আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।
আমাদের একাত্তুরের বীর-বীরঙ্গনা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামটি লিখে দিয়ে আমাদের দিয়েগেছেন আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার নিশ্চয়তা । তাঁরা আমাদের স্বাধীনতার বীর সৈনিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীর সময় অনেক মা / বোন পাকিস্তানী হায়নাদের জুলুম নির্যাতনে তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন।
স্বাধীন দেশের এক অসহায় বীরঙ্গনা নারী সুইটি আক্তার পুতুলের কেউ কোন খোঁজ খবর রাখেনি, অথচ এদের সম্ভ্রমের বিনিময় আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা,পেয়েছি একটি মানচিত্র,একটি পতাকা।
পুতুলের বাবা ইছাহাক আলী ওরফে টেংগরু পরিবার নিয়ে বাস করতেন রংপুর রেলষ্টেশন পীরপুর এলাকায়। ৪ বোন ১ ভাই এর মধ্যে সকলের বড় ছিলো বাবার বড় আদরের মেয়ে পুতুল। দেখতেও পুতুলের মতই ছিলো তার এই ১০/১১ বছর বয়সেই পুরো ৯ মাস পাকিস্তানীদের পাশবিক নির্যাতরে শিকার হতে হয়েছে তাকে। এমন কোন রাত নেই যে বর্বর পশুগুলো তাকে ভোগ করেনি। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় ১৯৭১ এর মার্চের শেষের দিকে শহরের পীরপুর এলাকার আব্দুস সাত্তারের ছেলে ওয়াহেদ নামের এক পাকিস্তানী সেনাদের দোসর তাকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যায় রেলষ্টেশনে পূর্ব পার্শ্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দ্বিতল ভবনে।
সেখানে নিয়ে অবস্থানরত পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়ে বাহাবা নিয়ে সটকে পরে ওয়াহেদ। প্রথম দিনে ৯ জন হায়েনা পশুর মত ঝাপিয়ে পরে পুতুলের উপর। সারা রাত ধরে সম্ভ্রম হানি করে। অল্প বয়েসে পাশাবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেয়ে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে পুতুল দেখে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে রংপুর ক্যান্টারমেন্টে।
সেখানে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর প্রতিদির রাতেই ভোগ্যপণ্যের মত পুতুলকে ভোগ করেছে খান সেনারা। সম্ভ্রম হানি শেষ হলে হাফফ্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে হাত পায়ে শিকল বেঁধে তাকে তালাবন্ধ করে রাখা হতো বড় একটি কাঠের আলমারীতে। গভীর রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বন্ধভূমিতে। সেনারা হত্যাযঞ্জ চালার পর গাড়ীতেই পুতুলকে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠত। এক সাগর রক্তের বিনিময় দেশ স্বাধীন হয়েছে।
ডানহাতে বেয়নেটের আঘাত সহ শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন আর মানষিক যন্ত্রনা নিয়ে আজও বেঁচে আছেন রংপুরের বীরঙ্গনা নারী সুইটি আক্তার পুতুল। শহরে রেলষ্টেশন সংলগ্ন একটি বস্তিতে কোন রকমে মাথা গুজার ঠাই হয়েছে এই বীরঙ্গনার।
কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামের এক ভাগ্যাহত গৃহবধূ প্রভা রানী মালাকার। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদারদের স্থানীয় দোশর রাজাকাররা ধরে নিয়ে তুলে দিয়েছিল পাক সেনাদের হাতে। সে সময়ের ১৫ বছরের প্রভা রানী বিক্রম কলস গ্রামে ও শমশেরনগর ডাক বাংলোয় পাক সেনা ক্যাম্পে দু'বার পাক সেনা ও রাজাকারদের হাতে গণ ধর্ষনের শিকার হতে হয়েছিলেন।
সেদিন তার সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাক সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারদের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল মীর্জানগর গ্রামের অনেক অসহায় মানুষ প্রাণ ।
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর অতিবাহিত হলেও সেই হতভাগ্য মহিলার ভাগ্যে জুটেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। পাননি কোন সরকারী সাহায্য সহযোগীতা। ভাগ্যে জুটেছে শুধুই পাঞ্জাবীর বউ বলে এলাকার লোকজনের কটাক্ষ। একমাত্র আধা পাগল ছেলেটার বাদ পড়েনি তা থেকে।
গ্রামের মানুষ কটাক্ষ করে ডাকে পাকিস্তানী(পাঞ্জাবীর)-র অবৈধ জারদ সন্তান হিসেবে। কেউ কোন দিন খোঁজ করেননি কেমন আছেন স্বামী হারা প্রভা রানী মালাকার। দুবেলা দু'মুটো ভাতের জন্য গ্রামে গ্রামে ফেরী করে যে আয় রোজগার করেন তা দিয়ে কোন রকমে ছেলে, ছেলের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছেন। স্থানীয় ভূমিখেকোদের করাল গ্রাসে দখল হয়ে যাচ্ছে স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ ভিটে-মাটিটুকুও।
বৈশাখ মাসে তার বিয়ে হয় আর শ্রাবন মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ব।
