আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, আস্থার মুষ্টিবদ্ধ হাত

অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, আস্থার মুষ্টিবদ্ধ হাত ফকির ইলিয়াস ============================================ বেগম খালেদা জিয়া তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এই প্রজন্মের সন্তানরা ‘নষ্ট-ভ্রষ্ট’। তার কারণ এরা তার আঁতে ঘা লাগিয়েছে। বিএনপি জানে, ডানপন্থা ছাড়া এদেশে নিজেদের ‘মিথ্যাবাদী রাজনীতি’ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন কাজ। এমনটি তারা জন্মলগ্ন থেকেই করে আসছে।

এখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে গিয়ে শাহবাগের গণজাগরণকে টার্গেট করেছেন খালেদা জিয়া। ‘আস্তিক’ আর ‘নাস্তিক’ এর দোহাই দিয়ে এদেশে আগুন নিয়ে খেলতে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা কোনো পরিশুদ্ধ রাজনীতিকের কাজ হতে পারে না। খালেদা জিয়া সেটাই করছেন। অথচ কে কতোটা ধর্ম পালন করে তা এদেশের মানুষের অজানা নয়।

মার্চ বাঙালির স্বাধীনতার মাস। এই মাসে মহান স্বাধীনতার শত্রুরাই আজ বেশি তৎপর, প্রজন্মের গলা টিপে ধরতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই- ‘তবে’ , ‘কিন্তু’, ‘যেহেতু’, ‘সুতরাং’, ‘অতএব’- এমন অনেক অজুহাত তুলে যে মহলটি বিচার নস্যাৎ করতে চায়, বেগম খালেদা জিয়া তাদেরই নেত্রী। তার আওয়ামী লীগকে পছন্দ না লাগতেই পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তার এতো আপত্তি কেন? বাংলাদেশের রাজাকাররা তাদের ক্ষমতা পরীক্ষা অতীতে করেছে।

এখনো করে যাচ্ছে। তা নতুন কিছু নয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পাল্টে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে তাদের। সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাজনীতিকদের তারা কাজে লাগিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনে।

আবার ছুড়ে দিয়েছে। ব্যবহার করে ছুড়ে দেয়াই মওদুদীপন্থীদের হীনকর্ম। এই পরাজিত শক্তিকে জঙ্গিবাদী হতে সাহায্য করেছে বিএনপি। বলেছে- এদেশে কোনো জঙ্গি নেই। অথচ এরাই গোটা দেশজুড়ে একসঙ্গে বোমা হামলা করেছে।

দুঃখের কথা আজো এদেরকে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। এটাই আজ বাংলাদেশে মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রকৃত বাস্তবতা। এদের টুঁটি চেপে অনেক আগেই ধরা যেতো। কিন্তু রাজনীতিকরা তা ধরেননি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১ হাজারের মতো।

অথচ জনসংখ্যা দেশে ১৬ কোটির কাছাকাছি। এদের তো রা করার কোনো উপায় থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তারপরও দেশের মহান বিজয়ের তিন দশক পার হওয়ার আগেই তারা মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। যারা সরাসরি একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভাগ-বাটোয়ারা করে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং টিকে থাকার জন্যও প্রতিযোগিতার ফল এমনটিই হয়।

ভাবতে অবাক লাগে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, ডিসকাশন গ্রুপে রাজাকারপন্থী কিছু কিছু উত্তরসূরি প্রশ্ন তোলে, ‘একাত্তরে আদৌ ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছিলেন কিনা। ’ এরা যে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না- এটাই তার বড় প্রমাণ। বিতর্ক তুলে তথাকথিত ‘সত্য অন্বেষণের’ নামে কলুষিত করতে চায় মহান মুক্তিসংগ্রাম কে। ধৃষ্টতা আর কাকে বলে? তারা বলে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা চাননি, পশ্চিমাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলেন। এমন নানা উদ্ভট তথ্যও হাজির করে মাঝে মাঝে।

এসবের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের রাজাকারী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা। প্রজন্মের ব্রেনওয়াশ করা। এরা কোনো ইতিহাস, কোনো ডকুমেন্টারি মানতে চায় না। বিদেশের বিভিন্ন আর্কাইভে রাখা তথ্য, তত্ত্বগুলো বিশ্বাস করতে চায় না। না বুঝতে চাইলে তাদের বুঝাবে কে? কিন্তু সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না।

দেশে-বিদেশে প্রজন্ম জেগে উঠছে। গেলো ১৭ মার্চ নিউইয়র্কের জাতিসংঘের সামনে বিশাল সমাবেশ করেছেন প্রবাসীরা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। হাজারো প্রবাসী এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে। সবার একই দাবি- যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।

১৭ মার্চ রোববার বেলা একটায় সমবেত হতে থাকেন তারা। এদিন ছিল জাতির জনকের জন্মদিন। তাই সমাবেশ ভিন্ন মাত্রা পায়। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকার গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থনে ছিল এই সমাবেশ। এ সময় আমেরিকান কয়েকটি চ্যানেল সংবাদটি প্রচারের জন্য রেকর্ড করে।

ওইদিন রাতেই তা সংবাদে ব্যাপক প্রচারিত হয়। সমাবেশের পর তারা জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের কাছে একটি স্মারকলিপিও পাঠিয়েছেন। ঢাকা থেকে এই সমাবেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। টেলিফোনে প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে প্রবাসীদের এই সমাবেশ শুরু হয়।

