আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবন্ধ: কথাসাহিত্য যখন সময়কে ভয় করে: প্রসঙ্গ ' ওয়েটিং ফর গডো' এবং 'কাঁদো নদী কাঁদো'

ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে............... এজরা পাউন্ড ১৯১৩ সালে লিখলেন মাত্র দুই লাইনের লাইনের পূর্ণ কবিতা, ' In a Station of the Metro' 'The apparition of these faces in the crowd; Petals on a wet, black bough.' (ভিড়ে মিশে যাওয়া মুখগুলোর মিলে ছায়ামূর্তি; ভিজে যাওয়া, কালো গাছের ডালে পাপড়িগুলো জমে আছে) সেখানে ২০ শতকের শুরু নিয়ে স্পষ্ট উল্লেখ নাই। বরং মোহের মতো অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া বা আবেগের মতো ঝাপসা হয়ে ওঠা অতীত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান একাকার করে লেখাটি পড়া যায়। খলিল জিবরানের দ্য প্রফেট (১৯২৩) কাব্যিক ধারার প্রবন্ধ সংকলন। সেখানে কোন সময়ের উল্লেখ নাই। চোখ বন্ধ করে, দিনরাত ভুলে, স্বপ্নের মতো উড়ন্ত অবস্হায়, বা ইতিহাস পড়ে বর্তমান অনুভব করার মতো করে যেকোন সময়ে, অনির্ধারিত বা নির্ধারিত উপলক্ষ্যে জিবরানের লাইন গুলো প্রয়োগ করা যায়।

'Your children are not your children. They are the sons and daughters of Life's longing for itself. ( তোমাদের সন্তানেরা তোমাদেরর নয়, তারা জীবনের আশায় থাকা জীবনের সন্তান। ) - The Prophet : 'On Children' সহজ করে , ভাসাভাসা তুলনা করতে গেলে, বলা যায়, কবিতার চেয়ে কথাসাহিত্যে সময়ের উল্লেখ স্পষ্টতর। সময়ের চরিত্র নির্মাণ করে কথাসাহিত্য কখনও কখনও ইতিহাস ধরে রাখে। কবিতায় এই ব্যাপারটা কম। চরিত্রে বা বিষয়বস্তুতে সময়ের রঙ লাগিয়ে গল্প , উপন্যাস বা প্রবন্ধ বেশির ভাগ সময় কবিতার পালিয়ে বেড়ানো স্বভাবকে ছাড়িয়ে যায়।

তাই অতি নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ থাকলে কবিতাকে যেমন অনেক সময় ঠিক কবিতা বলে মনে হয় না, কথা বলা সাহিত্যে তেমনি সময়ের উল্লেখ না থাকলে মনে হয় কবিতার আবেগ কথাসাহিত্যের জীবনমুখী স্বভাবটাকে আতুর করে রেখেছে। কথাসাহিত্যে তাই সময়বিমুখ হওয়াটা কাব্যিক। সাল, মাস, তারিখ উল্লেখ না করে এমন কাব্যিক হওয়াটা সুন্দর আর উপভোগ্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনাযোগ্য। কিন্তু 'কালজয়ী' নামের একটা লোভনীয় আর উচ্চমাপের ব্যাপার ভুলে গেলেও চলবে না। 'কালজয়ী' শব্দের সর্বাধিক প্রচলিত ইংরেজি প্রতিশব্দ হল 'timeless' ।

