আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাহসী প্রত্যয়ী বিপ্লবী প্রীতিলতা

আর কেন সম্মেহন-এ পাপ, থাক- ‘বেদনা আমারি থাক’ জোবায়ের আহমেদ নবীন অসীম সাহসী ও প্রত্যয়ী ছিলেন বাংলার অগি্নকন্যা বিপ্লবী প্রীতিলতা। পুরো নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৯১১ সালের ৫ মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানি জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং প্রতিভাদেবীর কোলজুড়ে ফুটফুটে যে শিশুটির আগমন হয়, তিনিই বাংলার বিপ্লবী কন্যা প্রীতিলতা। প্রীতিলতার পারিবারিক আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি (মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ)।

তাদের পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে 'ওয়াহেদেদার' উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকেই ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার। শৈশবে পিতার মৃত্যুর পর জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার সপরিবারে তার পৈতৃক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া ত্যাগ করে পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে ওঠেন। আর এ বাড়িতেই প্রীতিলতার জন্ম। প্রীতিলতার মা প্রতিভাদেবী আদর করে তাকে 'রানী' ডাকতেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন প্রীতিলতার পরিবার।

অন্তর্মুখী, লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের প্রীতিলতা ছেলেবেলায় ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করতেন। তবে প্রীতিলতার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। সে সময় ডা. খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় ছিল চট্টগ্রামের উন্নতমানের নারী শিক্ষালয়। আর সেই নামকরা স্কুলে ১৯১৮ সালে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে মেয়েকে ভর্তি করিয়েছিলেন প্রীতিলতার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার। প্রতিবছর প্রথম অথবা দ্বিতীয় হয়ে বাবার সে আস্থার মান রেখেছিলেন প্রীতিলতা।

প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের প্রিয় ছিলেন। সেই শিক্ষকের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। ১৯২৮ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করার পর ঢাকায় ইডেন কলেজে ভর্তি হলেন প্রীতিলতা। থাকতেন কলেজেরই ছাত্রীনিবাসে। তখন বিয়ের প্রস্তাব এলে তা কঠোরভাবে ফিরিয়ে দেন তিনি।

সে সময়ে প্রখ্যাত লীলা নাগের সংগঠন 'দীপালী সংঘ'-তে নাম লিখিয়েছেন প্রীতিলতা। এরমধ্যে আইএ পরীক্ষা শেষ করে চট্টগ্রামে চলে যান তিনি। চট্টগ্রামের বৈপ্লবিক কর্মকা-ে তখন যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। মাষ্টারদা সূর্যসেন তখন কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক। স্বদেশীদের আন্দোলনের ভাষা যেন প্রীতিলতারও হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে পড়ে।

তিনিও স্বদেশীদের আন্দোলনের ভাষা বুঝতে শুরু করেন। এরই মধ্যে প্রীতিলতার আইএ পরীক্ষার ফল বেরোয়। মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পাওয়ায় কলকাতার বেথুন কলেজে দর্শন শাস্ত্রে অনার্সে ভর্তি হন প্রীতিলতা। সে সময় ছাত্রীনিবাসে থেকে মাষ্টারদার নির্দেশে সাংগঠনিক কর্মকা- শুরু করলেন তিনি।

গড়ে তোলেন একটি বিপ্লবী চক্র। প্রীতিলতার দেখাদেখি এই বিপ্লবী চক্রে আরো অনেক মেয়ে সদস্য যোগ দিলেন। তাদের মূল কাজই ছিল অর্থ সংগ্রহ। বিভিন্নভাবে বিভিন্নস্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তা চট্টগ্রামে পাঠাতে লাগলেন প্রীতিলতা। সে সময় পত্রিকায় খবর বেরোয়, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করে নিয়েছে বিপ্লবীরা।

