আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেক্সিমকো গ্রুপ এর উত্থান এবং রাজনৈতিক প্রভাব

উন্মাদ বালক বইলাই কিন্তু আমি পুরা উন্মাদ না, সামান্য কয়টা তার ছিড়া... বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য জগতের ফার্স্ট ফ্যামিলি বেক্সিমকো গ্রুপ। এখন ২৮টি কোম্পানি নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় কনগ্লম্যারিট এই গ্রুপ একদিন যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র একটি জুট মিল নিয়ে। বিস্ময়কর ওই উত্থান অভিযাত্রা-মুগ্ধ করেছে বিশ্বের অথনৈতিক সমাজকে, কৌতূহল জাগিয়েছে মিডিয়া ভুবনকে। এমন বিপুল সাফল্য ও সার্থকতার মূলে কাজ করেছে কি মেধা ও শ্রম, কোন প্রতিভা ও উদ্যোগ- তা জানতে এগিয়ে এসেছে অনেক প্রচার-প্রকাশনা। দেশের বৃহত্তম কনগ্লম্যারিট হিসেবে বেক্সিমকো’র প্রতিষ্ঠা লাভের অভিযাত্রাকে বলা যায় জাতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক সঠিক দর্পণ।

আকাশ থেকে দেখলে সারাবো-তে ২০০ একর জায়গা নিয়ে স্থাপিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ককে পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশের স্থাপনা বলেই মনে হবে। ভেতরে কর্মচঞ্চল পরিবেশ। ব্যস্ত নির্বাহীদের কার্যালয়। তার মধ্যেই আছে বাস্কেট বল কোর্ট, জিমনেসিয়াম, লেক, ছোট্ট চিড়িয়াখানা। লেকে সাঁতার কেটে বেড়ায় হাঁসের দল।

চিড়িয়াখানায় ছুটোছুটি করে চিত্রল হরিণ। পার্কের বাইরে একেবারে ভিন্ন দৃশ্য। ধানক্ষেত, কাদা-পানির নালা নর্দমা। কে বলবে এসবের মাঝখানেই রয়েছে দেশের বৃহত্তম কনগ্লম্যারিট বেক্সিমকো গ্রুপের ঘরবাড়ি। বছর দশেক আগে দু’ভাই সোহেল ও সালমান রহমান রাজধানী ঢাকার অদূরে এই সারাবো-তে আসতেন ফেরিতে নদী পার হয়ে।

তখন ফসলের মাঠ, নদী আর খাল ছাড়া কিছুই ছিল না এখানে। গত দশকে এখানে উন্নয়ন ঘটেছে খুব দ্রুত। একে একে গড়ে উঠেছে বেক্সিমকো’র সিরামিকস ও টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিগুলো। এগুলোতে কাজ করে প্রায় আট হাজার শ্রমিক। ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব, ৪৫ হাজার কর্মী এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বাজার মূলধন ১.৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে বেক্সিমকো এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বেসরকারি কনগ্লম্যারিট।

এর তালিকাভুক্ত কোম্পানি পাঁচটি, আর ২৩টি কোম্পানি তালিকার বাইরে। এর মধ্যে রয়েছে এভিয়েশন, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যাল, মিডিয়া, রিয়াল এস্টেট, ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, এনার্জি ও সিরামিকস। রাজস্বের দিক থেকে এর অবস্থান ভারতের গোদরেজ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সমান। ফরচুন ইন্ডিয়া’র শীর্ষ ৫০০-এর তালিকায় এর স্থান ১৮৫-তে। পাকিস্তানের নিশাত গ্রুপের চেয়ে অবশ্য বেশ ছোটই বেক্সিমকো গ্রুপ।

নিশাত-এর বার্ষিক রাজস্ব ২ বিলিয়ন ডলার। ১৯৬৬ সালে ইন্তেকাল করেন রহমান ভ্রাতৃদ্বয়ের পিতা ফজলুর রহমান। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী। মৃত্যুর সময় ঢাকার দক্ষিণে একটি ছোটখাটো জুট মিল তিনি দিয়ে যান সোহেল রহমানকে। ১৯৬৬-৭১ সালে ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বলে কোম্পানির ঋণ হ্রাস করেন সোহেল রহমান, উৎপাদন বাড়ান।