ইংরেজি শব্দটা শুনলে বা দেখলে মনে হয় এর মানে সময়কে এড়িয়ে যাওয়ার মতো কিছু একটা। তাই, হয়তো,কোন কোন কাহিনী-লেখকের ইচ্ছা জাগতেই পারে সময় অস্পষ্ট রেখে বহুযুগের, নানা বছরের আবেদন সৃষ্টি করার। সময় যদি এড়িয়ে যাওয়া যায় তাহলে হয়তো সময়ও তার বেঁধে ফেলার শক্তি হারায়। সাহিত্যের কথাগুলো মানুষের চিরন্তন আবেগ, মায়া বা মোহের মতো অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত এক করে বেঁচে থাকলে , তার চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে? ১. Introduction to Modern Literary Theory তে Kristi Siegel 'Post-Structuralism and Deconstruction' নামক ভুক্তি রেখেছেন। ভুক্তির শুরুটা এই রকম, 'Post-Structuralism (which is often used synonymously with Deconstruction or Postmodernism) is a reaction to structuralism and works against seeing language as a stable, closed system.' অর্থাৎ ভাষা বা ভাষায় লেখা সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে একসময় অতিপ্রচলিত হয়ে ওঠা বৈচিত্র্যহীন একটা প্রথার বিরোধী হিসেবে Deconstruction বা বিনির্মান নামের অন্য একটি প্রথার জন্ম।

বিনির্মাণ অনুসরণ করলে একটি লেখার মানে উদ্ধারের জন্য ইতিহাস বই, লেখকের জীবন ইত্যাদির আশ্রয় নেওয়ার দরকার নাই। এই বিশ্বাস নিয়ে কথাসাহিত্য জাতীয় লেখাগুলো যদি পড়া যায় তাহলে সময়বিমুখতার প্রশ্ণ অতটা জোরালো হতে পারে না। ১৯৪৮ বা ১৯৪৯ সাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খুব কাছাকাছি একটা সময়। ওই রকম সময়ে লিখেছেন, তিনি একজন ইউরোপীয় লেখক, এসব হিসেব করে স্যামুয়েল বেকেটের নাটক পড়তে শুরু করলে; বা লেখায় যুদ্ধপরবর্তী জীবনধারার প্রতিচ্ছবি দেখার ইচ্ছা বা আশঙ্কা নিয়ে তার Waiting for Godot পড়তে বসলে লেখাটির অনেক নতুন, আকর্ষণীয আর সত্যিকারের বিষয় হারিয়ে যেতে পারে । আগেই ইতিহাসের আশ্রয় নেয়ার ফলে লেখার নিজস্ব যেসব বক্তব্য আছে, নাটকটির ভিতরের যেসব চিরন্তন আবেদন আছে সেসব অবহেলিত হতে পারে।

লেখকের জীবনকাল, লেখার সময়কাল না জেনে বা না মেনে কেউ যদি নাটকটি পড়ে ফেলে , আমার ধারণা , তার প্রতিক্রিয়া নাটকটির পাঠে অনেক বেশি বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হবে। Waiting for Godot কে আমি সবসময়ই বলব সময়-পালানো লেখা। ভ্লাদিমির, এস্ত্রাগন, পোৎজো বা লাকি সময়কে ঠিকভাবে গুণতে পারে না বা চায় না। দ্বিতীয় অঙ্কে, পোৎজো অন্ধ হওয়ার পর , লাকি বোবা হওয়ার পর তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় , সে কবে অন্ধ হল , লাকি কবে বোবা হয়ে গেল, সে রেগে যায় আর নির্দিষ্ট সময়ের ধারণাকে তখন প্রকাশ্যেই ঝেড়ে ফেলে, ‘When! When! One day, is that not enough for you, one day like any other day, one day he went dumb, one day I went blind……..’ (কখন! কখন! যে কোন একদিন বললে কি তোমরা বুঝতে পারো না? কোন একদিন , সব দিনের মতো যে কোন একদিন সে বোবা হয়েছে, আমি অন্ধ হয়ে গেছি...) তাই এই নাটকে যখন চরিত্রগুলো কথা বলে তাদের মনে হয় বাস্তবতা থেকে খানিকটা দূরের মানুষ, তারা কবিতার মতো কথা বলে। তাদের কথায় তারিখ নাই, মাসের নাম আসে না, নির্দিষ্ট বছরের উল্লেখ নাই, বারের যাও বা উল্লেখ আছে তারও ঠিক নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না।

