আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শায়লা (একটি হরর গল্প)

এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি নেই বলে...সময় আমার কাটেনা.... প্রিয় সোনামণি আমার, আমি জানি না মা এই চিঠিটা তোমার কাছে কবে পৌছাবে...তোমার বয়স তখন কত...কি করছ তুমি,কোথায় পড়ছ...কিছুই জানি না...আমি ওদের বলেছি এই চিঠিটা তোমার দাদুমণির কাছে পৌছে দিতে...যখন তুমি বড় হবে...তখন পড়বে...তাহলে হয়ত তোমার মা,এই অভাগিনী মাকে ঘিরে থাকা সব প্রশ্নের কয়েকটার জবাব অন্তত পাবে...। আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাব মা...মনে আছে,তোমাকে ছোটবেলায় শোনাতাম? পার্থক্য এইযে এই গল্পটা সত্য...প্রতিটা বাক্য,প্রতিটা শব্দ সত্য... গল্পটা একটা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে,ঠিক তোমার মত|টুকটুকে লাল দু্টো গাল...দুটো বেণি করা পেছনে...নাম ছিল শায়লা। খুব মায়ের ভক্ত ছিল সে...সারাদিন মায়ের পেছন পেছন ঘুরতো,রাতে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। তেমনি এক রাতে কি কারণে যেন ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মেয়েটা পাশ ফিরে শুয়ে দেখে ওর মা আর শুয়ে নেই পাশে। ওদের বাসাটা ছিল ঠাকুরগাঁও এর পুরনো এক জমিদার বাড়ী,শায়লার নানুর বাড়ি।

নানু-নানী কেউ বেঁচে নেই,বাসায় থাকে কেবল শায়লা,শায়লার মা আর বাবা। দোতলা সেই বাড়ীর নিচতলা থেকে এক গোঙ্গানির শব্দ শুনে ঘুমজড়ানো চোখে মাকে ডাকতে ডাকতে নিচে নেমে আসে শায়লা। সিঁড়ির গোড়ায় এসে দেখা দৃশ্যটা তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওর মনে থাকবে। রান্নাঘরের পাশে ওর বাবা কেমন করে যেন শুয়ে আছে,তার মায়ের হাতে একটা ধারাল ছুরি...সেই ছুরি ধরা হাত ক্রমাগত ওর আব্বুর বুকে ওঠানামা করছে...শায়লা তখনো বুঝতে পারছিল না আসলে কি হচ্ছে...আব্বু কেন এমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে,আব্বুর বুকে লাল লাল ওগুলো কি...আম্মু চিৎকার করে কাঁদছেই বা কেন। "আম্মু..." ডাক শুনে চমকে ফিরে তাকালো ওর আম্মু...আম্মুর চোখ দুটোতে উদভ্রান্ত ভাব থেকে বিস্ময়,তারপর বেদনা আর সবশেষে অসহায় একটা ভাব ভর করল।

"শায়লা,মা আমার,তুই যা,তুই ঘরে যা মা,নইলে...নইলে...ও..." আম্মুর গলাটা ভেঙ্গে আসছিল কষ্টে। এই দিনটার কথা,এই শেষ কথাগুলো শায়লা পরবর্তি ২০ বছর হাজার হাজার বার নিজের মাথায় নেড়েচেড়ে দেখেছে। ওদিন ওর আম্মুর গলায় কি যেন ছিল , শায়লা ধরতে পারেনি,কিন্তু ওর মনে প্রচন্ড ভয় ঢুকে গিয়েছিল । সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে চলে আসে ও...খাটের তলায় গুঁটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল সারারাত। সারারাত কেঁদেছে,ফিসফিস করে ওর মাকে ডেকেছে...জোরে ডাকার সাহস পায়নি...ও জানত ও ডাকলে আম্মু যেখানেই থাকুক ছুটে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরত...ওর সব ভয় দূর করে দিত...কিন্তু তাই কি? ওর ভয়ের কারণ যে এখন অনেকটা ওর আম্মুই... ওই দিনের ওই ঘটনার ব্যাখ্যা অনেক সহজ ছিল সবার কাছে, দাম্পত্য কলহের জের ধরে ওর মা ওর বাবাকে খুন করেছে ।