তখন স্বামী কামিনী রাম মালাকার তাদেরকে রেখে চলে যান ভারতে। তিনিও নিরাপত্তাহীনতার কারণে চলে যান বাবার বাড়ী পাশের গ্রাম বিক্রম কলসে। মাস পনের দিন পর বিক্রম কলস গ্রামের রাজাকার নজির মিয়া ও জহুর মিয়া একদিন গোধুলী লগ্নে প্রভা রাণীকে তার মায়ের সামন থেকে জোর পূর্বক তুলে নিয়ে যায় পাশ্ববর্তী বাদল মাষ্টারের বাড়ী। এক সময় তিনি ভেবেছিলেন দৌড়ে পালাবেন কিন্তু রাজাকার ও পাক সেনাদের হাতে বন্দুক থাকায় গুলিতে মরে যাওয়ার ভয়ে আর পালাননি। যেখানে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিল।
সে রাতে বাদল মাষ্টারের বাড়ী অবস্থান নেয়া সকল সদস্যরা কেড়ে নেয় তার সম্ভ্রম। পরদিন সকালে আর্মিরা তাকে ছেড়ে দিলে তিনি আশ্রয় নেন তার বোনের বাড়ী জাঙ্গাল হাটি গ্রামে। সেখানে কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকেন। কিন্তু ২০/২৫ দিন পর রাজাকার কাদির, রইছ , ইনতাজ, জহুর আবার পেয়ে যায় তার সন্ধান। শত চেষ্টা করেও প্রভা রানী তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি।
যে দিন রাজাকাররা জাঙ্গাল হাটি প্রভা রানীর বোনের বাড়ী হানা দেয় তখন নিজেকে রক্ষার জন্য প্রভা রাণী ধানের বীজ তলার আইলের নীচে আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাজাকার ইন্তাজ, জহুর, রইছ, কাদির সেখান থেকে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে। এ সময় স্থানীয় গফুর মিয়া তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসায় তিনিও তাদের হাতে লাঞ্চিত হন। রাজাকাররা প্রভা রাণীকে ধরে নিয়ে আসার সময় তাদের পালিত কুকুর তার কাপড় ধরে টানতে থাকে।
সোনারার দিঘির পার পর্যন্ত কুকুরটি আসার পর সেটিকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
এক সময় প্রভা রাণীকে নিয়ে আসা হয় শমশেরনগর ডাক বাংলায় পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে। সারা রাত পাকিস্তানী সেনারা তাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষন করে। নিজেকে বাঁচানোর সকল চেষ্টা করেও তিনি রক্ষা পাননি। অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন পাক সেনাদের কাছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন প্রভা রানী। সারা রাত তাকে ধর্ষনের পর সবাই চলে গেলে ভোর রাতে তিনি সুযোগ বুঝে এক সময় পাক সেনাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে কোন রকম হেটে হেটে নিজের বোনের বাড়ী আবার চলে যান। দেশ স্বাধীন হবার এক বছর পর ১৯৭২ সালে তার একমাত্র ছেলে কাজল মালাকারের জন্ম হয়। কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন রিক্সা চালক ছেলেকে কিছু সংখ্যক মানুষ ডাকে পাঞ্জাবির অবৈধ ছেলে হিসেবে। অনেক মানুষ প্রভা রানীকেও ডাকে পাক সেনা বাহিনীর বউ বলে।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার নগরপাড় গ্রামের মনিন্দ্র চন্দ্র দাসের মেয়ে ,নরেন্দ্র চন্দ্র দে এর স্ত্রী এলাকার ব্যাপক আলোচিত বীরঙ্গনা বেলা রানী দাস। জানা যায় , ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন অপুর্ব সুন্দরী বেলা রানী দাসের বয়স মাত্র ১৫ বছর। নরেন্দ্র চন্দ্রর নব বিবাহিতা স্ত্রী বেলা রানী দাসকে স্থানীয় কুখ্যাত রাজাকার মোবারক , মুরতোজ , চাঁন মিয়া , ফরিদ গংদের সহযোগিতায় পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাকের হোসাইন সহ একদল পাক সৈন্য ঘর থেকে ধরে নিয়ে যেতে আসলে স্বামী নরেন্দ্র বাধা প্রদান করায় ওই মুহর্তেই পাক হানাদাররা তাকে গুলি করে হত্যার পর স্ত্রী বেলা রানী দাসকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময় তাকে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন করেন। অপুর্ব সুন্দরী হওয়ায় স্থানীয় রাজাকার ও পাক সেনাদের কুদৃষ্টি পরার কারনে তাকে এধরনের খেসারত দিতে হয়েছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তার চোখের সামনে অনেক বীরঙ্গনাকে প্রানে মেরে ফেললেও সুকৌশলে সে প্রানে বেচে যায় , কিন্তু বেলা রানী আক্ষেপ করে বলেন , বেচে যাওয়াটাই তার জীবনের সব চেয়ে বড় অভিশাপ , কারন এ সমাজ তাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি।
চরম বৈষম্যের ফলে ওই বীরঙ্গনা বাকি জীবনে আর বিয়ে সাদী করতে পারেনি। বেলা রানী ও তার ছোট ভাই প্রদীপ চন্দ্র দাসের শেষ সম্বল পৈত্রিক ভিটে মাটি কয়েক শতাংশ জায়গা বিভিন্ন কৌশলে বেদখলের জন্য ব্যাপক পায়তারা চালিয়ে ইতিমধ্যে তাদের বাড়ির সামনের অংশে বাওন্ডারী দেয়াল নির্মান করে কুচক্রিরা তাদেরকে অনেকটাই অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। অবৈধ দখলদারদের কালো থাবার কারনে সে এখন তার নিজ গৃহে গৃহ বন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময় আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এখানে কেবল মাত্র তিনজনের কাহিনী দিয়েছি কিন্তু এমন আরও লক্ষ বীরঙ্গনা রয়েছেন আজো এই বাংলাদেশের মাটিতে একটু সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার করুন আকুতি নিয়ে।
আজ এ স্বাধীন দেশ আমরা কতটুকু দিতে পেয়েছি সেইসব বেঁচে থাকা বীরঙ্গনাদের?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।