সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার। সপ্তাহের বাজারটা সারার জন্য বেশির ভাগ নগরবাসী এ দিনটিকে বরাদ্দ রাখেন। তাই শুক্রবার বাজারে ভিড়ও থাকে অন্য দিনের চেয়ে বেশি। আর এই সুযোগে ক্রেতার 'পকেট কাটা'য় ব্যস্ত হয়ে পড়েন দোকানিরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, শুক্রবারে কাঁচাবাজারে গেলেই বিপদ।
সপ্তাহের অন্যান্য দিন এক হাজার টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য কেনা যায়, শুক্রবার সেই পরিমাণ পণ্য কিনতে এক শ থেকে দুই শ টাকা বেশি খরচ করতে হয়। কারণ এদিন মাছ ও সবজির দাম বেশি রাখা হয়। শুধু তাই নয়, কোনো রকম তদারকি না থাকায় রাখঢাক না করেই নির্ধারিত দামের ভোজ্য তেল ও চিনি বেশি দামে বিক্রি করেন দোকানিরা।
শুক্রবারে বাজার চড়া হওয়ার চিত্রটা রাজধানীর অভিজাত ও বড় বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ছোট বাজার অথবা নিম্ন আয়ের ক্রেতারাও এ থেকে রেহাই পান না।
বিত্তশালীদের তেমন একটা গায়ে না লাগলেও বিপাকে পড়েন সীমিত আয়ের মানুষ।
শুক্রবার বেশি দাম রাখার কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, অন্যান্য দিনের চেয়ে ওই দিন বাজারে পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। ফলে পাইকারি বাজারেও দাম বেশি থাকে। এ অবস্থায় বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে তাঁরা বাধ্য হন।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেও গাড়ির ভিড় থাকে শুধু বড় কাঁচাবাজারকেন্দ্রিক।
কারওয়ান বাজার, নিউ মার্কেট বনলতা কাঁচাবাজার, হাতিরপুল বাজার, গুলশান ও বনানীর কাঁচাবাজারে যানজটের কারণে ঢোকাই কষ্টকর। শুক্রবার বড় এসব বাজারে গিয়ে ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করলেই বিক্রেতারা জানতে চান, 'কয় হালি নেবেন স্যার?' এই হালি ধরে মাছ কেনাওয়ালারা বেশি দরদামও করেন না। ফলে মাছের দাম এমন একটা উচ্চতায় উঠে যায়, যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের যাওয়ার সাধ্য নেই।
গতকাল ছিল এমনই এক শুক্রবার। এদিন কারওয়ান বাজারে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা সাবি্বর হোসেন।
তিনি কেটে ভাগ করে বিক্রির জন্য রাখা নদীর একটি পাঙ্গাশ মাছের দাম জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, কেজি ৫০০ টাকা, যদি বিক্রির পর বাকি থাকা অর্ধেক মাছের পুরোটাই নেন। আর শুধু এক কেজি নিলে দাম দিতে হবে ৭০০
টাকা। এ নিয়ে কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বিক্রেতার উদ্ধত জবাব, 'এক কেজি মাছ বেচি না, যান। ' এভাবে অপমানিত হয়ে মাছের বাজার ছাড়তে হয় সাবি্বরকে।
উচ্চবিত্তরা বেশি পরিমাণে কেনেন বলেই শুক্রবার বেশি চড়া থাকে মাছের বাজার।
সে কথা স্বীকারও করলেন ব্যবসায়ীরা। যেসব মাছের দাম অন্যান্য দিন কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা চাওয়া হয়, তা শুক্রবার হাঁকা হয় কমপক্ষে ৩০০ টাকা। অন্যান্য দিন ক্রেতা দরদাম করে মাছের দাম হয়তো ৫০ টাকা পর্যন্ত কমাতে পারেন। কিন্তু শুক্রবার সে সুযোগ নেই।
কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে গত বুধবার ও গতকাল মাছের দরের তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, দুই দিনের ব্যবধানে দামের পার্থক্য কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ টাকা।
কোনো কোনো মাছের ক্ষেত্রে দাম ১০০ টাকাও বেড়ে যায়। বুধবার হাতিরপুল বাজারে মাঝারি আকারের বোয়াল মাছ ৩০০ টাকা কেজি হাঁকেন বিক্রেতারা। তবে সেটা ২৫০-২৬০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। শুক্রবার বিক্রেতারা একদাম হাঁকেন ৩০০ টাকা।
কারওয়ান বাজারে বুধবার প্রতিজোড়া মাঝারি আকারের ইলিশের দাম চাওয়া হয় ৯০০ টাকা।
গতকাল তা উঠে যায় হাজার টাকার ওপরে। আমদানি করা রুই (হলদে রং) মাছের কেজিপ্রতি দাম বুধবার ছিল ২৮০-৩০০ টাকা। শুক্রবার এর দাম ৩৫০ টাকা। এক কেজির কিছু বেশি ওজনের কাতল মাছ বুধবার চাওয়া হয় ২২০ টাকা। শুক্রবার একদাম ২৫০ টাকা।
হাতিরপুল বাজারের খুচরা মাছ বিক্রেতা মহিউদ্দিন বলেন, অন্যান্য দিনের চেয়ে শুক্রবার মাছের দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেশি নিতেই হয়। কারণ, ওই দিন পাইকারি বাজার থেকেই বেশি দামে কিনতে হয়।
গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রতিকেজি বেলে মাছ আকারভেদে ৪০০-৫০০ টাকা, বাইন ৪০০, আইড় ৩৫০-৪০০, শিং ৫০০-৬৫০, দেশি মাগুর ৬০০-৭০০, চিংড়ি ৪০০-৬৫০, দেশি কই ২০টি ৪০০-৬০০ টাকা দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। তবে মিরর কার্প, কার্পিও, ছোট কাতল, থাই সরপুঁটি ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায় ১৮০-২২০ টাকা কেজির মধ্যে।