ব্যাপারটা এতটাই সাধারণ। যা হবার তাই হয়েছিল। ওর মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। খুন করার ব্যাপারটা ওর মা অস্বীকার করেননি। আসলে কিছুই বলেন নি তিনি...স্তব্ধতা চেপে ধরেছিল তাকে,তিনি আর কোন কথা বলেন নি ফাঁসিতে ঝোলার আগ পর্যন্ত।

শায়লা আর কখনো দেখেনি তার মাকে ওই রাতের পর। ওর খালার বাসায় বড় হয়েছে,খালা চান নি স্বামীহন্তা কোন রমণীর "আছর" এই কোমলমতি শিশুর উপর পড়ুক। শৈশব খুব অসাধারণ একটা সময় বুঝলে মামণি? প্রকৃতি খুব সুন্দর করে আপন হাতে সব দুষ্ট স্মৃতিকে ধামাচাপা দিয়ে রাখে মস্তিস্কের গোপন কোন কোঠরে। তাই স্বাভাবিক এক মেয়ের মতই বেড়ে উঠল শায়লা। খালা বুদ্ধিমতি রমণী ছিলেন।

গ্রামে থাকতেন তিনি। গ্রামের অন্যান্যদের "আহা উহু ইশ" থেকে বাঁচার জন্য খালুকে তাগাদা দিয়ে ৩+১ মোট ৪ ছেলেমেয়ে সমেত শহরে চলে এলেন। তারপর গল্পটা চলো এগিয়ে নিয়ে যাই বিশ বছর...এর মাঝে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে,শায়লা বড় হয়েছে। পড়াশোনা শেষ করেছে। আরিফ নামে একটা অসাধারণ রাজপুত্রের মত এক ছেলের সাথে পরিচিত হয়েছে,লুকোচুরি করে প্রেম করেছে, পালিয়ে বিয়ে করেছে, খালার বাসায় কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়েছে,খালা মেনেও নিয়েছেন।

তারপর শায়লার ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে মেয়ে এসেছে...ওর নাম শায়লার সাথে মিলিয়ে রাখা হল নায়লা। হ্যা, তোমার নামে নাম। অদ্ভুত না? আরিফ ছিল সরকারী চাকরিজীবি । স্বল্প বেতনের চাকরি। ভালই চলে যাচ্ছিল।

বিপত্তি বাঁধল প্রমোশন পাবার পর। প্রমোশন পেয়ে আরিফ বদলি হল ঠাকুরগাঁও ... খালা প্রচন্ড বিরক্ত। তিনি কিছুতেই শায়লাকে ওই "শকুইন্যা" যায়গায় যেতে দেবেন না। টাঙ্গাইল থেকে সরাসরি বাসে উঠে একাই তিনি চলে এলেন শায়লাদের বাসায় ওদের আটকানোর জন্য। বিষম বিপদ।

বদলি আটকানো কি আর এত সোজা নাকি?হয় ঠাকুরগাঁও,নয়ত চাকরিই বাতিল। নয়ত আরিফের পুরো সপ্তাহ ঠাকুরগাওয়ে থাকা,সপ্তাহ শেষে ফিরে আসা। এটা তো আরো রিস্কি। তাছাড়া নায়লার স্কুলের বয়স হয়ে যাচ্ছে। ঠাকুরগায়ে তো অন্তত এই অজপাড়াগায়ের থেকে ভাল স্কুল কলেজ থাকবে।

শায়লা খালাকে আস্বস্ত করল, কোন সমস্যা নেই,তারা ভাল থাকবে। খালা আর কিছু বললেন না। দোয়া দরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। ঠাকুরগাঁয়ে কোয়ার্টারেই থাকার কথা শায়লাদের। কিন্তু বিপত্তি ওখানেও।

জানুয়ারী মাস। আগের কর্মকর্তার ছেলের এস এস সি পরীক্ষা আর ৩-৪ মাস পর। তিনি আরিফকে ধরে বসলেন এই কয়দিন "একটু ব্যাবস্থা করে নিতে"। এদিকে নায়লার স্কুল শুরু হয়ে যাবে এ মাসেই। অনেক ঘুরেও বাসা ভাড়া পাওয়া গেল না।

