আরেকটা রায় আজ। এবং যথারীতি আরেকটা হরতাল। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় হবে আজ। গতকাল সকালে এই রায়ের খবর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হলে একজন পাঠক অনলাইনে মন্তব্য করেন, ‘তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হোক! গো আযমের ফাঁসি না হলে উনি তো আন্ডাবাচ্চা, উনার কেন ফাঁসি হবে?’
আরেকজন লিখেছেন, ‘গুরুর রায় ৯০ বছর। বাচ্চা পোলাপানের রায় কত আর...?? নাকি বয়স কম এ জন্য খালাস দিয়ে দেবেন, অথবা কিশোর সংশোধনশালায় পাঠাবেন?’
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে মানুষ কতটা উদ্গ্রীব, তা এসব মন্তব্য থেকে বোঝা যায়।
একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী যে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল, আর গোলাম আযম যে ছিলেন ওই সব নৃশংস অপরাধ সংঘটনের মূল হোতা, সে সবই জানে দেশবাসী। সে জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে সবার এত ক্ষোভ।
শুধু দেশের মানুষ না, বিদেশের পত্রিকাও অনেক কঠোর মন্তব্য করেছে। দুবাইভিত্তিক পত্রিকা গালফ নিউজ গোলাম আযমকে ‘বাংলাদেশের হিটলার’ নামে আখ্যায়িত করেছে। ওরা খবরের শিরোনামে লিখেছে, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড বাংলাদেশের হিটলার গোলাম আযমের।
’ কত ঘৃণ্য অপরাধ করলে একজন ব্যক্তি সম্পর্কে আরব দেশের একটি নামজাদা পত্রিকা এ রকম চূড়ান্ত মন্তব্য করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অপরাধ মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু তাঁর বয়সের বিবেচনায় ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও দায়ী করা হয়েছে। একাত্তরের ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জামায়াতে ইসলামীকে একটি অপরাধী সংগঠন বলে মন্তব্য করেছেন।
অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা রণাঙ্গনে থেকে প্রতিদিন সকাল-বিকেল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সৃষ্ট রাজাকার-আলবদর-আলশামস-শান্তি কমিটিকে অভিশাপ দিতাম। যখন খবর আসত পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় রাজাকাররা আমাদের সহকর্মীদের
হত্যা করছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে, মা-বোনদের নির্যাতন করছে, তখন আমরা শপথ নিতাম স্বাধীন বাংলায় এসব সংগঠনের বিচার হবে।
স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোকে বেআইনি করা হয়েছিল। গণহত্যাকারীদের বিচার শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেন।
তাঁদের বিচার বন্ধ হয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী আবার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তাদের নেতারা এমনকি মন্ত্রীও হন।
এ অবস্থায় স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আদালতের রায়ে জামায়াতে ইসলামী সংগঠনটির প্রকৃত চিত্র আবার উদ্ঘাটিত হলো। জামায়াতের অপরাধী চরিত্রটি মানুষকে আবার স্মরণ করিয়ে দিল এই রায়।
রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিষয়ে বলা হয়েছে, একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বার্থে এ ধরনের স্বাধীনতাবিরোধীদের সরকারের কোনো নির্বাহী পদে, সামাজিক ও রাজনৈতিক দলে এবং সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের কোথাও ঠাঁই দেওয়া উচিত নয়। লাখ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক একটি দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এসব উচ্চ পদে এই স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে কোনোভাবেই আসীন হতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও ট্রাইব্যুনাল তাঁদের পর্যবেক্ষণে বলেছেন।
