এক.
দু’দিন ধরে রনির বানরটা বেশ দৌরাত্ত শুরু করেছে! সকাল-বিকাল তাকে ঘরে খুঁজেই পাওয়া যায় না। সারাদিন শুধু এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। আর লোকদের জিনিস চুরি করে এনে আপন খেলায় মাতে। কারও গাছে ফল দেখলে তার যেন আর সয্য হয় না। ফল খাওয়ার লোভে সারাক্ষণ সে গাছের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।
সুয়োগ পেলেই গাছে চড়ে বসে। কাচা-পাকা সামনে যা পায় সব ফল পেড়ে কিছু এদিক-ওদিক ছুঁড়ে মাড়ে আর কিছু বাড়ি এনে মজা করে খায়। তার জন্য রনিদের অনেক গাল-মন্দ শুনতে হয়।
রনি বাড়িতে না থাকলে বানরটা এ সুয়োগ পেয়ে যায়। তাকে ভয় না পেলে ও ভক্তি করে।
তার কথার কখনো অবাধ্য হয় না। রনি বাড়িতে থাকলে বানরটা তার পিছনে অনুগত ভৃত্যের মত ঘুরে বেড়ায়। রনি যে কাজ করতে বলে যতটুকু করার সাধ্য চেষ্টা করে।
বানরটা মাঝে মাঝে অন্যের গাছের ফল চুরি করে রনির টেবিলে এনে রেখে দেয়। রনি এসে দেখলেই বুঝে এটা কার কান্ড।
সে বানরটাকে কড়া কথা বললে ওটা যেন আরো বেশি মজা পায়। আনন্দে গদ গদ করে তার কাঁধে গিয়ে বসে। সে যদি বানরটার গালে দুটো থাপ্পরও দেয় সে মনে করে তাকে যেন ধরে আদর করা হচ্ছে। তাই রনি মাঝে মাঝে এসব নিয়ে বানরটার উপর খুবই ক্ষেপে যায়। বানরটাকে সে বেশি ভালবাসে বলে তার রাগ মুহূর্তেই দমে যায়।
মাঝে মাঝে বানরটা অদ্ভূত সব কান্ড ঘটিয়ে বসে। এইতো সেদিন বানরটা রনির প্যান্ট, শার্ট আর তার দাদুর মোটা প্রেমের চশমাটা পড়ে এমন ঢং সেজেছিল ওকে সেদিন যে-ই দেখেছে না হেসে পারেনি। দেখে যেন মনে হয়েছে ছোট কোন ছেলে হয়ত বানরের অভিনয় করছে। ওর দাদু তার চশমা চুরি করাতে বানরটার উপর ভীষন ক্ষেপে গিয়েছিল। লাঠি দিয়ে মারার জন্য অনেকবার তেরে ও গিয়েছিল।
কিন্তু বানরটা এমনি পাজি যে তার দাদুর লাঠি নিয়ে দে ছুট। দাদু ও ছুটল বানরটার পিছনে। দুজনের মধ্যে দৌড় খেলার মতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বানরটা বুদ্ধি করে গাছে ওঠে পড়ে। তার দাদু ও কম কিসে! তিনি ও উঠতে গেলেন গাছে।
গাছটা ছিল খুবই চিকন আর এর ডালগুলো ছিল খুব নরম। বানরটা স্বাচ্ছন্দে উঠতে পারলে ও, দাদু উঠতে গিয়ে পড়ল বিপাকে। হঠাৎ গাছের নরম ডালগুলো মড়াৎ করে ভেঙ্গে দাদু চিৎপটাং হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর তখন বানরটা আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। এদিকে দাদুর মাটিতে পড়ে কোমর যায় যায় অবস্থা! এরপর টানা তিন দিন দাদুকে একটানা শোয়ায় থাকতে হয়েছে।
সেদিন থেকে বানরটা দাদুর দু’চোখের বালি হয়ে যায়।
দুই.
