আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাহমিমা আনামের সাথে এক সন্ধ্যা

মনের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবনাগুলোর মিলিয়ে যাওয়া দেখি। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে, ঐ দূর দিগন্ত পানে... শুরুতেই তাহমিমা আনাম সম্পর্কে কিছু বলে নিই, তাহমিমা আনাম হচ্ছেন একজন লন্ডনভিত্তিক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক যার প্রথম উপন্যাস "A Golden Age" কমনওয়েলথ রাইটার্স পুরষ্কার জিতে নেয়। তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Anthropology তে পিএইচডি লাভ করেন। উপন্যাস লেখালেখি ছাড়াও New York Times এবং Guardian পত্রিকার মতোন প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোতেও তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাহমিমা আনামের আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি Daily Star পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের কন্যা।

তাহমিমা আনাম সম্প্রতি তার Trilogy-র দ্বিতীয় উপন্যাস "The Good Muslim"-বইটা সম্পর্কে আলোচনা করতে নিউইর্কের এশিয়া সোসাইটিতে এসেছিলেন যেখানে একজন শ্রোতাদর্শক হিসেবে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। গোড়াতেই বলে রাখছি উনার লেখা বই দুটোর একটাও এখনো আমার পুরোপুরি পড়া হয়ে উঠেনি। "A Golden Age" বইটা অনলাইন থেকে কিনেছিলাম একটা লাইব্রেরী থেকে। কিছুটা পড়ার পর আর পড়বার অবকাশ ঘটেনি। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা বেশ অনেকগুলো প্রবন্ধ পড়া হয়েছে আর অনলাইনে বেশ কিছু টকশোতে তার অংশগ্রহণ আর বক্তব্য শুনে এবং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

তার কথা বলার ভঙ্গী, হাসিটা আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করে ভীষণ। তাছাড়া আমি তার বাবা মাহফুজ আনামেরও একজন গুণমুগ্ধ প্রশংসক। টিভিতে কোন অনুষ্টানে উনাকে দেখলেই বসে পড়ি দেখতে। এমন গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলেন। মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়।

মেয়ে বোধহয় তার বাবার এই গুণটায় পেয়েছে। এমন বলিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাপ মেয়ে দুজনের। তাহমিমা আনাম সম্পর্কে আরো জানবার কৌতুহল থেকেই ফেইসবুকে আমি একটা ফ্যান পেইজ খুলি উনার নামে। কিছুদিন পর দেখি তাহমিমা আনাম ওফিসিয়াল নামে লেখক নিজেই আরেকটি পেইজ খুলে এবং দেখলাম আমার খোলা পেইজটাকে উনি উনার পেইজের লিঙ্কে ঢুঁকিয়ে রেখেছেন। তো উনি নিউইর্কে আসছেন জানতে পেরে উনাকে সামনাসামনি দেখবার অদম্য ইচ্ছেটা আর সংবরণ করতে পারলাম না।

গেলাম অফিসের কাজ শেষ করে আর নিয়ে গেলাম সাথে করে A Golden Age বইটা। তো সূচনা পর্ব শেষে শুরুতেই তিনি তার দ্বিতীয় উপন্যাস "The Good Muslim" থেকে দুইটা প্যারা পড়া শোনান আগত শ্রোতাদর্শকবৃন্দের জন্য। উপস্থিতদের মধ্যে বাঙ্গালী দেখলাম হাতে গোণা গুটি কয়েকজন মাত্র। বেশীর ভাগই সাদা আমেরিকান এবং অন্যান্য দেশী। উনার প্রথম উপন্যাসটা ছিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।

আর পরের উপন্যাসটা যুদ্ধের পরের সময়গুলো নিয়ে। যেখানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, দুই ভাইবোন মায়া এবং সোহেল যুদ্ধের পর নিজেদের নিজেদের জীবনের পথ, আদর্শ, মতবাদ এইগুলো নিয়ে দ্বন্দে জড়িয়ে পরে। সোহেল ধর্মীয় গ্রন্থের মাঝে নিজের পথ খুজে পায় আর অন্যদিকে মায়া বেছে নেয় ভিন্ন পথ। সে চায় ডাক্তার হয়ে সাধারণ জনগণের উপকার করতে। প্যারাদুটো পড়া শেষে তাহমিমা আনামের সাথে আলোচনায় সঞ্চালক হিসেবে যোগ দেন সামিনা কোরেশী, যিনি একজন পাকিস্থানী-আমেরিকান লেখক।