স্বাধীনতার পর পাট শিল্প জাতীয়করণ করে সরকার। তখন কারখানাটি হস্তান্তরে বাধ্য হন তিনি। বছর দশেক পরে কয়েকটি জুট মিলের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল হলে এবং বেসরকারিকরণ করা হলে তিনি ফেরত পান তার কারখানা। তবে ওই সময় দুই ভাই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না এতটুকুও। তারা জানতেন পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ হলেও নতুন দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য আরও নতুন নতুন ক্ষেত্র সন্ধান করা উচিত।

তাই পাট ও সংশ্লিষ্ট সামগ্রী থেকে দূরে সরে গিয়ে ১৯৭২ সালে তারা গড়ে তোলেন বাংলাদেশ এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট কোম্পানি- বেক্সিমকো। তারা বিদেশে রপ্তানি করতে থাকেন সামুদ্রিক খাদ্য ও হাড়ের চূর্ণ। এই চূর্ণ পাঠানো হতো বেলজিয়াম, ফ্রান্স, বৃটেন, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোতে। আর তারা বিদেশ থেকে আমদানি করতে থাকেন ওষুধপত্র। এ ব্যবসায় সাফল্য আসে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।

বছরে আয় দাঁড়ায় ৩০ মিলিয়ন ডলার। পবন লাল বেক্সিমকো গ্রুপকে তুলনা করেছেন ভারতের টাটা গ্রুপের সঙ্গে। তিনি লিখেছেন, এর মধ্যে বাংলাদেশে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত। এ আবর্ত মাঝেমধ্যে আঘাত করেছে দুই ভাইকে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই দাবি করলেও তারা সব সময়ই জড়িত ছিলেন রাজনীতিকদের সঙ্গে।

সালমান রহমানের বাল্যবন্ধু শেখ কামালের বোন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নব্বই দশকের শেষ দিকে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন’ নামে একটি দলও গঠন করেছিলেন। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তিনি যোগ দেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। পরে তার উপদেষ্টা হন বেসরকারি উন্নয়ন খাতের।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসায় দুই ভাই অধিষ্ঠিত হন দৃঢ় অবস্থানে। বেক্সিমকো’র সব প্রতিষ্ঠানই নিঃসন্দেহে লাভজনক। তবে টেক্সটাইল তাদের সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস। তাদের বেক্সটেক্স প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। এর উৎপাদন শুরু হয় ১৯৯০ সালে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯২ সালে। গত বছর বেক্সটেক্স একীভূত হয় বেক্সিমকো’র সঙ্গে। বেক্সটেক্স-এর উৎপাদনের বেশির ভাগ জিন্স। এগুলোর ক্রেতা বিশ্ববিখ্যাত ডিকেএনওয়াই, লেভি’স, ক্যালভিন ক্লাইন, জে.সি. পেনি। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ৪৩ ডলার।

বেক্সিমকো এর চেয়ে বেশি মজুরিই দিয়ে থাকে তার শ্রমিকদের। কারখানার ভেতরকার অবস্থা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় তত উন্নত না হলেও একেবারে অনুন্নতও নয়। কাজের এলাকা ঘিঞ্জি নয়, খাবার পানি মেলে হাতের কাছে। ফ্যান, লাইট, সতর্কতা সঙ্কেত যথেষ্টই রয়েছে। টেক্সটাইলের মতো বেক্সিমকো’র সিরামিক কারখানা শাইনপুকুর সিরামিকস যথেষ্ট লাভজনক।

এর ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছেই। গত ডিসেম্বরে চীনের একটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নরওয়ের পোসগ্রুন্ড পোরসিলিন ফ্যাক্টরি তাদের সব অর্ডার পাঠায় শাইনপুকুরে। তাদের তখন তৈরি করতে হয় বড় দিনের প্লেট ও কাপ। সোহেল রহমান বলেন, তিনটি ৭৪৭ জেট ভর্তি করে সেসব প্লেট-কাপ পাঠাতে হয়েছে আমাদের। ২০০৭ সালে সালমান রহমানকে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ২০০ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীকে। সালমান রহমানকে জেলে পাঠানো হয়। তার ভাইকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এতে ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনে তা ছিল ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ঋণ নেয়া এবং তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি নেই এমন সম্পদের মালিক হওয়া।

এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসে। ২০১০ সালে সালমান রহমান ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ করে দেয় আদালত। যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে যেমন সম্পর্ক বিদ্যমান, সোহেল রহমান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে তেমনটি দেখতে পছন্দ করেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।