আজকের মানব জমিনের একটি রিপোর্ট
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বাংলা কোন বাংলা? বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন আসলে কোন বাংলার গান গাইছে। এই প্রশ্নটি অনেকের মনে বিশেষ করে বর্তমান ৫৮ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মনে একটা আন্দোলন তৈরি করতে পারে। কারণ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী দৈনিক দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এবিষয়ে একটি চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেছে।
পত্রিকাটির গত ৩রা অক্টোবর সংখ্যায় সামন্ত সুব্রামনিয়াম ‘দেশ ভাগের আগে দেশভাগ’ শীর্ষক নিবন্ধে তথ্য দেন যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সম্প্রতি ওয়েস্ট বেঙ্গলকে পশ্চিমবঙ্গ করেছেন।
এখন থেকে আর বাংলা পশ্চিমবঙ্গকে ইংরেজিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল লেখা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের নাম ইংরেজিতেও পশ্চিমবঙ্গ লিখতে হবে। ওয়েস্ট বেঙ্গল লেখার রীতি আসলে ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতা। বৃটিশ ভারত ছেড়েছে ১৯৪৭ সালে। তবে অবিভক্ত বাংলা দু’ভাগ হয়েছিল আরও আগে- ১৯০৫ সালে।
ওই সময়ে অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৪ মিলিয়ন। সেই বাংলা আয়তনে ছিল বর্তমান ফ্রান্সের সমান। ১৮৯৮ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত ভারতে বৃটিশ ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন। তিনি ভেবেছিলেন এতবড় বাংলাকে শাসন করা ও সামলানো বেশ কঠিন। তিনিই তাই বাংলা ভাগের পরিকল্পনা করেন।
বৃটিশদের যে মূল নীতি ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ তার সঙ্গে কার্জনের পরিকল্পনা বেশ খাপ খায়। ১৯০৪ সালে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব এইচএইচ রিজলি লিখলেন, ‘যুক্ত বেঙ্গল একটি শক্তি। এটা ভাগ করলে আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টিকারী প্রতিপক্ষকে ভাগ করা হলে তারা দুর্বল হবে। ’ লর্ড কার্জনের মনে এই সুপারিশ বিরাট প্রভাব ফেলেছিল।
১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাইসরয় কার্জন সেক্রেটারি ফর স্টেট অব ইন্ডিয়া জন ব্রডনিকের কাছে লিখলেন, ‘কলকাতা হলো কংগ্রেসের ঘাঁটি।
এখান থেকে তারা সমগ্র বাংলা এমনকি গোটা ভারত পরিচালনা করে থাকে। আইনজীবী শ্রেণী খুবই শক্তিশালী। এখন যদি বাংলা ভাগ করা হয় তাহলে তাদের দাপট কমে যাবে। এটা করলে প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচি হবে। তবে আমাকে একজন বাঙাল ভদ্রলোক বলেছেন, আমার দেশের লোক কোন কিছু নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অনেক হৈচৈ করে।
এরপর তারা থেমে যায়। এবং মেনেও নেয়। ’ এরপরই বাংলা ভাগ হলো।
সুব্রামনিয়াম এরপর লিখেছেন, বাংলাকে এভাবে ভাগ করা হলো যাতে ইস্ট বেঙ্গলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমরা একত্রিত হতে পারে। তারা ভাগ হয়ে প্রথমেই তাদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো।
বৃটিশরা দরিদ্র মুসলিমদের অনুভূতি নিয়ে খেললো। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কার্জন ঢাকায় বলেছিলেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল হওয়ার ফলে মুসলমানরা এমন এক ঐক্যের স্বাদ পাবে যেটা তারা বহু আগে যখন মুসলমান রাজা-বাদশার আমলে পেয়েছিলেন। ’
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হলো। আনন্দবাজার পত্রিকা পরদিন সম্পাদকীয় লিখেছিল, কলকাতার জনগণ এদিনটিকে শোক দিবস হিসেবে পালন করবে। এই দেশভাগ বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল।
এর আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল এবং ‘আমার সোনার বাংলা’। তখনও বাংলা ভাগের ঘোষণা আসেনি।
কলকাতা শহরে প্রথম বাংলা ভাগের প্রতিবাদ হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয়েছিল। ১৯১১ সালে দুই বাংলা পুনরায় একত্রিত হয়েছিল তবে তা ১৯৪৭ সালে পুনরায় ভাগ হওয়ার জন্য। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওই নিবন্ধের শেষ বাক্য: ইতিহাসের অনেক পরিহাস।
তবে বঙ্গের অন্যতম পরিহাস হলো- ১৯৭১ সালে ইস্ট বেঙ্গল স্বাধীনতা পেল আর তারা কিনা তাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিলো ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ লাইন। সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের এমন একটি কবিতা, যা অবিভক্ত বাংলার চেতনায় অনুপ্রাণিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।