তাই সব চরিত্র ছাপিয়ে সময়হীনতাই এই নাটকের সবচেয়ে বড় চরিত্র। সময়কে কাটিয়ে ওঠায় এটা একটা 'গুণ', সময়কে হারিয়ে ফেলায় এর অন্য নাম হয়ত 'ত্রুটি'। পুরো নাটকে ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগন অপেক্ষা করে । সেই অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়। আবার অপেক্ষার শুরু হয় পরের দিন।

যেই গডোর (Godot) জন্যে অপেক্ষা, তার কোনই দেখা মেলেনা। প্রথম অঙ্কের মাঝামাঝি দুইজন অন্য মানুষের দেখা মেলে: পোৎজো আর লাকি । তাদের সাথে একটু ভিন্ন সময় কাটানোর পর আবার অনির্দিষ্ট পরের দিন শুরু হয়। দ্বিতীয় অঙ্কেও প্রথম অঙ্কের গতিহীনতা থেকে ভিন্ন কিছু ঘটে না। সেই অপেক্ষা , সেই না আসা ।

আবারও পোৎজো এবং লাকি। আবারও প্রথম দৃশ্যের শেষের মতো একজন বালক , গডোর বার্তা নিয়ে আসে। বার্তাও বরাবর একই। ‘He won’t come this evening’ ‘But he’ll come tomorrow’ (' আজকে সন্ধ্যাবেলা তিনি আসবেন না' ' কিন্তু কালকে আসবেন') Waiting for Godot নিয়ে বেকেটের প্রচেষ্টাকে অনেকেই এতটা সময়বিবর্জিত লাগায় অনেকে একে মনে করেছেন জীবনবিবর্জিত। যেখানে সমাজ নাই; বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা গীর্জা, প‌্যাগোডা নাই; হাসপাতাল নাই, বাজার, কারখানা বা ফসলের জমি নাই; সেখানে কীভাবে বাস্তবতা আসে, মানুষের জীবনের অস্তিত্ব কোথায় সেখানে? তাই এমন একটা নাটককে শিল্পের মর্যাদা দিতে চান নাই অনেকেই।

American Quarterly তে লন্ডনের থিয়েটার গবেষণার এক পর্যায়ে Bonamy Dobree এই নাটক সম্পর্কে বলেন , ' ... it is time to affirm that anything that can be called art must ultimately be on praise of life, or must at least promote acceptance of life, thus indicating some values.' (এখন অন্তত এটা বলার সময় হয়েছে যে জীবনের প্রশংসা করতে না পারলে বা অন্ততপক্ষে জীবনের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে না পারলে তাকে, শিল্প বলা যায় না। কারণ এমনটা করতে পারলেই কেবল কিছু মূল্য সৃষ্টি হয়। ) কিন্তু সমকালীন ক্ল্যাসিক হিসেবে এই লেখার বর্তমান স্বীকৃতির পেছনে নির্দিষ্ট সময়চিন্তা ছাড়াই, যে কোন ভাবেই হোক, উজ্জ্বল হয়ে আছে সবচেয়ে বড় মানবিক দর্শন, অস্তিত্ববাদ। সোরেন কিয়ের্কেগার্দ, মার্টিন হাইডেগার, আলবেয়ার কামু, জ্যঁ পল সার্ত্রে সহ যারা অস্তিত্ববাদের চর্চা করেছেন তাদের চেতনার মূলে ছিল মানুষ। সার্ত্রে ১৯৪৬ সালে 'অস্তিত্ববাদ একটি মানবতাবাদ' (Existentialism Is a Humanism) নামে এক বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেন, 'Existentialism is not atheist in the sense that it would exhaust itself in demonstrations of the non-existence of God. It declares, rather, that even if God existed that would make no difference from its point of view.' ( 'ঈশ্বর নাই' এই ব্যাপারটা জাহির করতে করতেই অস্তিত্ববাদ এর সব আলোচনা শেষ করবে, এর নাস্তিকতার ধরণ এইটা না।