সবজির দামও চড়া : কারওয়ান বাজারে বুধবার প্রতিকেজি কাঁচামরিচের দাম ছিল ১৬০ টাকা।
শুক্রবার একই কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে। হাতিরপুল বাজারের চিত্রও তাই। একইভাবে বুধবারের চেয়ে শুক্রবার কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজারে টমেটো, গোল লাল বেগুন, চিচিঙ্গার দাম কেজিপ্রতি ১০-২০ টাকা বেশি দেখা যায়।
এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেন, এই কয়েকটি পণ্যের সরবরাহ কম ছিল। শুক্রবারের বাজার বলে খুচরা বিক্রেতারা কিনতে চেয়েছেন বেশি করে।
ফলে দাম বেড়ে গেছে। অন্যান্য সবজির মধ্যে কোনোটার দাম আগের মতোই, আবার কোনোটা কেজিপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
গতকাল হাতিরপুল বাজারের সবজি বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন ও বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আবদুল জব্বার কালের কণ্ঠকে জানান, শুক্রবার সব সময়ই সবজির দাম একটু বেশি। এর কারণ, চাহিদা বেশি থাকা।
কারওয়ান বাজারের আড়ত মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক ইয়াসিন চৌধুরী ময়না কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বছরে আমাদের দুটি ঈদ থাকে।
এ ছাড়া আরো একটি ঈদ থাকে প্রতি সপ্তাহে। সেটি হলো শুক্রবার। এদিন অন্যান্য দিনের চেয়ে পণ্যের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে দামও বেড়ে যায়।
তেল-চিনিতে সুযোগ : ভোজ্য তেল ও চিনি বিক্রিতে খুচরা বিক্রেতারা সাধারণত কেজি বা লিটারপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা লাভ করার চেষ্টা করেন।
কিন্তু পরিবেশক প্রথায় গত রমজান মাসে লাভ বেঁধে দেওয়া হয়েছে দেড় টাকা। চিনির খুচরা বিক্রয়মূল্য ছিল ৬৫ টাকা। নির্ধারিত দামের বেশি দিয়ে কেনা, পরিবহন খরচ ও ঘাটতি যোগ করে খুচরা বিক্রেতারা নির্ধারিত দামে বিক্রিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুক্রবার তাঁদের সুযোগের দিন।
কারণ, এদিন সব অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় তদারকির ভয় থাকে না।
বাজারে সংকট নেই অথচ খুচরা বিক্রেতারা প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত ৬৫ টাকার চিনি ৭০ টাকায় বিক্রি করছেন গোপনে। আর শুক্রবার তা চলে প্রকাশ্যে। গতকাল কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজারের দু-একটি দোকানে তীর ব্র্যান্ডের ৬৫ টাকার চিনি ৭০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়।
কারওয়ান বাজারে এক বিক্রেতা বলেন, 'এত দিন চিনি অনেকটা গোপনেই বিক্রি করতে হয়েছে।
অপরিচিত লোক এসে শুধু চিনির দাম জানতে চাইলে আমরা বলতাম, চিনি নেই। কিন্তু শুক্রবার সেই ভয় কম। '
তদারকির সুযোগ নেই : মাছ ও সবজির বাজারে তদারকির কোনো সুযোগ কার্যত সরকারের হাতে নেই। কারণ, প্রথমত, মাছ ও সবজির ব্যবসায় পাইকারি ও খুচরা কোনো বাজারেই রসিদব্যবস্থা নেই। ফলে ব্যবসায়ী কত দামে কিনে কত দামে বিক্রি করছেন, তার কোনো প্রমাণ থাকে না।
দ্বিতীয়ত, তেল ও চিনি বাদে অন্য পণ্যের দাম সরকার ঠিক করে দিতে পারে না।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ক্রেতাদের কাছ থেকে নির্ধারিত দামের বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু কোনো ক্রেতার পক্ষেই রসিদ ছাড়া বেশি দাম নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণের সুযোগ নেই।
পাইকারি সবজির বাজারে কোনো রসিদ দেওয়া হয় না জানিয়ে আড়ত মালিক ইয়াসিন চৌধুরী ময়না বলেন, আড়তে সবজি খুব দ্রুত কেনাবেচা হয়। ভোর হওয়ার আগে বিক্রি শেষ করা না গেলে পণ্য অবিক্রীত থাকার আশঙ্কা থাকে।
এত তাড়াহুড়োর মধ্যে রসিদ দেওয়া কঠিন। রসিদ না থাকায় তদারকির সুযোগও নেই।
রসিদ ছাড়া বাজারে মনিটরিং সম্ভব নয়, উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা এমদাদ হোসেন বলেন, সবজি ও মাছের বাজারে কোনো রসিদই দেওয়া হয় না। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের পাইকারি বাজারে যেসব রসিদ দেওয়া হয়, তা দিয়ে কাউকে জবাবদিহিতায় আনা কঠিন। কোনো আইনে রসিদ বাধ্যতামূলক করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মন্ত্রীরা রসিদের কথা বলেন, কিন্তু আইনে তা বলা হয়নি।
এটাই বাস্তবতা। '
সূত্র ঃ কালের কণ্ঠ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।