আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার আদরের ছোট বোন! (আমার মেডিকেল কলেজ জীবন-৯)

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” হোস্টেল লাইফে সবচেয়ে জুনিয়র থাকার মজাই আলাদা। সেই মজাটা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে গেলাম জে-৯ আসাতে। কিন্তু সিনিয়র হওয়ার অনুভূতিটাও খারাপ নয়। চালচলনে ভারিক্কী ভাব আর কিছুটা দায়িত্বও কাঁধে চলে আসে। প্রথম দিকেই আমরা জুনিয়রদের কিছু নিয়ম কানুন জানিয়ে দিলাম।

সবাইকে সালাম দিতে হবে (ক্যাম্পাসে ওদের চেয়ে তো জুনিয়র আর কেউ নেই, তাই না?), হোস্টেলের বাইরে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট বা লুঙ্গী পরে যাওয়া যাবে না, সিনিয়রদের সামনে সিগারেট ধরানো যাবে না, কথা বলতে হবে নিচু কন্ঠে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সবাইকে এই কথা বলা যে, একাডেমিক ব্যাপারে কারো কোনো সমস্যা হলে আমাদের দরোজা সবসময় খোলা। প্রথম কয়েক রাত ওদের সাথে পরিচিত হতেই পার হয়ে গেলো। এভাবেই পরিচয় হলো শোয়েবের সাথে। শোয়েবের সাথে পরিচয়টা ঘনিষ্ঠ করার কারণ ছিলো ‘দিয়াশলাই’ কবিতা আবৃত্তিকারী সেই শ্যামলা বর্ণের হরিণের মতো চঞ্চলা মেয়েটি।

শোয়েব আমাকে আশ্বাস দিলো, আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম, ববির মতো অবস্থা হবে না তো? দ্বিতীয় বর্ষে উঠে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলো। আমি এমনিতেই ফাঁকিবাজ ধরনের ছাত্র। সবসময় টো টো করে ঘু্রে বেড়াই, আর পরীক্ষার দুই তিন আগে থেকে পড়তে বসে সব গুবলেট করে ফেলি। অনেক চিন্তা করে পরীক্ষার আগের রাতে অন্যদের মাথাও গুবলেট করার উপায় বের করে ফেললাম। প্রতিটি কার্ড ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভার আগে যতসব এটিপিক্যাল প্রশ্ন খুঁজে বের করে রাখতাম আর অন্যদের রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে মাথা ব্ল্যাকআউট করে দিয়ে আসতাম আর বলতাম এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

নিজে রুমে এসে কমন প্রশ্ন গুলোই পড়তাম। পরীক্ষার সময় মনোয়ার আমাদের রুমে এসে পড়তো, ওকে সব সময় দেখতাম শুয়ে শুয়ে পড়তে, এক সময় বই বুকের উপরে রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। মাহবুব আর দাদা (ভাস্কর) ছিলো আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পড়ুয়া ছেলে। মাহবুবকেও আমি কখনো টেবিলে বসে পড়তে দেখেনি, ও বিছানার উপর পা তুলে বসে পড়াশোনা করতো। আমার পরের রোল নম্বর ছিলো ফিস্টুর (রাসেল)।

ফিস্টু যে অংশটা পড়ত না, আমাকে এসে বলে যেতো, আমি সেটা পড়তাম। আবার আমি যেটা পড়তাম না, সেটা ওকে বলতাম। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আমাদের বেশীরভাগ মেয়েই কখনোই বলতো না পরীক্ষা ভালো হয়েছে। বিশেষ করে আমার বনলতা সেন, মানে শাওন। সবসময় পরীক্ষার পর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতো সে ফেল করবে।

রেজাল্ট দেওয়ার পর দেখা যেতো প্রথম তিন-চার জনের মধ্যে সে আছে। আমার আইটেম পার্টনার ছিলো জারীন খান, ওকে কখনো জেরীন খান বললে খুব রেগে যেতো, একসাথে আইটেম দিতে গেলে আমাকে খুব সাহায্য করতো। আর ছিলো তারজিয়া, ওর বাবাও একজন ডাক্তার, বাংলাদেশের খুব নামকরা চক্ষু চিকিৎসক। তারজিয়া বলতো, ‘জানি না কীভাবে পরীক্ষা দিয়েছি। ’ রেজাল্টের পরও বলতো, ‘জানি না কীভাবে পাশ করেছি।