যেন হঠাৎ করেই ঠাকুরগায়ের সব বাসা ভাড়া হয়ে গেছে। হ্যা, যা ভাবছ তাই...অনিচ্ছা সত্তেও শায়লারা তাদের নানুবাড়িতে এসে উঠলো। রাজবাড়ীটা শহর থেকে খুব বেশী দূরে না। কিন্তু মফস্বল তো,একটু বেশীই নির্জন। আশে পাশে ঘরবাড়ী বলতে কিছু নেই তা কিন্তু নয়।

শায়লার কিন্তু বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়ে গেল। যে চাঁপা আতংক নিয়ে সে এখানে এসেছিল তা বাড়ির ভেতর এক পা দিতেই রীতিমত উধাও। ছোটবেলার অসাধারণ সব স্মৃতি ঘিরে ধরতে থাকে শায়লাকে। উঠোনের লিচু গাছের সাথে ঝোলানো দোলনাটা এখনো আছে। এখনো আছে সেই শান বাঁধানো পুকুর ঘাট যেখানে ওইটুকু বয়সেই সাঁতার শিখে গিয়েছিল শায়লা...ওর আম্মু...হঠাৎ থামিয়ে দিল চিন্তাটাকে ও।

বাড়ি দেখাশোনা করার লোক ছিল আগে থেকেই। পুরোনো বিশ্বস্ত পরিবার । নানুদের পুরনো লোক। পুকুরের মাছ আর পেছনের ক্ষেত চাষ করে উঠোনের এক কোণে চালাঘরে থাকে পরিবারটি। তাই বাড়িটা পরিষ্কার পরিচ্ছনই ছিল।

একটু আধটু মাকড়সার ঝুল আর ধুলো বালি এই যা। শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে কাজে লেগে গেল ও। নায়লার মজা আর দেখে কে। সরকারি কোয়ার্টার অনেক ঘুপচি হয়। শুধু নানুবাড়িতে (শায়লার খালার বাড়ি) গেলেই এত খোলা মাঠ পায় ও।

আর রাজবাড়ি দেখে তো ওর মনে হয় নিজেকে প্রিন্সেস মনে হচ্ছে। নিচতলায় অনেকটা জুড়েই বৈঠকখানা। দুপাশ দিয়ে দুটো সিড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিলিং এ টানা পাখা লাগানো আছে। যদিও পরবর্তীতে পাশে ইলেক্ট্রিক ফ্যান লাগানো হয়েছে, তবুও টানা পাখাটা আছে।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল শায়লা। ঊপরেই সবগুলো বেডরুম। বেশীরভাগই তালাবদ্ধ। চাচাকে ডেকে আগেই চাবি নিয়ে রেখেছিল ও। মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে যেন।

এতগুলো বছর ধরে এতগুলো প্রশ্ন শায়লার মনের ভেতর, যেগুলোকে সে কখনও আমল দেয় নি,সেগুলো আজ বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে। বাবা মায়ের আর ওর শোবার ঘরে ঢুকল শায়লা। সবকিছু আগের মতই মনে হচ্ছে...নাহ অনেক পরিবর্তন। দেয়ালে মায়ের হাতে কাজ করা চুমকি দিয়ে বানানো ওয়ালম্যাট টা নেই। আব্বু র আম্মুর স্টুডিওতে গিয়ে তোলা ছবিটাও বোধহয় ছিল এই দেয়ালে,নাকি ওইটায়?মনে নেই আর শায়লার।

আগেকার দিনের খাট। অনেক উচু। খাটের পাশে রেলিং দেয়া। সিঁড়ি পর্যন্ত আছে। "আম্মু...খাবো..." চমকে বাস্তবে ফিরে এল শায়লা।

তাড়াতাড়ি নিচে গেল। কিছু একটা খাবার ব্যাবস্থা করতে হবে। একটা নতুন জিনিস দেখল শায়লা সিড়ি দিয়ে নামার সময় । দুইপাশে দুই সিড়ির মাঝখানে, নিচতলায়, বৈঠকখানার পেছনের দেয়ালে একটা জলরঙ্গে আঁকা ছবি। অসাধারণ হাতের কাজ।