বরং এর ঘোষণা হল, যদি ঈশ্বর থেকেও থাকে, তার দৃষ্টিভঙ্গিও অস্তিত্ববাদ থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা না। ') বেকেট কিন্তু গডোর পরিচয় দেন নি। হতে পারে গডো ঈশ্বরতুল্য কেউ। যদি তাই হয়, তবে তিনি হয়তো চান যে ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগন নিজের ভবিষ্যত নিজে ঠিক করুক। তাই তিনি দেখা দেন না, অস্তিত্ববাদী এই ঈশ্বরের 'আসি-আসি বলে ফাঁকি' দেওয়ার ব্যাপরটা যদিও এই ধরণের সহজ ব্যাখ্যার উর্ধ্বে।

স্পষ্ট অস্তিত্ববাদী এই নাটক বাইরে বাইরে জীবনমুখী না হয়েও, জীবনের সার্বজনীন ইঙ্গিত তুলে ধরে আছে কোমলতায়, আবছা ভোরের হাওয়ার মতো, চাঁদের ধবধবে পূর্ণিমার নিচে বালুর চকচকে প্রতিফলনের মতো। নির্দিষ্টতার বাইরে যাওয়ায় এই লেখা মেঘের মতো, রোদের মতো, বাতাসের গন্ধের মতো সার্বজনীন। ২. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সর্বাধিক খ্যাতি পেয়েছেন 'লালসালু'( ১৯৪৯) উপন্যাসের জন্য। 'লালসালু'কে সামাজিক সচেতনার উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না, বেশিও বলা হবে না। এখানে মজিদের বিশ্লেষণ আছে, আছে একটা প্রায় নির্দিষ্ট কালের সামাজিক ইতিহাসের মতোন কাহনী।

আছে ধর্ম, অর্থনীতি , গ্রামীণ সংস্কার ইত্যাদি। কিন্তু পরবর্তীতে ওয়ালীউল্লাহর আগ্রহ ছিল হয়তো অন্য দিকে। তাঁর মনের লেখক অংশ চাইছিল বাংলাদেশের ঘর, দালান, নির্দিষ্ট পরিচয় ছাড়িয়ে , প্রকৃতির তারা-চাঁদের মতো সর্ববিস্তারী অথচ মানুষের মনের মতো আপনার কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে। সমকালীন কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে তিনি একবার লিখলেন,' আমার ইচ্ছা সাংবাদিক, কাগজের রিপোর্টারের উর্ধ্বে ওঠা। কিন্তু তোমরা চাও সাহিত্যিক রিপোর্টার হয়েই থাকুক।

সেটি হবে না। তা হলে কষ্ট ক'রে লেখার প্রয়োজন কী?'( হায়াৎ মামুদের ভূমিকা, ' উপন্যাস সমগ্র-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্') সেই কাগজের রিপোর্টারের উর্ধ্বে তিনি অবশ্যই উঠেছেন। সময়োর্ধ্ব চেতনা নিয়ে রিপোর্টারের তথ্যবহুল বর্ণনার বাইরে তিনি বেশ সবল ভাবেই পা রাখতে পেরেছেন। একজন মানুষ, দুইজন মানুষ বা একদল মানুষ ধরে নিয়ে , কোন একটা জায়গার অসংখ্য, সত্যসমান বর্ণনা দিয়ে, সাল-তারিখ যত বেশি সম্ভব উল্লেখ করে তিনি সংবাদপত্রের মতো লেখেন নি । 'চাঁদের অমাবস্যা'য় তিনি বারবার ঢুকে গেছেন তাঁর মূল চরিত্রের অন্তরে, ভিতরে।

চাঁদের আলোর বর্ণনা করেছেন, নদীর বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেই নদী আসলে বাস্তবের কোন নদী? বাংলাদেশের কোন জেলায় তার অবস্হান, তিনি জানান নাই। কোন বছরের কোন মাসে চাঁদ অমন ঝলমল করে উঠেছিল, তিনি বলেন নাই। প্রয়োজন পড়ে নাই। জার্মান সাহিত্যিক কাফকার 'দ্য ট্রায়াল' আর 'চাঁদের অমাবস্যা'' তাই দুইটি ভিন্ন মহাদেশের, ভিন্ন কাহিনীর উপন্যাস হয়েও মানবতা, মানসিকতার বিশ্লেষণ প্রচেষ্টায় পরস্পর সমান্তরাল।

