তোমাদের পাগল বন্ধু শেষ রাত। ফেনী রেলওয়ে স্টেশনটা ঘুমিয়ে রয়েছে। দু একটা কুকুর এদিক সেদিক লেজ নাড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশনের ষাটোর্ধ স্টেশন মাস্টার মোর্শেদ মজুমদার একটা বেঞ্চে বসে ভারী লেন্সের চশমা দিয়ে হাতের কাগজটা পড়ছেন হারিকেনের আলোয়। গুটিগুটি হাতের লেখা।
জায়গায় জায়গায় কালো পানীর ফোঁটার মত দাগ কাগজটায়।
“তুমি এলে না কেন আবীর?
জানো আমি কতক্ষণ তোমার জন্য এই স্টেশনে বসেছিলাম? একটার পর একটা ট্রেন চলে যাচ্ছিল সামনে দিয়ে। আমি একা একা বসে রয়েছি ওয়েটিং রূমের একটা চেয়ারে। সেই সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। বাসায় কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছি।
দুপুর দিকে নয়তো বিয়েটা হয়ে যেত। কে জানে খালা খালুর চাপাচাপিতে হয়ত শেষ মাথায় কবুলও বলে ফেলতে হত। তাই পালিয়ে এলাম। দ্বায় বদ্ধতা যদি নতুন সম্পর্কের ফাঁস হয়ে গলায় নেমে আসে- এই ভয়ে খালা খালুকে কিছু না বলে পালাতে হল। ছোট থেকে এই মানুষ দুটো আমার জন্য এত কিছু করেছেন যে তাদের কথা হয়ত আমি ফেলতে পারতাম না।
এভাবে পালিয়ে আসতে গিয়ে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল......
সকাল থেকে না খেয়ে বসে থাকতে থাকতে অসম্ভব খিদে লেগেছে। সঙ্গে অল্প কটা টাকা এনেছিলাম। তাই দিয়ে একটু আগে সন্ধ্যার দিকে স্টেশনের একটা সস্তা হোটেলে খেয়ে নিয়েছি। তুমি থাকলে হয়ত আমাকে এরকম ফুটপাথ টাইপের হোটেল থেকে খেতে দিতে না। বেশি খিদে পেলে মাথা ঠিক থাকে নাকি?
সারাদিন স্টেশনে বসে থেকে অনেক কিছু দেখলাম জানো।
খেয়াল করলাম একটা বাদামওয়ালা বাদাম বিক্রি করছে সেই কখন থেকে- অথচ আমার হিসেব মতে লোকটার সারা দিনেও পঞ্চাশ টাকার মত বেচা হয়নি। চলে কি করে?
একটা নুলো ফকির স্টেশনের প্লাটফর্মে গড়িয়ে গড়িয়ে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছিল। অদ্ভূত সব সুরে গান ধরেছে। শুনে মজা লাগছিল। স্টেশনে এভাবে একা একা কতক্ষণ বসে থাকা যায় বলো? লোকজন বারবার কেমন ভাবে তাকাচ্ছিল আমার দিকে।
অস্বস্তি লাগছিল খুব। তোমার দেরি হচ্ছে দেখে বারবার কান্না পাচ্ছিল। দেখছো না লেখতে গিয়ে কাগজটা ভিজিয়ে ফেলেছি? তুমিই তো বলো চোখে কাজল দিতে। কাজল দিয়ে কান্না করলে কেমন ভূতের মত দেখায় জানো? এলে দেখবে। তোমার শার্টের বুক ভিজিয়ে কালো করে ফেলবো দেখো!
জানো সন্ধ্যার পর থেকে স্টেশনটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।
কোনো সাড়া শব্দ নেই। ট্রেন এলে যেন ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠে স্টেশনটা- চলে গেলে আবার ঘুমিয়ে পরে। কারেন্ট নেই। জেনারেটরের হলুদ একটা ময়লা লাইট জ্বলছে ওপরে। চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগছে না দেখে প্লাটফর্মে হেটে বেড়াচ্ছি।
ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ষোল ঘুটি খেলছে। খাবার নিয়ে মারামারি করছে। দেখতে অনেক ভাল লাগে। কোথায় যেন মিল আছে আমার সাথে- ঠিক ধরতে পারলাম না।
আবীর তোমার বাসায় আমাকে মেনে নেবে তো? আমি তো দেখতে ফর্সা না, সুন্দরও না।
আমাকে পছন্দ করবে তো? জানো আমার অনেক শখ তোমার ঘরে গেলে সারাক্ষণ শাড়ি পরে থাকবো। সালোয়ার কামিজ পরবো না আর। এক পায়ে পায়েল পরে টুকটুক করে ঘুরে বেড়াবো তোমার বাড়িতে। সব কাজ একাই করবো। বিয়ের দু-এক বছরের মধ্যেই আমার এক গাদা বাবু চাই- সব গুলোকে নিয়ে তোমার মাথা পাগল করে দেবো!
আবির তুমি এখনো এলে না?