’ নেপালীরা ছিলো এ ব্যাপারে একেবারেই অন্যরকম। ভালো হোক, খারাপ হোক, ওরা বলতো, ‘দিয়েছি’। কি রকম দিয়েছে সেটা আর রেজাল্টের আগে বের করা যেতো না আর রেজাল্ট হতো ফাটাফাটি। নেপালী ছেলেদের মধ্যে পড়াশোনায় সবচেয়ে ভালো ছিলো বিজ্ঞান ভান্ডারী, মেয়েদের মধ্যে কখনো মেরিনা মানান্ধর, কখনো পুজা লামা। আমি ভাইভা দিতে সবচেয়ে বেশি নার্ভাস হয়ে যেতাম দ্বিজেন স্যারের সামনে।

আমাদের শরীরের সব মাংশপেশীই তিন ধরনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কার্ডিয়াক মাংশপেশী শুধুমাত্র হৃৎপিন্ডে থাকে, স্মোথ (smooth) মাংশপেশী, যা আমার নিজের ইচ্ছায় নড়াচড়া করাতে পারবো না এবং স্কেলেটাল (skeletal) মাংশপেশী, যা আমি নিজের ইচ্ছেমতো নাড়াতে পারবো। একবার হেড এন্ড নেক-এর কার্ড ফাইনালে দ্বিজেন স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন জিহবার মাংশপেশী কোন ধরনের। আমি বলে ফেললাম স্মোথ। স্যার তখন আমাকে বললেন জিহবা দেখাতে।

আমি যখন জিহবা বের করে স্যারকে দেখালাম, তখন আমার দু’টো জিনিস মনে হলো। এক, আমি স্যারকে জিহবা দেখাচ্ছি, আর দুই, আমি জিহবা নড়াতে পারছি, তারমানে এটা স্কেলেটাল মাংশপেশী। বলাই বাহুল্য, এই হেড এন্ড নেক পরীক্ষাটি আমাকে আবার দিতে হয়েছিলো। এরই মধ্যে শুরু হলো কলেজের ইতিহাসে দ্বিতীয় ইনডোর গেমস। চিন্তা করলাম হরিনীর সামনে নিজেকে প্রকাশ করার এই উপযুক্ত সময়।

এক সময় দাবা খুব ভালো খেলতাম, গেমসে প্রথম রাউন্ডের রি-ম্যাচে (প্রথম খেলা ড্র হয়েছিলো)চাপে পড়ে সিনিয়র ভাইকে ওয়াকওভার দিয়ে দিলাম, টেবিল টেনিসে প্রবল প্রতিপক্ষে্র বিরুদ্ধে খেলে তৃ্তীয় সেটে পরাজিত হলাম আর ক্যারাম বোর্ডে চঞ্চলা হরিনীর সামনে প্রথম খেলাতেই শূন্যতে হেরে গেলাম। নিজেকে আর প্রকাশ করা হলো না! হতাশায় নিমজ্জিত হবার আগেই বিধাতা আমার দিকে ফিরে তাকালেন। জানা গেলো, সে আমার ছোট বোনের সাথে ঢাকার এক নামকরা কলেজে পড়াশোনা করেছে, তার মানে আমার বোনের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে। এদিকে আবার ওদের ব্যাচ থেকে ম্যাগাজিন কমিটির প্রতিনিধি নির্বাচিত হলো, যে কমিটিতে আগে থেকেই আমি ছিলাম। আমি তখন খুশিতে আত্নহারা! বিধাতা যখন কাউকে দিতে থাকেন, তখন শুধু দিতেই থাকে্ন।

কিছুদিন পর শোয়েব আমাকে জানালো, হরিনী আমার সাথে ঢাকাতে দেখা করতে রাজী হয়েছে। আমি যেনো আকাশে উড়তে থাকলাম! কলেজের বন্ধের দিনে ঢাকায় এসে লালমাটিয়া আড়ং-এ ওর সাথে দেখা করলাম। প্রথমেই ক্যাফেতে বসে খাওয়া-দাওয়া। এরপর সে বলা শুরু করলো, ‘আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে, ভাইয়া’; আমার হৃৎপিন্ডের ধক্ ধক্ আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘আপনি আমার বান্ধবীর বড়ো ভাই, তারমানে আমারো বড়ো ভাই’; আমার হৃৎপিন্ডের ধক্ ধক্ আওয়াজ মনে হলো মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো, ‘আপনি আমাকে আপনার আদরের ছোট বোনের মতোই দেখবেন আশাকরি’! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।