১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় উপন্যাস 'কাঁদো নদী কাঁদো'। এই উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয় এক নদীর বুকে। বাংলাদেশেরই কোন এক নদী হবে হয়তো। অনেক লেখক হয়তো এই নদী আর স্টিমারের বর্ণনার কোন এক ফাঁকে ধপ করে নদীর নাম বলে দিতেন। এখানকারর নদীগুলোর নামও বলার মতোই লোভনীয়।

ইছামতি, যমুনা, কর্ণফুলি, ধানসিঁড়ি, সন্ধ্যা, তিতাস, মেঘনা,পদ্মা, রূপসা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্ম্যা ইত্যাদি। এমন সুন্দর নামগুলোর ফাঁদে না পড়ে, ওয়ালীউল্লাহ্ মোটামুটি নির্দিষ্টতার ধারাকে এড়িয়ে গেছেন। এই উপন্যাসের মূলে মোস্তফা নামের এক যুবকের কাহিনী। ' কুমুরডাঙ্গা' নামের এক মফস্বল শহরে সে চাকরি নিয়ে যায়। সেই শহরের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল স্টিমার।

সেখানে স্টিমার ঘাটের জমজমাট গুরুত্ব এক সময় মরে যায়। নদীতে স্টিমার চলাচল বন্ধ হয়। শহরটি হয়ে যায় আধমড়া নদীর চর। চরা পড়ে যাওয়া সেই নদীর নাম তিনি ইছামতি, তিতাস না রেখে , রাখলেন ' বাকাল'। নির্দিষ্ট সময়ের, পরিচিত স্হানের বহু উল্লেখ এড়ানোর জন্যে তিনি শহরের নাম রাখলেন 'কুমুরডাঙ্গা'।

এই নামের এমন শহর কোনদিন, কোথাও ছিল? উপন্যাসের এক পর্যায়ে তিনি লিখলেন,'মনে আছে একবার বাড়ি থেকে চাঁদবরণ ঘাট পর্যন্ত তাকে পৌঁছিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। ' ঘাটের নামের মাঝে মায়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা নামটা বাংলাদেশের অনেক স্হানের নামের মতোই কিন্তু কাল্পনিক। 'চাঁদবরণ ঘাট' লিখে তিনি নির্দিষ্ট করেন নাই , বরং আরও আবছা করে দিয়েছেন। শীতকালে সিরাজগঞ্জ জেলায় 'শৈলা' নামক একধরণের শাকের বেশ জনপ্রিয়তা আছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এই শাক ততটা জনপ্রিয় নয়। সিরাজগঞ্জ সদর থানার একটা গ্রামের নাম 'শৈলাবাড়ি'। এখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যদি তার লেখায় এই নামটা ব্যবহার করতেন, বা 'শৈলাপুর', 'শৈলাদীঘি',' শৈলাগঞ্জ' বা 'শৈলাবরণ' লিখতেন , তবে অনেক পাঠকই এর আঞ্চলিকতার ধারণা পেত। সময়ের আঁচ পেত। তিনি তা না করে 'চাঁদবরণ' লিখলেন।

