসা হয়ে ওঠা অতীত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান একাকার করে লেখাটি পড়া যায়। খলিল জিবরানের দ্য প্রফেট (১৯২৩) কাব্যিক ধারার প্রবন্ধ সংকলন। সেখানে কোন সময়ের উল্লেখ নাই। চোখ বন্ধ করে, দিনরাত ভুলে, স্বপ্নের মতো উড়ন্ত অবস্হায়, বা ইতিহাস পড়ে বর্তমান অনুভব করার মতো করে যেকোন সময়ে নির্ধারিত উপলক্ষ্যে জিবরানের লাইন গুলো প্রয়োগ করা যায়।

'Your children are not your children. They are the sons and daughters of Life's longing for itself. They come through you but not from you, And though they are with you, yet they belong not to you. ' ( তোমাদের সন্তানেরা তোমাদেরর নয়, তারা জীবনের আশায় থাকা জীবনের সন্তান। তোমাদের পথ করে তারা আসে তাই বলে তোমরা তাদের পাঠাও না, তোমরা সাথে আছো ঠিক আছে, কিন্তু তাদের মালিকানা তোমাদের হাতে নাই। ) - The Prophet : 'On Children' সহজ করে , ভাসাভাসা তুলনা করতে গেলে, বলা যায়, কবিতার চেয়ে কথাসাহিত্যে সময়ের উল্লেখ স্পষ্টতর। সময়ের চরিত্র নির্মাণ করে কথাসাহিত্য কখনও কখনও ইতিহাস ধরে রাখে। কবিতায় এই ব্যাপারটা কম।

চরিত্রে বা বিষয়বস্তুতে সময়ের রঙ লাগিয়ে গল্প , উপন্যাস বা প্রবন্ধ বেশির ভাগ কবিতার পালিয়ে বেড়ানো স্বভাবকে ছাড়িয়ে যায়। তাই অতি নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ থাকলে কবিতাকে যেমন অনেক সময় ঠিক কবিতা বলে মনে হয় না, কথা বলা সাহিত্যে তেমনি সময়ের উল্লেখ না থাকলে মনে হয় কবিতার আবেগ লেখার জীবনমুখী স্বভাবটাকে আতুর করে রেখেছে। কথাসাহিত্যে তাই সময়বিমুখ হওয়াটা কাব্যিক। সাল, মাস, তারিখ উল্লেখ না করে এমন কাব্যিক হওয়াটা সুন্দর আর উপভোগ্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনাযোগ্য। কিন্তু 'কালজয়ী' নামের একটা লোভনীয়, উচ্চমাপের ব্যাপার ভুলে গেলেও চলবে না।

'কালজয়ী' শব্দের সর্বাধিক প্রচলিত ইংরেজি প্রতিশব্দ হল 'timeless'. ইংরেজি শব্দটা দেখলে মনে হয় এর মানে সময়কে এড়িয়ে যাওয়া। তাই, হয়ত, অনেক লেখকের ইচ্ছা জাগে সময় অস্পষ্ট রেখে বহুযুগের, নানা বছরের আবেদন সৃষ্টি করার। মনে হয় সময় যদি এড়িয়ে যাওয়া যায় তাহলে হয়ত সময়ও তার বেঁধে ফেলার শক্তি হারায়। সাহিত্যের কথাগুলো মানুষের চিরন্তন আবেগ, মায়া বা মোহের মতো অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত এক করে বেঁচে থাকলে , তার চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে? ১. Introduction to Modern Literary Theory তে Kristi Siegel 'Post-Structuralism and Deconstruction' নামক ভুক্তি রেখেছেন। ভুক্তির শুরুটা এই রকম, 'Post-Structuralism (which is often used synonymously with Deconstruction or Postmodernism) is a reaction to structuralism and works against seeing language as a stable, closed system.' অর্থাৎ ভাষা বা ভাষায় লেখা সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে একসময় অতিপ্রচলিত হয়ে ওঠা বৈচিত্র্যহীন একটা প্রথার বিরোধী হিসেবে Deconstruction বা বিনির্মান নামের অন্য একটি প্রথার জন্ম।