আমার খারাপ লাগছে খুব।
এভাবে একা বসে থাকতে কেমন লাগে? যদি বসে থাকতে তাহলে বুঝতে পারতে। আচ্ছা আমি যে তোমাকে এত বকবক করে লিখে যাচ্ছি- ক’লাইন লেখো তুমি আমাকে? আগে তো দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরিয়ে চিঠি লিখতে আমাকে- আর এখন? একটা লাইনও লেখার সময় হয় না তোমার। আর যে আমি কিনা দু কলম লিখতে চাইতাম না- তাকে চিঠি লেখার এমন অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছো যে এখন কিছু না হলেও তোমাকে এমনি এমনি লিখি। তুমি অনেক খারাপ। লিখো না কেন আর আমাকে?
আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে আবীর।
রাগ লাগছে তোমার ওপর। যতবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছি সময় কেবল গড়াচ্ছে। কতক্ষণ লাগে আসতে? আমার মত ভাল বৌ কিন্তু আর পাবে না বলে রাখলাম। এভাবে কেউ কাউকে অপেক্ষা করায়? বলো?
জানো আবীর, তোমাকে ভালবাসার পর থেকে সারাক্ষণ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি আমি। সবকিছু এত সুন্দর লাগে..... তোমার জন্য বোধ হয় আমার পৃথিবীটা এত সুন্দর হয়ে গেছে.......
হাত ব্যথা করছে।
একটু পরে লিখবো।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
রাত একটা বেজে গেছে। এখনো তোমার দেখা নেই।
তুমি এলে না কেন আবীর? কান্না আটকাতে পারছি না বলে প্লাটফর্মের একপাশের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। বৃষ্টি এসেছে।
তুমি থাকলে এতক্ষণে বৃষ্টিতে নেমে ভিজতাম। তুমি না থাকলে আমার কাছে সবকিছু খাঁঅ ছাড়া, অর্থহীন লাগে। তুমি এলে না কেন আবীর? তুমি বুঝতে পারছো না আমার কেমন দম আটকানো কষ্ট হচ্ছে? এভাবে কেউ কষ্ট দেয়? তুমি আসলেই অনেক খারাপ! খালি কষ্ট দিতে জানো। এখনো আসছো না কেন? আমি মেয়ে হয়ে স্টেশনে এত রাত পর্যন্ত তোমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি আর তুমি একটু এসে নিয়ে যেতে পারো না?
সব কিছু দূর্বোধ্য লাগছে আমার....... তোমাকে অনেক ভালবাসি আবীর। তোমার ভালবাসার ঘোরে সবকিছু আজ বড় অদ্ভূত লাগছে..... হঠাৎ হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগে।
আবীর তুমি আমার জগৎটা অনেক সুন্দর করে দিয়েছিলে.... কিন্তু আজ হঠাৎ সব কিছু কেন যেন রাতের অন্ধকারেই চির বিদায় নিয়েছে।
তুমি এলে না কেন আবীর?
আমি আর কাঁদতে পারছি না। কতক্ষণ এভাবে কাঁদবো একা একা? তুমি প্লিজ একটা বার আসো। আমার দম আটকানো অদ্ভূত একটা কষ্ট লাগছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে মাটিতে গড়িয়ে কাঁদি..... কিন্তু সব শক্তি শেষ হয়ে গেছে।
হঠাৎ হঠাৎ শূণ্য লাগে
আবছা আঁধার ঘোর,
রাতের প্রহর পেরিয়ে হায়
জাগলো না আর ভোর.........
- নাম লিখবো না। তুমি চিনে নিও”
মোর্শেদ মজুমদার চশমাটা খুলে হারিকেনের আলোয় প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালেন। হারিকেনের আলোয় একটা টিনের থালা হাতে নিয়ে ভাত খাচ্ছে মেয়েটা। পা তুলে বসেছে বেঞ্চে। ঝুঁকে ভাত খাচ্ছে, যাতে কেউ মুখ দেখতে না পায়।
ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়েছে। তবুও হারিকেনের আলোয় মোর্শেদ সাহেব দেখতে পাচ্ছেন ওড়নার আড়াল থেকে ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি প্লেটের ভাতের ওপর পরছে, তার মাঝেই খেয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
গত ছয় মাস ধরে মেয়েটা এই রেলওয়ে স্টেশনে পাগলের মত পরে রয়েছে। প্রথম রাতেই মেয়েটা ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পরে মরতে গিয়েছিল। মোর্শেদ সাহেব সময় মত না বাঁচালে হয়ত আজ আর দেখতে হত না।
সেই রাত থেকে আর কোনো কথা বলেনি মেয়েটা আজ পর্যন্ত। নাম ঠিকানা না থাকায় মেয়েটা কোত্থেকে এসেছে জানা যায়নি। তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন তার বাড়িতে নিয়ে যেতে- পারেননি।
মোর্শেদ সাহেব গত ছয় মাস ধরে চিঠিটা পকেটে নিয়ে ঘুরছেন। কেন তিনি নিজেও জানে না।
সে রাতে মেয়েটাকে বাঁচানোর সময় এটা পেয়েছিলেন। ফেরত দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মেয়েটা নেয়নি। কাগজটা যেন চিনতেই পারেনি সে।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে আবার তাকালেন, এখনো চোখের পানি ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে ভাতের প্লেটের ওপর........ মোর্শেদ সাহেব শক্ত মনের মানুষ। তারপরেও অবাক হয়ে খেয়াল করলেন তার চোখেও পানি জমে উঠেছে......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।