বিপ্লবীরা মরণ কামড় দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের লৌহপ্রশাসনে। দুঃশাসনের পাঁজর গুঁড়িয়ে দিয়েছে স্বাধীনতাকামীরা। তারপর ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন অচল হয়ে যায়। টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল, সরকারি অস্ত্রাগার দখল, রিজার্ভ পুলিশ ছত্রভঙ্গ, রেললাইন উৎপাটন থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসকের আকাশছোঁয়া দর্পচূর্ণ করে বিপ্লবীরা। এ খবরে কলকাতায় থেকে চট্টগ্রামে এসে সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন প্রীতিলতা।

কিন্তু মাষ্টারদার অনুমতি না মেলায় সে যাত্রায় তা আর সম্ভব হয়নি। তখন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার অনেক দেরি, তাই টেস্ট পরীক্ষা শেষ করেই চট্টগ্রাম চলে এলেন তিনি। চট্টগ্রামে তখন বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ ও মিলিটারির তৎপরতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে বিএ (অনার্স) পাশ করে আবার চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে অপর্ণাচরণ দে'র সহযোগিতায় নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমানে অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। এ সময় মাষ্টারদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন প্রীতিলতা।

পরে অনেক কষ্টে শহরের বাইরে এক গ্রামে সাবিত্রি দেবীর বাড়িতে রাতের বেলা মাষ্টারদার সঙ্গে দেখা করলেন প্রীতিলতা। ১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে বললেন- 'আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর তোমার নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করবে তুমি। ' এ সময় প্রীতিলতাকে চট্টলার রানী হিসেবে উল্লেখ করলেন মাষ্টারদা। আগেই অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন প্রীতিলতা। প্রীতিলতার সহযোদ্ধা ছিলেন -শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে ও মহেন্দ্র চৌধুরী।

সকলেই তখন যুদ্ধের প্রবল উন্মাদনায় মত্ত হয়ে প্রীতিলতার নেতৃত্বে মরণযুদ্ধের সঙ্কল্পে দৃঢ়। হঠাৎ আক্রমণ করার সংকেত পাওয়ার পর সহযোগীদের নিয়ে শত্রুর সম্মুখে পেঁৗছে গেলেন প্রীতিলতা। শত্রুরা তখন নাচ আর গানে মত্ত ছিল। উন্মত্ত বল নাচের পরিবেশকে থমকে দিয়ে চললো গুলি আর বোমা বৃষ্টি। প্রায় সকলকে খতম করে দিয়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে রেলের পথ ধরে হাঁটছেন বিপ্লবীরা।

জয়ের আনন্দ সবার চোখেমুখে। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। সবাই মিলে দৌড়াতে লাগালো। গুলিটি লেগেছে প্রীতিলতার বুকের ডান দিকে। বুকে হাত চেপে তবু দৌড়াতে লাগলেন সাহসী প্রত্যয়ী প্রীতিলতা।

দৌড়ে কে কোথায় চলে গেল অন্ধকারে তার কিছুই দেখা গেল না। বুকে প্রবল রক্তক্ষরণে এক সময় রাস্তায় পড়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন প্রীতিলতা। তারপর জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারলেন চারপাশে পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু পুলিশের হাতে বন্দি হতে চাননি বলেই তার কাছে গচ্ছিত পটাশিয়াম সায়ানাইড বের করে জননী ও জন্মভূমির নামে তা মুখে পুরে দিলে স্বেচ্ছা মুক্তির পথ বেছে নিলেন তিনি। এরপর মাটির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলেন স্বাধিকার আন্দোলনের সাহসী অগি্নকন্যা প্রীতিলতা।

সেদিন তার সৎকার হয়েছিল সাদামাটাভাবে। ইচ্ছা থাকলেও ভয়ে কেউ শ্রদ্ধা জানাতে আসেনি। কিন্তু প্রীতিলতা শুধু চট্টলার রানী নয় বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের মহীয়সী নারীরূপে আজো চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন আমাদের হৃদয়ের গর্বের অগি্নকন্যা হিসেবে। গত শনিবার ছিল বীরকন্যা প্রীতিলতার ৭৯তম আত্মাহুতি দিবস। সাহসী প্রত্যয়ী বিপ্লবী প্রীতিলতা  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।