সামিনাঃ "এই বইগুলো লেখার পেছনে আপনি কি আপনার তথ্যানুসন্ধান প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলবেন?" তাহমিমা বলেন, শুরুর দিকে তিনি Anthropologist হতে চেয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তিনি বাংলাদেশে গিয়ে বেশ কবছর তথ্যানুসন্ধান করেন যুদ্ধের সময়কার ঘটনাগুলো জানবার জন্য। তিনি সম্মুখসমরের গোলাগুলির মুহূর্তগুলো্র চাইতে সে সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের নানা ঘটনাগুলো জানতে বেশী আগ্রহী ছিলেন। এইভাবে তিনি বেশ অনেক চমকপ্রদ কাহিনী সম্পর্কে জানতে পারেন। তার মতে সেই সময়টাতে প্রেমের বিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশী হয়েছে কারণ তখন নারী পুরুষ তুলনামূলক কম বাধায় মেলামেশা করতে পেরেছে।

এইসব ঘটনার বিবরণ দিয়ে তাহমিমা বলছিলেন তিনি সেই ঘটনাগুলো লিখবার একটা তাগিদ অনুভব করেন আর সেই থেকেই উপন্যাস লেখার সূত্রপাত। সামিনা এরপর তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানকে পাকিস্থানের "cultural capital" আখ্যা দিয়ে বলেন, তাহমিমাকে তার বাবা-মা পাকিস্থান সম্পর্কে কি ধারণা দিয়ে বড় করেছেন আর যুদ্ধের পরে তাহমিমার সেই ধারণা কেমন করে পাল্টেছে। এই প্রশ্নের উত্তর তাহমিমা যেমন বলিষ্ট ভাবে দিলেন দেখে একধরণের গর্ববোধ হল। তিনি বলছিলেন, ম্যাপ দেখলে যে কেও দেখতে পাবে পশ্চিম পাকিস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্থান এর দূরত্ব কতটুকু। তার উপর দুই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ভিন্ন।

তিনি ভেবে পাননা এর পরেও কিভাবে পূর্বপাকিস্থানকে পাকিস্থানের "cultural capital" বলা যায়। এই পর্যায়ে তাহমিমা সামিনাকে উল্টো প্রশ্ন করেন, পাকিস্থানে ছেলেমেয়েদের '৭১ এর যুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয় কিনা। উত্তরে সামিনা স্বীকার করে নেন, হয় না। তিনি বলেন হয়তো নিজেদের জাতির উপর অহংকার আর ছোট হয়ে যাওয়ার মানসিকতা থেকেই বোধহয় এমন। আগত শ্রোতাদর্শকবৃন্দের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বের এক পর্যায়ে একজন জানতে চান - "আপনি বলছেন বাংলাদেশ একটা মডারেট রাষ্ট্র, কিন্তু তাও কেন মত প্রকাশের দায়ে কিছু লেখককে (তসলিমা নাসরিন) দেশ ছাড়তে হল নিরাপত্তার খাতিরে?" - উত্তরে তাহমিমা বলেন একধরনের সেন্সরশীপের সংস্কৃতি যে আছে সেটি বলা বাহুল্য, অবশ্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত এবং চীনের মত দেশগুলোতেও এটি আছে।

তিনি বলেন তসলিমার সাথে যা হয়েছে সেটি দুর্ভাগ্যজনক, তার মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত ছিল। এও যোগ করেন, যারা তসলিমার সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারতো তাদের সাথেও অবশ্য সে নিজেকে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারেননি। "মেহেরজান" চলচিত্রে একজন বাংলাদেশীর সাথে পাকিস্থানী সৈন্যের প্রেম দেখিয়েছে বিদায় চলচিত্রটির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ার প্রসংগ ঠেনে একজন তাহমিমাকে প্রশ্ন করেন, এই সম্পর্কে তাহমিমার কোন বক্তব্য আছে কিনা। তাহমিমা বলেন, মুভিটা তিনি দেখেননি তাই মুভিটা সম্পর্কে কোন বক্তব্য করতে পারবেন না। কিন্তু যদ্দুর জেনেছেন তাতে তার ধারণা, মুভিটাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করা আর যুদ্ধের ভয়াবহটাকে যথাযথভাবে তুলে আনেনি বলে সাধারণ জনগণের প্রতিবাদের মুখে ডিস্ট্রিবিয়ার হল থেকে মুভিটা তুলে নেয়।

