তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে অধিক রাজনৈতিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় বিজ্ঞাপন নির্মাণ সংস্থা এডকম-এর নির্বাহী নাজিম কামরান চৌধুরী। ওই পরামর্শের ফলে সেনাবাহিনীর কিংস পার্টি গঠনের উদ্যোগে ভাটা পড়ে। প্রধান উপদেষ্টাকে লাজুক হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। বলেছেন, ১/১১-এর আগে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ছিল নামমাত্র। তিনি আরও বলেছেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যখন বিকৃতি থাকে এবং দুর্নীতি বেড়ে যায় তখন সেখানে এক রকম শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
সেই সুযোগকে কাজে লাগায় ইসলামপন্থি কট্টরপন্থিরা। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের লাজুক ও অরাজনৈতিক আচরণে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা ব্যবহার করে সেনাবাহিনী ও সরকারের কিছু স্পষ্টভাষী উপদেষ্টা। ২০০৭ সালের ২০শে জুন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দপ্তর পরিচালক কারেন আগুইলার-এর সঙ্গে সাক্ষাতে এসব কথা বলেন নাজিম কামরান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য। এ বিষয়ে ২০০৭ সালের ১লা জুলাই ঢাকায় নিয়োজিত মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি একটি গোপন তারবার্তা (ঢাকা ০০১০৯৬) পাঠান ওয়াশিংটনে।
গত ৩০শে আগস্ট তা ফাঁস করে দেয় উইকিলিকস। এতে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বাংলাদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞাপনী সংস্থার নির্বাহী নাজিম কামরান চৌধুরীর। ২০০৮ সালের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচনের সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন তিনি। তিনিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে অধিক রাজনৈতিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনী ‘কিংস পার্টি’ সৃষ্টির পরিকল্পনা থেকে সরে যাচ্ছে এবং তারা প্রধান দুই দলের সংস্কারপন্থি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০০৭ সালের ২০শে জুন কারেন আগুইলার, মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করেন নাজিম কামরান চৌধুরীর সঙ্গে। তার অনেক যোগসূত্র। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মার্কেটিং কোম্পানি এডকম-এর সভাপতি। সরকারের উপদেষ্টা গীতিয়ারা সাফিয়ার স্বামী এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের কাজিন। বাংলাদেশে ভাল একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে।
এছাড়া, তিনি সিলেট থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র সাবেক সংসদ সদস্য। ওই তারবার্তায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের আগে বাংলাদেশে নামমাত্র গণতন্ত্র ছিল। নাজিম কামরান জানতে চান, কেন যুক্তরাষ্ট্র আগেভাগেই নির্বাচন দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। তার মতে, নির্বাচন গণতন্ত্র তৈরি করে না। প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্র তৈরি করে।
নাজিম কামরানের মতে, বিকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বর্ধিষ্ণু দুর্নীতি স্থানীয় পর্যায়ে শূন্যতা সৃষ্টি করে। ইসলামী মৌলবাদী গ্রুপগুলো সেই সুযোগে বিকশিত হয়। তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে সেই শূন্যতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক গোড়াপত্তন জরুরি। সেই সঙ্গে মৌলবাদীদের উত্থান ঠেকাতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন এই সব বিষয়কে তুলে ধরতে পারে না এবং সেটাকেই বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখা উচিত নয়।
তিনি আশা করেন, সরকার জুলাই নাগাদ একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারে। প্রথমেই এটা হতে পারে স্থানীয় নির্বাচনের জন্য এবং জাতীয় নির্বাচন আসবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে লাজুক ও ম্যানেজার ধাঁচের মানুষ হিসেবে অভিহিত করেন। কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফখরুদ্দীন নিজেকে নিয়োজিত না করা ও জনসমক্ষে না যাওয়ায় একটি ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। সেই ফারাক পূরণ করছে সেনাবাহিনী ও স্পষ্টভাষী সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু উপদেষ্টার মতো বিভিন্ন অংশ।
নাজিম কামরানের দৃষ্টিতে, জোর করে ফখরুদ্দীনকে সেনাবাহিনী আজ্ঞাবহ করে রাখেনি। তিনি যদি পছন্দ করেন তাহলে তার জেগে ওঠার জায়গা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনী শুধু শূন্যতা পূরণ করছে। তাকে বাক্সে ভরে রাখেনি। নাজিম কামরান চৌধুরী ও সরকারি পর্যায়ের উপদেষ্টারা ড. ফখরুদ্দীনকে উপদেষ্টা পরিষদে অধিক রাজনৈতিক বিষয় তুলে ধরার জন্য চাপ দিতে থাকেন।
তারা আরও চাপ দেন সরকারের জনসংযোগকে উন্নত করতে এবং তাকে ঢাকার বাইরে গিয়ে জনগণের সঙ্গে কথা বলতে। এরপর নাজিম কামরান চৌধুরী সবকিছুর সমন্বয় করে একটি উচ্চাভিলাষী কৌশল প্রণয়ন করেন। তারই অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলে প্রথম টাঙ্গাইল সফর করেন। সেখানে তার ২০ মিনিট বক্তব্য দেয়ার কথা থাকলেও তিনি তীব্র গরমের মধ্যে এক ঘণ্টার বেশি নেতাসুলভ বক্তব্য রাখেন। এ সময় তার পানিশূন্যতা দেখা দেয়।
চৌধুরী আরও বলেন, তারপরও তার বাইরে যাওয়া এবং একজন নেতা হিসেবে অধিক ব্যস্ত থাকা উচিত। নাজিম কামরান চৌধুরী মনে করেন, ১লা এপ্রিলের দেয়া বক্তব্যের পর সেনাপ্রধান নিজেকে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য করে নেন। একে অনেকে রাজনীতিতে তার প্রবেশের মওকা হিসেবে দেখেন। ব্যাপকভাবে প্রচার পায় সেনাবাহিনী কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা করছে। এরই প্রেক্ষিতে নাজিম কামরান চৌধুরী বলেন, ওই বক্তব্যের পর ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আসার জন্য যারা চেষ্টা করছিলেন তারা পিছু হটেন।
সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি তৃতীয় পক্ষীয় সরকারের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেন। তিনি আরও দাবি করেন, এখন সেনাবাহিনী বেরিয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে দুই দলেরই সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে চাইছে। ওইসব সংস্কারপন্থি নিজেদের নেতানেত্রীকে সরিয়ে দিয়েছে এবং সেনাবাহিনী তাদের কাছে ইনডেমনিটি খুঁজছে। ওই তারবার্তার মন্তব্য কলামে গীতা পাসি লিখেছেন, নাজিম কামরান চৌধুরী আসলেই ভিতরের লোক। তিনি দু’জন উপদেষ্টার আত্মীয় (ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইফতেখার চৌধুরীর) এবং আরেক উপদেষ্টা গীতিয়ারা সাফিয়ার স্বামী।
দূতাবাসের কর্মকর্তা যখন এপ্রিলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তখন তিনি সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার সম্ভাব্য রাজনৈতিক উচ্চাশা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করেন। কিন্তু সর্বশেষ এই বৈঠকে তিনি ইঙ্গিত দেন সেই পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপসৃত হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।