একটা মহিলার ছবি। নববধুর সাজে, মাথাটা নিচের দিকে কিঞ্চিত ঝুকানো,যেন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। ছবিটা দেখে শায়লার মনটা ভাল হয়ে গেল। দিন কাটতে লাগল। আরিফ সারাদিন বাইরেই থাকে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নায়লার টিফিন বানিয়ে ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে (সারাদিনের এ কাজটা সবচেয়ে কঠিন!!), রেডি করে স্কুলে দিয়ে আসা,টুকটাক কাজ করে আবার ওকে নিয়ে আসা,তারপর আবার নায়লাকে গোছল করিয়ে খাইয়ে দাইয়ে আবার ঘুম পাড়ানো (ফাঁকে নিজেরো একটু ঘুমিয়ে নেয়া),বিকালে উঠে নায়লার সাথে বাইরে খেলা,সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে পড়তে বসা, রাতে আরিফ আসতো,একসাথে খাওয়া...এইত,নায়লাকে নিয়েই পুরো দিনটা এভাবেই কেটে যায়... ব্যাপারটা তখন শুরু হল। তারিখটা ঠিক মনে নেই। কোন এক পূর্ণিমা রাতের কথা। পূর্ণিমা,কারণ সেদিন ঠাকুরগাও শহরে বিদ্যুৎ ছিল না। অথচ ঘর ভর্তি আলো।

শায়লা... আহ, আর লুকিয়ে লাভ কি। তুমি তো নিশ্চয়ই এতক্ষনে বুঝতেই পেরেছ আমিই শায়লা। আর তুমিই এই গপের নায়লা?তোমার মনে আছে আম্মু সেই বাসাটার কথা?...ওই যে সেই ছবিটার কথা? যাই হোক কাহিনীতে ফিরে আসি। আমি সেদিন তোমাদের জন্য রান্নাবান্না শেষ করে রান্নাঘর থেকে মোমটা নিয়ে বের হয়ে ছবিটার সামনের টেবিলে মোমটা রাখতে গিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ছবির মেয়েটা আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে...মোম মাটিতে পড়ে নিভে গেল।

আমি নড়তে পারছিলাম না। তুমি তখন উপরে, হোমওয়ার্ক করছিলে। ধীরে ধীরে মোমটা তুলে নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে গিয়ে মোমটা জ্বালালাম। সাহস পাচ্ছিলাম না। ব্যাপারটা চোখের ভুল ছিল কি না সেটা যাচাই করার মত সাহস তখন আমার ছিল না।

চোখের ভুল না হলে? যাই হোক উপরে গেলাম। বিদ্যুৎ আসলো আরিফ আসারও অনেক পরে ... যখন চাঁদের আলোটাই আমাদের জন্য ভাল ছিল। সকালে উঠে ছবিটা দেখে হাসি পেল। সবই আগের মত... সেদিনই রাতের কথা। এবার বিদ্যুৎ ছিল।

ছবিটার লোকেশন এমন যায়গায় যে সিড়ি থেকে উপরে উঠতে গেলেই ওটা চোখে পড়ত। উপরে ওঠার সময়ই দেখলাম এবার। এবার ভয়ংকর কিছুনা। এবার নববধু সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা নেই।

আমি এবার আর পালালাম না। সিড়িতেই দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ স্পষ্ট দেখলাম বধু মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। মুখ দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল আমার। কিন্তু পলক ফেলতেই ঘোমটা নতমুখসমেত সেই আগের নববধূ।

আরিফকে কিছুই বললাম না। পরদিন সকালে চাচা কে ডাকলাম। ছবিটা দেখালাম। তিনি চিনতে পারলেন না। তিনি বললেন ওটা নাকি অনেকদিন ধরেই এখানে ঝোলানো।

কেউ কখনো সরায় নি। আমি আকার ইঙ্গিতে জানার চেষ্টা করলাম এ নিয়ে কোনপ্রকার কিংবদন্তী আছে নাকি। কিন্তু তেমন কিছুই পেলাম না। এরপর কিছুদিন শান্তিতে গেল। বড়জোড় এক সপ্তাহ।

