অপ্রিয় এবং অবাঞ্ছিত... বাংলাদেশে আজকাল ভারতীয় হিন্দী চ্যানেলের রমরমা অবস্থা! বিকাল থেকেই শহুরে আন্টি আর আফামণিরা হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে বসে যান সনি-স্টার প্লাসের সামনে। অবৈধ সম্পর্ক, পুত্রবধূ-শাশুড়ীর কূটনীতি, প্রেমিক-প্রেমিকার খেমটা নাচ- এইসব নিয়ে তাদের আজাইরা মাথাব্যাথার শেষ নেই। স্টার গোল্ড আর সমজাতীয় চ্যানেল থাকায় হিন্দী ছবি ত ২৪ ঘন্টাই চলছে। তাদের নকল করে আজ আমাদের স্মার্ট মহিলা সমাজ ধিঙ্কাচিকা, আনারকলি, মাসাক্কালি কিনছে, শরীর দেখিয়ে কায়দা করে শাড়ী পড়ছে! আর বাচ্চাগুলো ত হিন্দিতে এক্সপার্ট! ডিজনী চ্যানেল, নিক- এইসব হিন্দি কার্টুন চ্যানেলগুলো ছোট বাচ্চাদের ভিতরে হিন্দি ঢুকিয়ে দিচ্ছে! কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক এরকমই একবার লিখেছিলেন- গাড়িতে যানযটে বসে তাঁর এক ভাগ্নি বলেছে- ম্যাঁয় ত তাং আ চুকি হু!
বাংলাদেশ প্রতি বৎসর ২০০০ কোটি টাকা ভারতকে দিচ্ছে সনি -স্টার প্লাস এইসব পে চ্যানেল দেখার জন্য, যা দিয়ে প্রতি বছর ২০টা ফ্লাইওভার, প্রতি ৪ বছরে ১ টা পদ্মা সেতু তৈরি করা যেত। ধিঙ্কাচিকা টাইপ পোশাকের জন্য আমাদের দেশীও পোশাকশিল্পগুলি মার খাচ্ছে।
এমনও পাবলিক আছে যারা ভারতীয় চ্যানেলে কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখে ওই পণ্য কেনার জন্য এই দেশ থেকে লোক পাঠিয়ে ভারতের মাটি থেকে সেই পণ্য কিনে আনে। তাহলে হিসাবে আসছে যে ভারতের কাপড় আর পণ্যের ব্যবসায়ীরা লাভ নিচ্ছে আর সরকারও ট্যাক্স পাচ্ছে। পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারকারী ভারতীয় চ্যানেল বিজ্ঞাপণের স্পন্সরশীপ ত পাচ্ছেই, আবার এদেশ থেকে সম্প্রচার ফী নিচ্ছে এবং সেখান থেকেও সরকার ট্যাক্স পাচ্ছে। পণ্য কিনতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ভিসা ফী, পর্যটন, শুল্ক ও অন্যান্য ব্যাপারে লাভবান হচ্ছে ওই ভারতই। আমরা কী পাচ্ছি? টাট্টু ঘোড়ার ডিম!
এখন কথা হচ্ছে, এই ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো যদি বন্ধ করে দেওয়া হয়, হোক না সেটা বাংলা ভাষা আর বাণিজ্য ঘাটতি রক্ষা করতে, তাতে নির্ঘাত দুই-চারটা সিরিয়ালখোর সুইসাইড করবে।
ঝাঁটা হাতে "ইস্মার্ট" আফু-আন্টি-ভাবীদের মিছিল বা মানবীবন্ধন হলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই। আর ব্যবসার আঁতে ঘা লাগায় ক্যাবল অপারেটররা কী করবেন তা পাঠকদের কল্পনার উপর ছেড়ে দিলাম।
অনেক হইসে। এখন আসেন পোস্টের টাইটেল অনুযায়ী গাছে কাঁঠাল রেখে গোঁফে তেল দেই।
মার্কেটিং
প্রথমত, প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক টিভি চ্যানেল।
আমাদের দেশে এটিএন নিউজ, সময় আর ইনডিপেন্ডেন্ট ছাড়া কোনো বিষয়ভিত্তিক টিভি চ্যানেল নেই। টক-শো, নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠান, খবর, ডকুমেন্টারি- সবই এক চ্যানেলে দেখায়। নতুন নতুন চ্যানেল যেগুলো আসছে, তাদের সবার একই ধান্দা- সব শ্রেণীর দর্শককে ধরা। ভিন্নতা নেই। একটা নবজাতক চ্যানেল যদি নতুন কিছু না দিয়ে অন্যদের মতো হতে চায়, তবে তার রেভিনিউ কতটুকু উঠে আসবে তা সন্দেহজনক।
এক্ষেত্রে নতুন টিভি চ্যানেলকে বাজারকে ভাঙ্গতে হবে, অথবা নতুন বাজার তৈরি করতে হবে। নাহলে বর্তমানে বাচ্চা বাচ্চা চ্যানেলগুলো যে স্পন্সরশীপ ক্রাইসিসজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে, সে অবস্থা বহাল থাকবে। তাই বিষয়ভিত্তিক, যেমন শুধু গানের, শুধু বাচ্চাদের, শুধু কার্টুনের, শুধু হাল্কা ধারাবাহিক নাটকের, শুধু সিনেমার বা শুধু খেলার চ্যানেল থাকলে বিভিন্ন শ্রেণীর দর্শক তৈরী হবে এবং আশা করা যায় দেশের শিল্পপতিগণ সেই মার্কেট ধরার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। বিজ্ঞাপণ ছাড়াও আমাদের বিষয়ভিত্তিক চ্যানেলগুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশে, যেমন আফ্রিকা মহাদেশে সম্প্রচার করা যায়, তাহলে আমাদের পণ্য আফ্রিকার বাজার ধরতে পারবে, বিশেষ করে ওই মহাদেশের অনগ্রসর দেশসমূহে যাদের শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থা দুর্বল। আমাদের টাটা-আম্বানী-বিড়লা নেই তাতে কী? বসুন্ধরা-বেক্সিমকো-স্কয়ার ত আছে।
