অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে আরম্ভে
প্রথমেই স্মরণ করিতেছি বঙ্কিম বাবুর অমর শব্দমালা ! তিনি কী এক আশ্চর্য কৌশলে শতবর্ষ অগ্রবর্ত্তী হইয়া সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া কহিলেন, হে গর্দভ, আমি পূজ্য ব্যক্তির সন্ধানে সসাগরা বসুধা ভ্রমণ করিয়া দেখিতে পাইলাম সর্বত্র আপনারই জয়গান। সকলে আপনারই পূজা করিতেছে। অতএব, হে সর্বব্যাপিন, আপনি আমার পূজাও গ্রহণ করুন। কে বলে আপনার পদগুলি ছোট ? সর্বত্র বড় বড় পদে আপনাকেই আসীন দেখিতে পাইতেছি। .. বিধাতা আপনার তেজ দেন নাই, এই জন্য আপনি শান্ত, তিনি আপনার বেগ দেন নাই, এই জন্য আপনি সুধীর এবং পরের মুট না বহিলে খাইতে পান না বলিয়া আপনি পরোপকারী।
.. অতএব হে মহাত্মা, ঘাস খাইয়া সুখী কর। বঙ্কিম বাবুর আশ্চর্য প্রতিভাস্পর্শে নিতান্ত অপদার্থ চতুষ্পদও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছিল। বঙ্কিম বাবুর ন্যায় বলিষ্ঠ সাহিত্যস্রষ্টা এতদঞ্চলে ইদানিং অনুপস্থিত। এই কারণ হেতু অদ্য চতুষ্পার্শ্বের বহু বিশিষ্ট পদার্থও শব্দপটে চিত্রিত হইয়া পাঠকের সম্মুখে উপনীত হইবার যোগ্য সম্মানটুকু হইতে বঞ্চিত।
মূলে
রাজধানীর রাস্তাঘাটের ‘উন্নয়নকার্য’ পুনরায় অনেকের দৃষ্টিপথ আচ্ছন্ন করিয়া তুলিয়াছে।
২০১১ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ হইতে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ অব্দি কয়েক দফায় এই ‘উন্নয়নকার্য’ তাহাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল। ইহাতে তাহারা ভাবিয়াছিল- যাহা হোক, এত ব্যাপক সময় নিয়া কয়েক দফায় উন্নয়নকার্য চলিয়াছে, কাজেই এই উন্নয়ন টেকসই না হইয়া যায় না। অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আর এইরূপ দৃশ্য দেখা যাইবে না। কিন্তু গত সপ্তাহে এই দৃশ্য পুনরায় দেখিয়া তাহারা হতাশ। তাহাদিগকে বলিতেছি, শ্রবণ করুন-
হ্যাঁ, হইতে পারে যে কলেজগেট হইতে গাবতলী পর্যন্ত রাস্তাটি গত এক বর্ষব্যাপী উন্নয়নপ্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া গিয়াছিল এবং গত সপ্তাহে একই রাস্তায় পুনরায় উন্নয়নকার্য আরম্ভ হইতে দেখা গিয়াছে, কিন্তু ইহাতে আশ্চর্যের কী আছে ! ইহা এতদঞ্চলে নূতন কোন দৃশ্য নহে।
এই দৃশ্য আপনি শিশুকাল হইতে দেখিয়া আসিয়াছেন। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ উন্নয়নকার্য বিষয়ে সজাগ। সড়ক মেরামত হইবার পর কয়েক মাস না যাইতেই পুনরায় একই কার্য দেখিয়া উন্নয়নকার্য টেকসই কিনা ইহা লইয়া সন্দেহ পোষণ করা নিশ্চয় নাগরিক আনুগত্যের প্রতিকূলে। বরং দৃষ্টিকে ইতিবাচকরূপে পরিবর্তিত করিয়া লওয়ার মধ্যেই দেশ ও জাতির সমূহ কল্যাণ নিহিত।
যানজট একটি স্বাভাবিক নাগরিক দৃশ্য।
ইহা আর নূতন কী ! আর সড়ক উন্নয়নকার্যও নাগরিক সেবার একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ইহাতে হয়তো যানজট কিঞ্চিত বাড়িয়া উঠে। কিন্তু তাহা যত না বাড়িয়া উঠে আপনি তাহার অধিক উহা ফলাও করেন। আপনি হয়তো বলিবেন মুমূর্ষু রোগী লইয়া অপেক্ষমান অ্যাম্বুলেন্স এর কথা যাহাকে এমনিতেই বিদ্যমান যানজটের অত্যাচারে আগাইতে রীতিমত যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে হয়। আপনি হয়তো বলিবেন প্রতিষ্ঠানে সময়মত উপস্থিত হইবার আশায় অপেক্ষমান ইশকুল কলেজগামী শিক্ষার্থীগণের কথা যাহারা ভবিষ্যতে জাতির মেরুদণ্ড শক্তিশালী করিয়া তুলিবে।
আপনি হয়তো বলিবেন মধ্যরাত্রিতে শয্যাগত হইয়া প্রত্যুষে উঠিয়া লেট হইলে গেট লাগিয়া যাইবার ভয়ে ভীত গার্মেন্টসকর্মীগণের কথা যাহারা বিশ্বমন্দার সময়েও আমাদিগের প্রবৃদ্ধি ৬ এর উপরে ধরিয়া রাখিয়াছেন। স্মরণে রাখিবেন, বৃহৎ স্বার্থে কতিপয় ক্ষুদ্র স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত না থাকিতে পারিলেন তো কীরূপে সমাজ আগাইয়া যাইবে ?
উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ উপযুক্ত কার্যে নিযুক্ত আছেন। হীনবুদ্ধি লোক সেইসব উন্নতমস্তিষ্কপ্রসূত পরিকল্পনার কী বুঝিবেন ? মনে করিবেন না সামান্য দুই একটা চিহ্ন দেখিয়াই আপনার চক্ষু প্রস্ফুটিত হইয়া গিয়াছে। ধৈর্য ধরুন। সম্মুখে আরো দৃশ্য প্রতীক্ষায় আছে।
অন্তে
ধন্য বঙ্কিমবাবু ! আপনার চর্ম্মচক্ষু কী করিয়া কালের অত সুদূরপ্রসারী বিস্তার অনায়াসে ভেদ করিয়া দূরবীক্ষণ যন্ত্রের ন্যায় সমস্ত খুঁটাইয়া দেখিল তাহাই ভাবি। অদ্য বঙ্গীয় জনপদের উন্নয়নের ভার যাহাদিগের উপরে, তাহাদিগের অবস্থা যেরূপ দেখিতেছি তাহাতে দেশ ও দশের ভবিষ্যতের পানে চাহিয়া নিকষ কালো তিমির ভিন্ন আর কিছু দৃষ্টিতে আসে না। কর্তৃপক্ষ যে ইহাতে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ইহা বলা অন্যায়। তাহারা প্রতিনিয়ত নিত্যনূতন পরিকল্পনা করিয়া চলিয়াছেন এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাবলা বৃক্ষের বীজ ক্রয় করিতে লোকও প্রেরণ করিয়াছেন, এবং তাহা শ্রবণে আমাদিগের বদনে হাসি ফুটিয়াছে। ভাবিতেছেন ইহার সঙ্গে বাবলা বৃক্ষের বীজ ক্রয় করিবার এবং হাসি ফুটিবার সম্বন্ধ কী?
একদা হোজ্জা তাহার এক আত্মীয়ের নিকট হইতে কিছু অর্থ ধার করিয়াছিল।
দিবস অতিক্রান্ত হয়, ধার শোধ হয় না। অবস্থা এইরূপ দাঁড়াইল যে ঐ আত্মীয় হোজ্জার দৃষ্টিসীমায় আসিলে হোজ্জা তাহার গতিপথ এইরূপে পরিবর্তন করিয়া লইত যাহাতে তাহার সহিত সাক্ষাত না হয়। আত্মীয়টি তাহা টের পাইয়া এক প্রভাতে হোজ্জার বাড়ি আসিয়া উপস্থিত। হোজ্জা তাহার কণ্ঠ শুনিতে পাইয়া চৌকির নিচে আশ্রয় লইল। হোজ্জার স্ত্রী দ্বার উন্মুক্ত করিলে আত্মীয়টি হোজ্জার সন্ধান করিল।
হোজ্জার স্ত্রী বলিল যে হোজ্জা তাহার অর্থের ব্যবস্থা করিতে গিয়াছে। আত্মীয়টি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল হোজ্জা কী ব্যবস্থা করিতে গিয়াছে। তখন হোজ্জার স্ত্রী বলিল যে হোজ্জা বাবলা বৃক্ষের বীজ ক্রয় করিতে গিয়াছে। সেই বীজ ফেলিয়া রাখিলে কিছুদিনের মধ্যেই তাহাদিগের আঙ্গিনায় বাবলা বৃক্ষ জন্মাইবে। তাহাদের আঙ্গিনা দিয়া প্রচুর ভেড়ার গতায়াত।
যখন বাবলা বৃক্ষগুলি পুষ্ট হইবে আর তাহাদিগের গাত্রে কণ্টক গজাইবে, ভেড়াকুলের শরীর হইতে কিয়দাংশ পশম কণ্টকে আটকাইয়া থাকিবে। সেই পশম সংগ্রহ করিয়া বাজারে বিক্রয় করিয়া যে অর্থ পাওয়া যাইবে তাহা দিয়াই ধার শোধ হইবে। শুনিয়া আত্মীয়টি দুঃখে হাসিতে লাগিল। সেই হাসি শুনিয়া হোজ্জা আর থাকিতে পারিল না। সে তাহার আশ্রয়স্থল ত্যাগ করিয়া সম্মুখে অবতীর্ণ হইল এবং বলিল, এখন টাকা পাইবার কথা শুনিয়াছেন, এখন তো হাসিবেনই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।