এখন কেন জানি ছবিটার উপর একটা কৌতুহল তৈরী হয়েছে...অবচেতন মনেই চোখ চলে যায় ছবিটার কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা দেখার জন্য। সবুরে মেওয়া ফলল। ছবির মেয়েটা হঠাৎ একদিন উধাও। সবই আছে,ছবির ফ্রেম, জলরং। কিন্তু এখন ওটা শুধুই ফাঁকা এক জলরঙ্গের ছবি।

Abstract মনে হতে পারে। এবার কিন্তু আর পলক ফেললে মেয়েটা ফিরে এলনা। মেয়েটা উধাও হয়েই রইল। একদিন,দুদিন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটা যে নেই এটা কেন যেন কেউ লক্ষ্যই করল না।

দুদিন পরও যখন মেয়েটা ফিরে এলনা, কেউ খেয়ালো করল না মেয়েটা নেই,তখন আরিফকে বললাম ছবিটার কথা। আরিফ তো হেসেই উড়িয়ে দিল। ওকে নিয়ে নিচে গেলাম। মেয়েটা ফিরে এসেছে। কেন যেন একটা স্বস্তির পরশ বয়ে গেল শরীর দিয়ে।

এর পর ছবিটাকে প্রায়ই নড়াচড়া করতে দেখতাম। ঠিক নড়াচড়া নয়,নানা রকম অবস্থানে। ও মনে হয় আমার উপস্থিতিতে অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছিল। অন্য কাউকে দেখাতে গেলে আগের মত হয়ে যেত। আমার সামনেই অন্যরকম ।

কতটা সহজ হয়ে গিয়েছিল তা টের পেয়েছিলাম আর কিছুদিন পর। সেদিন কি যেন কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ চোখের কোণে নড়াচড়া দেখে তাকালাম, দেখি মেয়েটা নড়ছে। নড়ছে মানে নড়ছে। নববধূ র গহনাগুলো খুলে খুলে রাখছে...। আমি তাকিয়ে আছি খেয়াল করে হাসল।

মেয়েটার হাসি অনেক সুন্দর ছিল। দাঁত অসমান ছিল মেয়েটার, হাসির ঔজ্জ্বল্য আরো বেড়ে গিয়েছিল তাতে। এরপর আমার যেন কী হয়েছিল। আমি যখনি সময় পেতাম ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মেয়েটা হাসত।

ঠোট নাড়ত, কথা বলার চেষ্টা করত বোধহয়,কিছুই শোনা যেত না। মাঝে মাঝে বিয়ের শাড়ির বদলে আটপৌড়ে শাড়ি পরেও আসত। আমার অনেক প্রশ্ন ছিল। ও কে। কেন এখানে সে।

কিভাবে সে নড়াচড়া করে ইত্যাদি । কিন্তু ও কিছু শুনতে পেত না। আমি যেমন কিছু পাই না। ব্যাপারটার অস্বাভাবিকত্ব আমার চোখে তখন ধরা পড়ছিল না। আরিফ প্রথম খেয়াল করল যেদিন,সেদিন আমি নায়লাকে,মানে তোমাকে স্কুল থেকে আনতে ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি তোমাকে স্কুলে ঢুকিয়ে বাসায় এসে সেই যে দাড়িয়েছি ছবির সামনে, আমার হুশ ফিরল আরিফের ঝাঁকুনিতে। আমার মাথা তখনো কেমন যেন লাগছিল। আরিফের কথা মাথায় ঢুকছিল না। চাচামিয়া কয়েকদিন ধরেই ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলেন, তিনি সুযোগমত লাগিয়ে দিলেন। আরিফ আরো ক্ষেপে গেল।

আমি কিছুই শুনছিলাম না,শুধু হঠাৎ যখন শুনলাম "আমি ওটা পুড়িয়ে দেব"...তখন মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। আমি নাকি "না না" করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। এরপরের একদিনের ঘটনা আমার আবছা আবছা মনে আছে । আরিফ বাকিটুকু বলেছিল আমাকে। আমাকে বিছানায় শুইয়ে আরিফ চাচামিয়া কে পাঠিয়েছিল ডাক্তারের কাছে...তারপর ও গিয়ে ছবিটা পুড়িয়ে দিয়েছিল... ঘটনা এখানেই শেষ হবার কথা ছিল।