চাঁদের নাম ব্যবহার করলেন কারণ, চাঁদের কোন জেলা নাই, উপজেলা নাই, বয়েস নাই, সাল নাই। আর একটা লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো, তিনি চরিত্রগুলোর পোশাক বর্ণনায় তেমন আগ্রহ দেখান নাই। 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের শেষের দিকে মেজ বৌরানী নামের এক চরিত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে বিভূতিভূষণ লিখলেন, ''সিঁড়ির ওপরের ধাপে মেজ বৌরানী দেখা দিলেন। বয়স একটু বেশি, বোধ হয় ত্রিশের উপর, অপূর্ব সুন্দরী। তাঁর বেশের কোন বাহুল্য নাই, ফিকে চাঁপারঙের লালপাড় রেশমি শাড়ির প্রান্ত মাথার চুলে হীরার ক্রিপ দিয়ে আঁটা, সিঁড়ির বড় ঝাড়ের আলোয় গলার সরু চেন চিকচিক করিতেছে...' এভাবে অনেক সময়, অনেক লেখক পোশাকের বর্ণনায় অনেক চরিত্রের অবস্হান, বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে চেয়েছেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখায় তেমন চেষ্টা কম। 'চাঁদের অমাবস্যা'য় যেমন তিনি কাদের, আরেফ আলী বা দাদা সাহেবের পোশাকে চোখ বা মন দেন নাই, তেমনি 'কাঁদো নদী কাঁদো'য় এসে মোস্তফার পরনের পোশাক দিয়ে , মোস্তফার মন বা অবস্হান বোঝাতে চান নাই। কারণ হয়ত, পোশাকের বর্ণনায় সময় ধরা পড়ে অনেক বেশি। তবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে সময় এড়ানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ত প্রকৃতি, আর প্রকৃতি কেন্দ্রিক 'রোমান্টিসিজম'। কাঁদো নদী কাঁদোর এক পর্যায়ে, তবারক ভুইঞার চোখে 'কী যেন একটা ভাব জাগে'।

তার স্মৃতি ভেসে ওঠে। লেখক অতীতে নিয়ে যাচ্ছেন তবারক ভুইঞাকে। মনে হতে পারে, এবার ইতিহাস পাওয়া যাবে, সময়ের বিবরণ উঠে আসবে। কিন্তু না। তবারকের ছোটবেলার বাকাল নদীর স্মৃতি ইতিহাসের মতোন নির্দিষ্ট হয় না।

অতীত এখানে অনেকটা সর্বকালীন, নিরুদ্দেশ। 'সে বলে, সে যখন সর্বপ্রথম শুনতে পায় বাকাল নদীতে চরা পড়েছে তখন সহসা তার মানস-চোখে বাল্যকালে দেখা একটি নদীর চিত্রই ভেসে উঠেছিল্ সেটি একটি অতিশয় খরধার বিশাল নদী যার অপর তীরে প্রতি শরৎকালে মাঠের পর মাঠ ঢেকে বিস্তৃত কাশবন রূপালি শুভ্রতায় ধবধব করত, যার দ্রুতগতি স্রোতে ভেসে যেত জোটবাঁধা অজস্র কচুরিপানার দল। ' অতীতের বর্ণনাকালে, এই ধরণের কাব্যিক আর রোমান্টিক বর্ণনার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই রিপোর্টারের লেখা সংবাদ, নিবন্ধকারের লেখা কলাম বা ইতিহাসবিদের লেখা ইতিহাস-পুস্তকের ধারার বাইরে যাওয়া। উপন্যাসকে যথাসম্ভব কালজয়ী করে প্রস্তুত করা। ওয়ালীউল্লাহর কোন উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহই কোলকাতা বা ঢাকাকেন্দ্রিক নয়।

চাঁদের অমাবস্যায় কাদের, আরেফ আলী বা দাদাসাহেব যখন পূর্ববঙ্গের কোন এক গ্রামে বাস করে শুদ্ধ বাংলায় আলাপ করেন, অবাক লাগে। লালসালুর 'মহব্বতনগর' গ্রাম বা কাঁদো নদী কাঁদোর কুমুরডাঙ্গার মানুষের মুখের মান চলিত ভাষা নিয়ে সন্দেহ হয়। কুমুরডাঙ্গার স্টিমারঘাটের খতিব মিঞা, স্টিমারের ডেকে বসা তবারক ভুইঞা, মুহাম্মদ মুস্তফার বাবা, কালু মিঞা, সকিনা খাতুন সবাই শুদ্ধ চলিত ভাষায় কথা বলে। '' স্টিমার আসবে না, নদীতে চড়া পড়েছে। ' খতিব মিঞা অবশেষে বলে।