রনি তার বানরটার দুষ্টুমি ব›ধ করতে তাকে স্কুলে নিয়ে যায়। স্কুলের সামনের গাছটায় তাকে বসিয়ে রনি ক্লাসে চলে যায়। স্কুলের অন্যান্য ছেলেরা বানরটাকে দেখলে তার পাশে এসে ভিড় জমায়। বানরটাও তাদের সাথে দুষ্টুমি করা শুরু করে দেয়।
হয়ত কারও কলম নিয়ে বিড়ি খাওয়ার অভিনয় করে কিংবা কারো প্যান্ট ধরে ঝুলে থাকে। আর তা দেখে অন্যান্য ছেলেরা সশব্দে হেসে উঠে। কেউ কেউ আবার ফাজলামো করে চকলেটের খোসায় মাটি ভরে বানরটাকে খেতে দেয়। বানরটা চকলেট পাগল তাই দেওয়ার সাথে মুখে পুরে দেয়। আর যখন দেখে এ অবস্থা তখন থুথু করে সব ফেলে দেয়।
আর যে এই কান্ড করেছে তাকে পিছু তাড়া করে।
যদি তার হদিশ না পায় তখন টিচারদের কাছে গিয়ে নালিশ করে। কথা তো বলতে পারে না, তাই টিচারদের জামা ধরে টেনে নিয়ে আসে। আর যে ছেলে এ কান্ড করেছে তাকে দেখিয়ে দেয়। টিচাররাও অনেক দিন বানরটাকে দেখতে দেখতে তার কিছু কথা বুঝে গেছে।
আর তখন তারা বানরটাকে দেখানোর জন্য হালকা পিটুনি লাগায়। এ দৃশ্য দেখে সে আনন্দে হাততালি দিতে থাকে।
অনেক সময় সে রনির কথাও অমান্য করে। রনি তাকে গাছে উঠে বসে থাকতে বলে কিন্তু একদিন তার আদেশ অমান্য করে বানরটা ক্লাসে এসে বসে থাকে। সবার পিছনের বেঞ্চে এমন ভাব নিয়ে বসে ছিল যেন মনে হচ্ছে কি মনোযোগ দিয়েইনা পড়া শুনছে! কেউ তখন ও লক্ষ্য করেনি বানরটা যে ক্লাসে।
ক্লাসে ঢুকলেও সে কোন হই-চই কিংবা ডাকাডাকি করল না। শান্ত ছেলের মত বসে থাকল আর চোখটা ব্লাকবোর্ডের দিকে। প্রথমে বিষয়টা মাষ্টার মশাইয়ের চোখেই ধরা পড়ল। মাষ্টারমশাই তাকানোতে অন্যান্য ছেলেরাও সেদিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। রনিও তখন ক্লাসে বসা ছিল।
এ অবস্থা দেখে তার রাগ চরমে উঠে। কিন্তু সে মাষ্টার মশাইয়ের সামনে অতটা রাগ দেখাতে পারল না।
বানরটাকে গাছে বসিয়ে দিয়ে আসার জন্য সে তাকে ধরতে গেল কিন্তু মাষ্টার মশাই মানা করলেন। তিনি বললেন, থাক না বসে, ও তো আর ক্লাসের কোন অসুবিধা করছে না। তিনি হঠাৎ কথা কাটিয়ে বললেন, বানরটা তোমাদের থেকে আরো ভাল, দেখ না কি মনোযোগ দিয়েই না কথা শুনছে! আর তোমরা তো কথা বলেই যাও ক্লাসে কোন মনোযোগই দিতে চাও না।
কি! ঠিক বলিনি?
এ সময় রনি উচ্চস্বরে বলে উঠে, জ্বি স্যার!
আর অন্য ছেলেরা তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে। মাষ্টার মশাই বানরটার প্রশংসা করাতে রনির বানরটার প্রতি ভালবাসা যেন আরো বেশি বেড়ে যায়।
এত দিন কেউই জানত না যে বিদ্যুৎ স্যারের মাথায় টাক ছিল। কিন্তু সেদিন তার বানরটার কারণে এ কথা ফাঁস হয়ে যায়। স্যার তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন স্কুলের সামনের কড়–ই গাছটার নিচে।
আর বানরটা ছিল গাছে। হঠাৎ বানরটা কি না কি ভেবে স্যারের ঘাড়ে গিয়ে বসল। স্যার বানরটাকে ঘাড় থেকে ফেলে দিতে চাইলেন। কিন্তুু প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। পরে বানরটা নিজেই সরে গেল।
তবে যাওয়ার সময় স্যারের নকল চুলগুলো টান দিয়ে নিয়ে গাছে উঠে যায়। স্যার তো পরচুলা হারিয়ে সবার সামনে পুরো বেকুব বনে গেলেন! বানরটাকে অনেক কিছুর লোভ দেখিয়েও তা আর উদ্ধার করতে পারলেন না।
আর সেদিন স্যারের এ বিষয়টা ছিল স্কুলের প্রধান আলোচ্য বিষয়। ছাত্ররা স্যারকে দেখলেই মুচকি হাসা শুরু করল। স্যার বানরটার উপর সেদিন এতই রেগে যান যে, বানরটাকে তিনি স্কুলে না আনার জন্য বারণ করে দেন।
রনির বানরটার কারণে স্কুলের ছাত্ররা অনেকবার স্যারদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এর জন্য অবশ্য অন্যরা বাঁচলেও রনির ঠিকই মার খেতে হতো। কারণ তার বানরটা টিচারদেও বেত চুরি করে নিয়ে যেত। ফলে স্যাররাও আর মারার সময় বেত পেতেন না। তারা ভেবেই নিত যে এটা ঐ বানরটার কাজ।