হয়তো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও চাপ ছিল। তাহমিমা তার সাক্ষাতকারের গোড়ার দিকে বলছিলেন তিনি লেখক হতে চাননি তার ক্যারিয়ারের শুরুতে। এই প্রসঙ্গটি তুলে ধরে একজন প্রশ্ন করছিলেন কি প্রেক্ষাপটে তিনি লেখালেখিকে নিজের পেশা হিসেবে নিলেন। এর উত্তরে তাহমিমা বলছিলেন প্রথমে তার লক্ষ্য ছিল শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেওয়া, পরে একটা রাইটিং ক্লাস করতে যেয়ে তার মনে হল হয়তো নিজের যোগ্যতা যাচায় করার জন্য নিজেকে তিনি এক বছর সময় দিয়ে দেখতে পারেন। এর ভেতর না হলে শিক্ষকতা পেশায় নামবেন।

তখন কিছু মানুষের সাথে তার পরিচয় হয় আর তখন থেকে তার বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে, না সম্ভব লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেয়া। আর সেই একবছরের মধ্যেই তিনি তার প্রকাশক পেয়ে যান। তারেক মাসুদের মৃত্যুকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে সে সম্পর্কে কোন বক্তব্য আছে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নকারীকে এই প্রশ্ন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তাহমিমা বললেন, তারেক মাসুদ বাংলাদেশের আব্বাস কিয়ারোস্তামী হতে পারতো। দেশের জন্য অনেক বিরাট একটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে উনাকে হারিয়ে। এই প্রসঙ্গে তাহমিমা তারেক মাসুদের "The Clay Bird" (মাটির ময়না) মুভিটার কথা ঠেনে সবাইকে অনুরোধ করেন না দেখে থাকলে দেখবার জন্য।

কিভাবে পরিচালক তার শৈশবের মাদ্রাসা-র অভিজ্ঞতা মুভিটাতে তুলে এনেছেন সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এও বলেন মুভিটাতে তাহমিমা নিজেও অংশ নিয়েছেন। তারেক মাসুদকে হারানো শুধু চলচিত্র অঙ্গনের জন্যই বিরাট ক্ষতি না জানিয়ে তাহমিমা বলেন, চলমান যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহের কাজেও তারেক মাসুদ অগ্রনী ভূমিকা পালন করছিলেন। সাক্ষাতকার পর্ব শেষে বইয়ে সই করিয়ে নেওয়ার জন্য আর সবার মতো আমিও লাইনে দাড়ালাম। যখন আমার পালা এল তখন এত কাছ থেকে উনাকে দেখে এমন নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম।

বইটা কোনভাবে বাড়িয়ে দিয়ে থেমে থেমে বললাম, ফ্যানপেইজ খুলবার কথা। উনি কিছুটা চমকে গিয়ে বললেন, "was it you"..আমি উত্তরে হেসে হ্যাঁ বলাতে উনিও হাসলেন। হেসে বললেন "keep in touch"। তখন আমি ভেতরে ভেতরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, যাক বলে ফেলা গিয়েছে কথাটা। সেই তখন থেকেই ভাবছিলাম কেমন করে বলি, আর বললে প্রতিক্রিয়াটা কি হবে।

বেড়িয়ে আসতে আসতে এশিয়া সোসাইটির একজন অফিসার বলছিলেন, বাংলাদেশের উপর ভবিষ্যতে আরো কাজ করবার কথা। আরো শিল্পী, লেখককে আনবার কথা। মনে ভাবছিলাম যাক ভালোই হবে তাইলে। তারই অংশ হিসেবে আর কদিন পরেই প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা কে আমন্ত্রণ করেছে। মঙ্গোলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে বোধহয় একটা সাক্ষাতকারে অংশ নিবেন।

ইন্টারভিউটা পুরো দেখতে পারবেন নীচের লিঙ্কে গেলে। একঘন্টা থেকে একটু বেশী। Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।