বিনির্মাণ অনুসরণ করলে একটি লেখার মানে উদ্ধারের জন্য ইতিহাস বই, লেখকের জীবন ইত্যাদির আশ্রয় নেওয়ার দরকার নাই। এই বিশ্বাস নিয়ে কথাসাহিত্য জাতীয় লেখাগুলো যদি পড়া যায় তাহলে সময়বিমুখতার প্রশ্ণ অতটা জোরালো হতে পারে না। ১৯৪৮ বা ১৯৪৯ সাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খুব কাছাকাছি একটা সময়। ওই রকম সময়ে লিখেছেন, তিনি একজন ইউরোপীয় লেখক, এসব হিসেব করে স্যামুয়েল বেকেটের নাটক পড়তে শুরু করলে;বা লেখায় যুদ্ধপরবর্তী জীবনধারার প্রতিচ্ছবি দেখার ইচ্ছা বা আশঙ্কা নিয়ে তার Waiting for Godot পড়তে বসলে লেখাটির অনেক নতুন বিষয় হারিয়ে যেতে পারে । আগেই ইতিহাসের আশ্রয় নেয়ার ফলে লেখার নিজস্ব যেসব বক্তব্য আছে, নাটকটির ভিতরের যেসব চিরন্তন আবেদন আছে সেসব অবহেলিত হতে পারে।

লেখকের জীবনকাল, লেখার সময়কাল না জেনে বা না মেনে কেউ যদি নাটকটি পড়ে ফেলে , আমার ধারণা , তার প্রতিক্রিয়া নাটকটির পাঠে অনেক বেশি বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হবে। Waiting for Godot কে আমি বলব সময়-পালানো লেখা। ভ্লাদিমির, এস্ট্রাগন, পোৎজো বা লাকি সময়কে ঠিকভাবে গুণতে পারে না বা চায় না। দ্বিতীয় অঙ্কে, পোৎজো অন্ধ হওয়ার পর , লাকি বোবা হওয়ার পর তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় , সে কবে অন্ধ হল , লাকি কবে বোবা হয়ে গেল, সে রেগে যায় আর নির্দিষ্ট সময়ের ধারণাকে তখন প্রকাশ্যেই ঝেড়ে ফেলে, ‘When! When! One day, is that not enough for you, one day like any other day, one day he went dumb, one day I went blind……..’ (কখন! কখন! যে কোন একদিন বললে কি তোমরা বুঝতে পারো না? কোন একদিন , সব দিনের মতো যে কোন একদিন সে বোবা হয়েছে, আমি অন্ধ হয়ে গেছি...) তাই এই নাটকে যখন চরিত্রগুলো কথা বলে তাদের মনে হয় বাস্তবতা থেকে খানিকটা দূরের মানুষ, তারা কবিতার মতো কথা বলে। তাদের কথায় তারিখ নাই, মাসের নাম আসে না, নির্দিষ্ট বছরের উল্লেখ নাই, বারের যাও বা উল্লেখ আছে তারও ঠিক নাই।

তাই সব চরিত্র ছাপিয়ে সময়হীনতাই এই নাটকের সবচেয়ে বড় চরিত্র। সময়কে কাটিয়ে ওঠায় এটা একটা 'গুণ', সময়কে হারিয়ে ফেলায় এর অন্য নাম হয়ত 'ত্রুটি'। .............চলবে............................................. তথ্যসূত্র: ১. Ezra Pound, The Norton Anthology of Poetry. Ed. Ferguson, Salter & Stallworthy. W. W. Norton and Company New York,1996. ২.The Prophet, Khalil Gibran, URL: http://leb.net/mira/works/prophet/prophet.html ৩. Introduction to Modern Literary Theory, Kristi Siegel, URL: http://www.kristisiegel.com/theory.htm ৪. Waiting for Godot, Samuel Becket, Book World, New Delhi, 2001  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।