তাশফী মাহমুদ অনেকেই হয়তো জানেন না সদ্য প্রয়াত ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদি ফুটবলও খেলতেন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বিপক্ষে এক প্রদশর্নী ম্যাচে অংশও নিয়েছিলেন তিনি।
শুধু ফুটবলই খেলেননি ক্রিকেট-বিশ্বে 'টাইগার' নামে পরিচিত পতৌদি, ব্যক্তিগতভাবে ২০ হাজার ভারতীয় রুপিও মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন। ভারতের মুম্বাইয়ে (তখনকার বোম্বে) স্বাধীন বাংলা দলের বিপক্ষে প্রদর্শনী ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিং রুমে এসে এই অর্থ দিয়ে যান পতৌদির শেষ নবাব। সেসময় তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী চলচ্চিত্র তারকা শর্মিলা ঠাকুরও।
শুধু ফুটবল খেলে এবং নিজে টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি পতৌদি। সেই ম্যাচ থেকে প্রায় ৬৫ হাজার রুপিও তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। সেই সঙ্গে দিয়েছিলেন অনুপ্রেরণাও। বলেছিলেন, "তোমরা এগিয়ে যাও। জয় এসে তোমাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বেই।
তোমাদের মনোবলের কাছে পাকিস্তানীরা পর্যদুস্ত হবেই। "
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, " অধিনায়ক হিসেবে সেই ম্যাচে খেলেছিলেন পতৌদি। তবে পুরো ম্যাচ খেলতে পারেননি। প্রথমার্ধের পুরোটা খেলে চলে যান তিনি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ম্যাচটি জিতেছিলো ৩-১ গোলে।
মহারাষ্ট্র্র একাদশের পক্ষে করা একমাত্র গোলটি করেছিলেন পতৌদিই। "
সেই দুর্দান্ত গোলটি আজো জাকারিয়া পিন্টুর স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তিনি জানান, "প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে নেয়া অসাধারণ এক শটে গোলটি করেন তিনি। একেবারে চোখ জুড়িয়ে দেয়ার মতো গোল। একজন ক্রিকেটার যে এত ভালো ফুটবল খেলতে পারেন তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।
আমাদের মনে হয়েছিল তিনি ফুটবল খেললেও ভালো করতে পারতেন। "
স্বাধীন বাংলা দলের অধিনায়ক ঐ ম্যাচ নিয়ে একটি মজার স্মৃতিরও উল্লেখ করেন, " বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় কায়কোবাদ পতৌদিকে ফাউল করেন। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি হয়তো উঠে এসে কোনো কটু কথা বলবেন। কিন্তু উঠে এসে বলেন, 'আরে বন্ধু, আমি তো তোমাদের মতো ফুটবলার-মুক্তিযোদ্ধা নই।
আমি একজন ক্রিকেটার। আমাকে এভাবে মেরো না। ' তার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদের দারুণ মুগ্ধ করেছিলো। তার প্রতি অনেক শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিলো। "
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন আবাহনীর বর্তমান কোচ অমলেশ সেন।
দীর্ঘ ৪০ বছর কেটে গেলেও তার মনেও সেই স্মৃতি জ্বলজ্বলে। আবাহনী ক্লাবের বারান্দায় বসে পতৌদির কথা বলতে গিয়ে তার চোখ ছলছল করে ওঠে । তিনি জানান, "সেই সফরে আমরা ১৭টি ম্যাচ খেলেছিলাম। কিন্তু মুম্বাইয়ের ম্যাচটি কথাই বিশেষভাবে মনে পড়ে আমার। কারণ পতৌদি সেই ম্যাচে খেলেছিলেন।
সেদিন আমরা তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দেখেছিলাম। তার আচরণ ছিল একেবারেই সহজ-সরল । "
"খেলার পাশাপাশি প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে তিনি কথা বলেন, মজা করে বলেন, 'দেখে-শুনে খেলো ভাই। আমি কিন্তু চোট পেলে সমস্যা হবে'," জানান অমলেশ।
স্বাধীন বাংলা দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্নাও ভুলতে পারেননি সেদিনের স্মৃতি।
তিনি বলেন, "এখনও চোখে ভাসে একজন ক্রিকেটারের নিপুণ ফুটবল-শৈলী। তিনি যে ফুটবলও ভালো খেলতে পারেন সেদিন আমরাও তা বুঝতে পেরেছিলাম। আমরা মুগ্ধ হয়েই তার খেলা দেখেছি। "
"আমি তখন বয়সে তরুণ ছিলাম। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছি ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন বাংলা দলের বিপক্ষে পতৌদির খেলার কথা আমি আজো ভুলিনি, " বলেন তান্না।
ফুটবল খেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশাল অবদান রাখা বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু পতৌদির মৃত্যুতে স্বাধীন বাংলা দল শোকাহত। খুব শিগগিরিই তার পরিবারকে শোক-বার্তা পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে তারা। এ সম্পর্কে জাকারিয়া পিন্টু বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রাখায় আমরা মনে করি তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। "
সেদিন পতৌদি খেলার মাঠে আলো ছড়ানোর সময় গ্যালারি উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন দিলীপ কুমার, শায়রা বানু, রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুরের মতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের রথী-মহারথীরা। মহারাষ্ট্রের গভর্নর ছিলেন ম্যাচটির প্রধান অতিথি।
সুত্র- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।