পরদিন আরিফ অফিসে যাওয়ার আগে তোমাকে স্কুলে দিয়ে গেল। অফিসে গিয়ে সে খালা কে ফোন করেছিল। খালাকে সে পুরোপুরি কিছু না বলে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল ছবিটার কথা... খালার বয়স হয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে আঞ্চলিক ভাষায় অনেক কথা বললেন যার সারমর্ম এই,এই ছবিটা অনেকদিন ধরেই ও বাড়িতে ছিল। তার বাবারো জন্মের আগে।

কিন্তু শায়লার বাবা তো ওটা পুড়িয়ে দিয়েছিল, ওটা ওখানে থাকার কথা না... আরিফ দৌড়ে বাসায় আসে...আমার এ সময়টায় আবছা মনে আছে, আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি কেন যেন আবার ওই ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই,হ্যা,ছবিটা যথাস্থানেই ছিল...আমি ওকে দেখতে পাই...ও আমাকে দেখে নড়েচড়ে ওঠে,হেসে ওঠে,যেন বহুদিনের পুরনো সখী ফিরে এসেছে...এবার আমি ওর হাসির শব্দ শুনতে পাই...কি প্রাণোচ্ছল সে হাসি!!!...আমিও হেসে ওঠি...খিল খিল করে...ও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়...এই প্রথমবার...এই প্রথমবার ওর হাত ফ্রেমের বাইরে আসে...আমিও হাত বাড়াই...এত আনন্দ...এত আনন্দ তখন আমার মনে...!!!...ওকে ছুঁয়ে দিলাম...কেমন যেন ভেজা ভেজা...পুরো হাতটা ধরলাম...ভেজা হাতটা ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে আসছে...আমি হাত ধরে টান দিলাম...ও বেরিয়ে এল ফ্রেমের বাইরে, পুরোপুরি বাইরে...ওর পুরো শরীর জলরঙ্গের...আস্তে আস্তে ও শুকিয়ে রক্ত মাংসের মানুষে পরিণত হচ্ছে...ওকে দেখতে আমারই মতন লাগছে যেন... এবার আমি জ্ঞান হারাই নি...আরিফের আসার শব্দ শুনে ও আমাকে চোখ টিপ দিয়ে আবার ফ্রেমের ভেতর ঢুকে যায়...আরিফ আসে...আরিফ একনজর ছবিটা দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে... আমাকে বলে..."এখানে আর এক মুহূর্তও না"... আমার মনের ভেতর হাহাকার করে ওঠে...মন হাঁচড়ে পাঁচড়ে অজুহাত খুজতে থাকে... আমি যাব না...কিছুতেই না..."আজ রাতটা...শুধু আজ রাতটা..." মনের ভেতর কে যেন বলে ওঠে... "আজ রাতটা থেকে যাই...খুব দুর্বল লাগছে..." আরিফ আমার ক্লান্ত রোগতপ্ত চেহারা দেখে রাজী হয়ে যায়... সেদিন রাত...নিচে কে যেন বিড়বিড় করে গান গাইছে...আর আমার নাম ধরে ডাকছে..."শায়য়য়য়লা...শায়য়য়লা..." আমার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে...আমি ঊঠে বসি বিছানায়...সারাদিনের টেনশনে আরিফ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন...নায়লাও ঘুমাচ্ছিল আমার পাশে... পা টিপে টিপে বাইরে বেরোই...নিচে নামি...ছবির সামনে গিয়ে দেখি ছবি ফাঁকা...খুব আনন্দ লাগে...তাহলে ও এখন আমাকে ছাড়াই বেরুতে পারে... রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও...আলো আঁধারিতে কেমন যেন পরিচিত লাগছে মুখটা...কিন্তু... এ ত... আমার মুখ... আমার মনে এই প্রথম অশুভ ছায়া উঁকি দেয়... হাত দুটো ওর পেছনে...ওর পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপে নূপুরের শব্দ হচ্ছে...কেন যেন ওর হাসি...নুপুরের শব্দ আগের মত অত মধুর লাগছে না... উপরে পায়ের শব্দ...আরিফের ঘুম ভেঙ্গেছে...আমাকে বিছানায় না পেয়ে আরিফ নিচে নেমে আসছে.. ও এখনো হাসছে...