যদি তারা এই খাতে বিনিয়োগ করে আর কী। (কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? )
দ্বিতীয়ত, ডাবিং করা বিজ্ঞাপণ প্রদর্শন করা বন্ধ করতে হবে। আইডিয়ার যদি অভাব থেকে থাকে তাহলে বিদেশী অ্যাডগুলোই আবার বাংলাদেশী তারকাদেরকে দিয়ে তৈরি করানো হোক।
সম্ভাবনা
তৃতীয়ত, নতুন নাট্যকার এবং পরিচালকদের সুযোগ করে দেওয়া হোক। ১৭ কোটি মানুষের দেশে মেধাবী নাট্যকার-পরিচালকের অভাব হওয়ার কথা না।
তরুণদের লেখা বই এবং ব্লগ ঘাঁটলেই অসংখ্য মেধাবী পাওয়া যাবে।
চতুর্থত, বিদেশী কার্টুন ও শিশুতোষ অনুষ্ঠান বাংলায় ডাবিং করার জন্য আরও কয়েকটি ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা প্রয়োজন। এতে শীশুরা অন্তত নিজ ভাষায় শিক্ষামূলক বিনোদন পাবে। বর্তমানে ডাবিং করা অনুষ্ঠান যেগুলো প্রচারিত হয় তার প্রায় সবগুলো বলতে গেলে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের কাজ তা একঘেয়ে কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যায়।
পঞ্চমত, দেশে বেসরকারী উদ্যোগে বিদেশী সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি অ্যানিমেশন ফার্ম গড়ে উঠতে হবে।
চীন-জাপান এক্ষেত্রে ভালো সহযোগীতা করতে পারে।
সহজলভ্যতা
ষষ্ঠত, সবগুলো দেশী চ্যানেলকে সারাদেশে টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচারের অনুমুতি দিতে হবে এবং টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষও অবাধ তথ্যলাভ করবে।
সপ্তমত, দেশী সবগুলো চ্যানেলকে KU BAND স্যাটেলাইটে সম্প্রচার করার অনুমতি দেওয়া। বর্তমানে শুধু C BAND এর অনুমতি আছে।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিভিশন সম্প্রচার করার মাধ্যম হল দুটি- একটি C BAND দ্বিতীয়টি KU BAND।
এটি C BAND স্যাটেলাইট চ্যানেল রিসিভার। যে সব চ্যানেল C BAND সম্প্রচারিত হয় সে সব চ্যানেল এর মাধ্যমে দেখা যাবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সব স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং ইন্ডিয়ার প্রায় ১০০ বা তারও বেশি চ্যানেল দেখা যায় (নষ্টের গোঁড়া )। এই C BAND ডিশ আকারে বিশাল বলে বাড়ির ছাদ ছাড়া অন্য কোথাও সেট করা কষ্টকর।
তাছাড়া দামও কমবেশি আট হাজার টাকা।
আর এটি হচ্ছে KU BAND স্যাটেলাইট চ্যানেল রিসিভার। যে সব চ্যানেল KU BAND সম্প্রচারিত হয় সে সব চ্যানেল এর মাধ্যমে দেখা যাবে। বর্তমানে এর মাধ্যমে ইন্ডিয়ার প্রায় ৬০ চ্যানেল ফ্রি দেখা যায়। তবে দেশী চ্যানেল এবং পে-চ্যানেল বলে সনি-স্টার প্লাস জাতীয় নস্টা চ্যানেল দেখা যায় না।
এটি বাড়ির ছাদে, টিনের চালা, ঘরের জানালায়, ঘরের দেওয়ালে খুব সহজে সেট করা যায়। এর দাম তুলনামূলকভাবে কম, মাত্র ২৮০০ টাকা মধ্যে পাওয়া যায়।
আমদানী
অষ্টমত, ডিসকভারী চ্যানেল, কার্টুন নেটওয়ার্ক, অ্যানিম্যাক্স, এইচবিও সহ বেশ কয়েকটি চ্যানেল ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে আনলে ভাল হয়। যেমন সরাসরি আমেরিকা থেকেই সম্প্রচারিত চ্যানেল দেখান যায়। আর চীনা, জাপানী, কোরিয়ান, রাশিয়ান, আরবি, স্প্যানিশ চ্যানেল সম্প্রচারের উদ্যোগও নিতে হবে।
এছাড়া বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা ফ্রি-টু-এয়ার চ্যানেল ত আছেই।
তথ্যের জন্য ধন্যবাদ কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, ব্লগার ফিরোজ আলম এবং সচলায়তন এর পান্থ রেজা রহমানকে। টাইটেল ছবি নিয়েছি Kick out Indian Channels and their Rubbish culture from Bangladesh পেজ থেকে।
ওই মিয়া, অনেক আকাশে উড়ছেন এইবার নাইমা আহেন! ভড়তপেয়ারী সরকার থাকাবস্থায় এইগুলান চম্ভভ না।
ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন সবাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।