ট্রাইব্যুনালের এই পর্যবেক্ষণ বর্তমান ও আগামী দিনের সরকারগুলো কতটা কার্যকর করে, সেটাই দেখার বিষয়। যদি এসব দিকনির্দেশনা মেনে চলা হয়, তাহলে আগামী দিনে জামায়াত-শিবিরের কোনো নেতা-কর্মীর গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ার সুযোগ থাকবে না।
কিন্তু জামায়াত-শিবির তো বীরদর্পে রাজনীতি করে চলেছে। গোলাম আযমের ৯০ বছরের সাজা জামায়াতে ইসলামী মানতে রাজি নয়। শুধু তা-ই নয়, রায়ের প্রতিবাদে হরতালও ডেকেছে। গোলাম আযমের মুক্তি চায় ওরা। ওরা কি ভেবেছে রায়ের দিন হরতাল দিয়ে ফাঁসি মাফ পেয়েছে, তাই রায়ের পর হরতাল দিলে গোলাম আযমের মুক্তি আদায় করা যাবে! ওরা বোকার স্বর্গে বাস করছে।
হরতাল আহ্বান করেই জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা রাস্তায় নেমে পড়ে। নির্বিচারে গাড়ি পোড়ায়। পুলিশ দেখলে তেড়ে যায়। কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে। রেললাইন তুলে ফেলে।
রেলগাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সাধারণ নিরীহ পথচারীদের হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। ওদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গোলাম আযমের রায়ের দিন হরতালে সহিংসতা ও সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আহত অনেকে।
সোমবার হরতালের সময় সাতক্ষীরায় জামায়াত-শিবিরের লোকেরা আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করেছিলেন। আর পরদিন হরতালের শুরুতেই সকালবেলা সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের দুজন কর্মী নিহত হন। এখন আজ আবার হরতাল ডেকেছে জামায়াত-শিবির। জানি না, আজ রায়ের পর আবার ওরা হরতাল ডাকবে কি না। তাহলে এ সপ্তাহের প্রায় পুরোটাই হরতালের কবলে যাবে।
পবিত্র রমজান মাসে একের পর এক হরতাল ডেকে জামায়াতে ইসলামী প্রমাণ করল তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
এক সপ্তাহে পর পর তিন-চার দিন হরতাল ডাকতে পারে জামায়াতের মতো একটি দল? আদালতের পর্যবেক্ষণে যে দলকে ‘অপরাধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেই দলের এসব স্বেচ্ছাচারিতা কি মেনে নেওয়া যায়? জামায়াতে ইসলামী তো বিএনপির ১৮-দলীয় জোটে
আছে। কিন্তু তাদের এই নির্বিচার হরতালে বিএনপিও সমর্থন দেয়নি। তাহলে তাদের খুঁটির জোর কোথায়?
এখন বিএনপিকেও জামায়াতের ব্যাপারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের জোটে জামায়াতকে আর রাখা যাবে কি যাবে না।
জামায়াতের হরতালে সমর্থন না দিয়ে বিএনপি একটি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন জোট থেকে বাদ দিয়ে বিএনপি প্রমাণ করুক যে তারা কোনো ‘অপরাধী’ সংগঠনকে প্রশ্রয় দেবে না।
গোলাম আযমদের তো বিবেক বলে কিছু নেই। আমৃত্যু জেল খাটলেও তাঁদের কখনো মনে হবে না যে এর চেয়ে মরণই ভালো ছিল। এ
রকম ভাবার কোনো কারণ নেই।
এঁদের হূদয় পাষাণের মতো। সামান্য বিবেকবোধ থাকলে তাঁরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতেন না। গণহত্যায় নেতৃত্ব দিতেন না।
সুতরাং এই গোলাম আযমদের সংস্রব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। সামনে নির্বাচন।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হয়ে তাদের সামনে যে উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছে, তাকে আরও উজ্জ্বল করতে হলে এ ধরনের নীতিগত পদক্ষেপ দরকার। বিএনপির আশীর্বাদ না পেলে জামায়াতে ইসলামী দলটির হরতাল-স্বেচ্ছাচার চালানোর শক্তি থাকবে না। বিএনপিও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বোঝামুক্ত হবে। বিএনপির ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে।
এখনই সময়।
১৮-দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে নির্বাসনে দিন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।