ওর হাত পেছন থেকে সামনে এল হঠাৎ...ওর হাতে কি ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না...একপাশের সিড়ি দিয়ে আরিফ নামছে,আমি ছবির ফ্রেমের সামনে আর ও আরেকপাশের সিড়ির সামনে...ও এগিয়ে আসতে থাকে...ওর হাতে ধরা জিনিসটা উপরে উঠতে থাকে আস্তে আস্তে... আমার চোখে পড়ে জিনিসটা...সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকের মত সব বুঝে যাই আমি...সবকিছু...অতিত,বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব একাকার হয়ে যায় চোখে্র সামনে...সব... কিন্তু আমার কিছু করার নেই...আমি বর্তমানের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছি...আমার মুক্তি নেই...২০ বছর আগে দেখা ঘটনাপ্রবাহ আবারো ঘটতে থাকে...আমি এগিয়ে যাই ওকে আটকাতে...আমি আরিফকে মরতে দিতে পারি না...আমি জানি বাঁচাতে পারবো না...কিন্তু চেষ্টা তো আমাকে করতেই হবে...আরিফ তাকিয়ে আছে...আমি চেপে ধরেছি "ও"র ছুরিটা ...জানি আরিফ "ও"কে দেখতে পারছে না...ও দেখছে আমার হাতে ছুরিটা ধরা...কিন্তু আমি থামাতে চাইছি ওকে...ওর গায়ে অমানুষিক শক্তি...ওর ছুরি ধরা হাত এখন মাথার ওপর...আমার হাতও ওটার উপর...আরিফ বিষ্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়া আছে...ওকে আঘাত করার আগ মুহূর্তে ও আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে..."কেন?" আমার মুখ থেকে আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসে আর ওর মুখ থেকে অট্টহাসি... অবশেষ তখন বুঝতে পারলাম ওইদিন আমার ঘুম ভেঙ্গেছিল কিসের শব্দে... আমার আর ওর ছুরি ধরা হাত ছোবল মারে আরিফের বুকে...আরিফ পড়ে যায়...আমি পারলাম না প্রথম আঘাতটা ঠেকাতে...দ্বিতীয়টাও না...না তৃতীয়টা... "আম্মু..." বাকিটুকু তো তোমার মনেই আছে,তাইনা নায়লা? নায়লা...আমি আর তোমার বাবা তোমাকে আমাদের জীবন থেকেও বেশী ভালবাসি, ভালবেসে যাব...আমি তোমার বাবাকে খুন করিনি...এটা তুমি জান...আমার মত আজীবন এই কষ্টটা তোমাকে বয়ে বেড়াতে হবে না আর...এটাই তোমার জন্য আমার বিদায়ী উপহার... তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ মা...তুমি ওই ছবির ধারে কাছেও যেও না .....পারলে বাড়িটা পুড়িয়ে ফেলো... অতীত,আর বর্তমান তো ধ্বংস হয়েছে...ভবিষ্যৎ যেন নিরাপদ থাকে...এই কামনায় ইতি তোমার মা শায়লা ------------------------ নায়লার দাদীর রেখে যাওয়া চিঠি টা আজই জেলখানায় নায়লার হাতে পৌছেছে... নায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে..."বড় দেরী করে ফেললে মা..." "অসুবিধা নেই মা...আমার কাছে সারাজীবন আছে..."...জেলখানার গার্ডের কাছে খাতা কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে নায়লা... এখন আর বাংলাদেশ সরকার ফাঁসির দন্ডাদেশ দেয় না... (পালিয়ে বিয়ে করায় শায়লার প্রতি আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল আরিফের পরিবারের , শায়লা আরিফের খুনিও বটে...তাই শায়লার ফাঁসি হবার আগে লেখা এই চিঠি কখনোই নায়লার হাতে পৌছেনি...দাদী মারা যাবার পর সেটা ওর এক চাচা ওর কাছে পাঠায়) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।