সমস্বরে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। সমাবেশের শুরুতেই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। এরপর সব ধর্মের গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। সমাবেতদের শপথবাক্য পাঠ করান প্রবাসী তরুণ সাইমন হোসেন। সমাবেশে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রণ ছিল উল্লেখ করার মতো।

সমাবেশ চলাকালে ইমরান এইচ সরকারের সঙ্গে টেলি-কনফারেন্সের সমন্বয় করেন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. নূরুন্নবী। প্রজন্ম আজ আর নাবালক নয়। এরা সাবালক। তারা জানে কার চরিত্র কী রকম। খবর বেরিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ও কারাগারে আটক সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলাটির তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

মামলার বিবরণে বলা হয়, ‘বাদীর ছেলে শেরপুর থানার একটি মিথ্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ এ বন্দী ছিলেন। আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী একই কারাগারে ২৩ অক্টোবর ২০১২ সাল থেকে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী হিসেবে রয়েছেন। ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর কারা কর্তৃপক্ষ ভিকটিমকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সেবক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। আসামির সেবক হওয়ার সুবাদে ভিকটিম নিয়মিত আসামির কক্ষে যাতায়াত করতেন। ‘আসামি ভিকটিমের কাছে থেকে মিথ্যা মামলায় সাজা হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত জেনে জেল থেকে মুক্ত করার আশ্বাস দেন।

ভিকটিম জেলমুক্তির আশায় আসামির সেবা-যতেœ বেশি করে মনোনিবেশ করেন। গত ২০ নভেম্বর ২০১২ রাত ৯টার সময় ভিকটিম আসামির কক্ষে সেবাযতœ করাকালে আসামি ভিকটিমকে তার শরীর মাসাজ করে দিতে বলেন। ভিকটিম সরল বিশ্বাসে ও জেলমুক্ত হওয়ার আশায় আসামির শরীর টিপে দিতে থাকলে এক পর্যায়ে যৌন নিপীড়ন করেন। ’ মামলায় বলা হয়, ‘২০ নভেম্বর ২০১২ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০১৩ রাত ১১টা পর্যন্ত ওই যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। ’ কী জঘন্য অভিযোগ ! এটা আমাদেরকে আবারো ’৭১ এর কথা মনে করিয়ে দেয়।

এভাবেই হায়েনারা নিপীড়ন করেছিল বাঙালি জাতিকে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা সাকা চৌধুরী এখনো সেই আচরণ পরিত্যাগ করতে পারেননি ! আর খালেদা জিয়া এদের সঙ্গে নিয়েই ‘নাস্তিক’ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন! ভ-ামির তো একটা সীমা থাকা দরকার। স্বাধীনতার মাসে এসবও শুনতে হচ্ছে জাতিকে! বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের নেতারা নিশ্চয়ই তাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ভুলে যাননি। বাঙালি জাতি যখনই জেগেছে, তখনই নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা বাঙালি ভুলে যায়নি। কিন্তু শেখ মুজিবকে থামানো যায়নি। শেখ হাসিনাকে সেই ইতিহাস মনে রেখে সাহস নিয়ে এগোতে হবে। আমরা দেখছি ইউরোপ-আমেরিকায় এখনো নাৎসিবাদের গন্ধ পাওয়া গেলে সেখানে কামান দাগাবার চেষ্টা করে সরকার পক্ষ। এটি হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব রক্ষার প্রশ্ন।

এ প্রশ্নে আপোস করলে রাষ্ট্র বিপন্ন হতে পারে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। আর পারি না বলেই বিষয়টি জিইয়ে রেখে শুধুই রাষ্ট্রের ক্ষতি করা হবে। কারা একাত্তরে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য পাকিদের শলাপরামর্শ দিয়েছিল, তা কিছুই লুকানো নয়। এসব বিষয়ে সে সময়ের দলিলপত্র দেশে-বিদেশে এখনো সংরক্ষিত আছে।

কথা হচ্ছে, নানা রাজনৈতিক ছলচাতুরী সুবিধাভোগের ফন্দিফিকিরের নামে রাজনীতিকরা বেহুঁশ থাকায় ঘাতক-দালালদের বিচার করা যায়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এদের বিচার কোনো দিনই করা যাবে না। কিংবা কেউ করতে পারবে না। আজ প্রজন্ম সেই বিচারটিই চাইছে। তাই হলমার্ক, পদ্মাসেতু, শেয়ারবাজার, দুর্নীতি ইত্যাদি বলে যারা মূল ইস্যুটিকে চাপা দিতে চাইছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না।

এ কথা খুব পরিষ্কার। অতএব এদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বেগম জিয়া ক্ষমতায়া যাবার জন্য যতো নাশকতা দরকার- তার মদত দেবেন। তা ১৭, ১৮ মার্চের হরতালে তিনি দেখিয়েছেন। হরতাল যদি গণতান্ত্রিক অধিকার হয়, সড়কে গাড়ি চালানোও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার।

কারা জুলুম করে মানুষ পোড়াচ্ছে তা দেশবাসী দেখছেন। তাই সিদ্ধান্ত দেশবাসীকেই নিতে হবে, তারা জঙ্গিবাদে ফিরে যাবেন, নাকি মুক্ত গণতান্ত্রিক আবহে প্রজন্মকে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশে নিঃশ্বাস ফেলতে দেবেন। --------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা : শনিবার, ২৩ মার্চ ২০১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।