একটু থেমে কোম্পানি যে সত্যিই নির্দোষ সে-বিষয়ে সর্ব সন্দেহ দূর করবার জন্যে আবার বলে , 'নদীর বুক জুড়ে মস্ত চড়া পড়েছে, নদীর শ্বাসরোধ হবার আর দেরি নেই। '' ভাষার এই অবাস্তব ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী? আঞ্চলিক ভাষার বাস্তব ব্যবহার পরিত্যাগ করলে লাভ কী? এমন না যে ওয়ালীউল্লাহর পল্লিসমাজ, জীবনশৈলী বা ভাষার সাথে পরিচয় ছিল না। বরং তাঁর লেখাগুলোয় পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন সূক্ষ্ম দিক বিভিন্ন সময় দক্ষতার সাথে উঠে এসেছে। মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, ঢাকা, কৃষ্ণনগর, কুড়িগ্রাম, চিনসুরা, হুগলী, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি গ্রামীণ বা মফস্বল এলাকায় তিনি কালভেদে বসবাসও করেছেন। তিনি, বলাবাহুল্য, স্বেচ্ছায় ভাষার আঞ্চলিকতাকে এড়িয়ে গেছেন।

কারণ, ময়মনসিংহ, ফেনী বা মানিকগঞ্জের স্হানীয় ভাষার ব্যবহার করলে লেখার সময়বিমুখ উদ্দেশ্যটা মরে যেত। ভাষার ব্যবহারে ভেসে উঠত নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকা, ধরা পড়ে যেত নির্দিষ্ট যুগ । সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে তবু পুরোপুরি সময় পালানো লেখক বলাযাবে না। কারণ তিনি একটা আবছা-নির্দিষ্ট কালের কথা লিখেছেন। 'কাঁদো নদী কাঁদো ' পড়ে বোঝা যায়, এই উপন্যাসের গল্প বিশ শতকের কোন এক সময়ের।

এই ভূখণ্ডে তখন স্টিমারের বহুল চল ছিল, প্রয়োজন ছিল। এটাও স্পষ্ট যে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছিল। এমনকি স্টিমারের উদ্বোধনকালের বর্ণনায় একবার তিনি বঙ্গভঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন । তবে নির্দিষ্ট সাল -তারিখের উল্লেখ নাই। সময়কে তিনি পুরোপুরি এড়িয়ে যান নি।

বরং দুই-একটা যুগ বা কয়েকটা দশককে একাকার করে ফেলেছেন। খুব নির্দিষ্ট সময়ের বর্ণনা কঠিন পদার্থের মতো, জেদি, শক্ত। একীভূত আবছা সময়ের প্রয়োগ খানিকটা তরল, তাই একে ভবিষ্যতে অন্য পাত্রে রাখতে চাইলে রাখা যেতে পারে। তথ্যসূত্র: ১. Ezra Pound, The Norton Anthology of Poetry. Ed. Ferguson, Salter & Stallworthy. W. W. Norton and Company New York,1996. ২.The Prophet, Khalil Gibran, URL: http://leb.net/mira/works/prophet/prophet.html ৩. Introduction to Modern Literary Theory, Kristi Siegel, URL: http://www.kristisiegel.com/theory.htm ৪. Waiting for Godot, Samuel Beckett, Book World, New Delhi, 2001 ৫.Samuel Beckett’s Waiting for Godot and Other Works, Walter James Miller and Bonnie Nelson, Simon and Schuster Inc., New York, 1971 ৬. উপন্যাস সমগ্র- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সম্পা. হায়াৎ মামুদ, প্রতীক ,ঢাকা, ১৯৯৬। ৭.বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, সম্পা. মিলন রায়, তিশা বুকস,ঢাকা, ২০০৮।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।