এতে দোষ এসে পড়ত রনির উপর। আর তখন রনির ভোগ করতে হতো পুরু শাস্তিটুকু। বানর পালার কারণে তাকে নিয়ে স্কুলের ছেলেরা অনেক কথা বলত। স্কুলে সবাই তাকে ‘বানর পালা রনি ’ বলে ডাকত।
তিন
প্রায় তিন মাস হলো রনি এই বানরটাকে পালছে।
অথচ তার একটা নামও এখনো দেয়া হয়নি। দেয়া হয়নি বললে ভুল হবে কারণ সে মনের মত একটা নাম এখনো খুঁজে পায়নি। একেক জন একেক নাম দিতে বলে কিন্তু কারোটাই তার তেমন পছন্দ হয়নি। তিনমাস চিন্তা করেও সে একটা ভাল নাম খুঁজে পায়নি। এ কথা শুনে অনেকেই হাসে।
রনি অবশ্য কে কি বলে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না! সে শুধু নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, অন্যে কি বলে তা যেন শুনতে ও চায় না। শেষে অনেক চেষ্টা করে মাথা ঘামিয়ে রনি তার নাম ও তার প্রিয় খেলোয়ার রিকি-পন্টিয়ের নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে বানরটার নাম দেয় ‘ররি’। এ নাম শুনে অনেকেই তাকে টিট্কারি করে। রনি ওসব কানে ও তোলে না। সে বলে, আমার বানর আমি যা ইচ্ছা তাই নাম দেব তাতে তোদের কি? মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বানরটা বুঝে গেল যে তার নাম ররি।
ররি বলে ডাকলেই সে ছুটে আসে। তার নিজের একটা নাম থাকাতে বানরটাও যেন খুশিতে গদগদ!
একদিন রনি স্কুল থেকে এসে দেখে টেবিলের উপর তার বই খাতাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। ঘরের কোনায় চোখ যেতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। ররি (বানরটা) তার নতুন কেনা বইগুলোর উপর কলম দিয়ে কি যেন আঁকিবুকি করছে। তাকে দেখেও বানরটার মধ্যে কোন ভয়ের চিন্থ দেখা গেল না।
তার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসির ভান করে ররি আবার নিজ কাজে মন দিল। রনি টান দিয়ে বানরটার কাছ থেকে তার বইগুলো কেড়ে নিল। আর বানরটাও তখন কিচ্ কিচ্ আওয়াজ শুরু করে দিল।
রনি জোরালো কন্ঠে বলল, চুপ কর। ওর কথা শোনার সাথে সাথে ররি চুপ হয়ে যায়।
সে আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রনি বইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগে তার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে যায়। ররি তার বইগুলো সব ছিঁড়ে, নানা রকম আঁকিবুকি করে একদম পড়ার অযোগ্য করে তুলেছে। রনি এ কথাটা তার বাবা-মাকে কিছুদিন জানাল না। কারণ তারা জানলে হয়ত বানরটাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারে! তবে সে দিন থেকে রনি বানরটা তথা ররিকে শিকল দিয়ে আটকে রাখত।
কারণ কথাই আছে, ‘আদর দিয়ে পুষলে বানর মাথায় উইঠা নাচে। ’
চার.
এতক্ষণ তো ররি সম্পর্কে অনেক কথাই হলো। কিন্তু বানরটা রনির কাছে এলো কিভাবে তা এখন ও তোমাদের বলা হলো না। তাহলে শোন সেই গল্পÑ
রনিদের গ্রামের নাম শালচর। গ্রামের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের স্কুলের নাম করা হয়েছে।
এটা অবশ্য সব জায়গায় করা হয়। মানুষও নামের অভাবে ভোগে! তাই একটা দিয়ে আরেকটার নাম রাখে! একবার রনিদের স্কুলের পক্ষ থেকে একটা বনভোজনের আয়োজন করা হলো। এতে ছাত্র-শিক্ষক প্রায় অনেকেই অংশগ্রহন করল। রনিও বাদ গেল না। সে ও যোগ দিল সবার সাথে।
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম যাবে পিকনিক করতে। এত দূরে যাবে শুনে অনেক বাবা-মাই তাদের সন্তানদের যেতে দিল না। রনির বাবাও বাধ সাধল। কিন্তু সে ছিল নাছোর বান্দা। তার এক কথা সে বনভোজনে যাবে যাবেই।
অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ও তাকে আর দমানো গেল না। তার বাবা আর কি করবে, শেষ পর্যন্ত তাকে যেতে দিতে বাধ্য হলেন।
তাদের বাসটা চলতে লাগল চট্টগ্রামের প্রানে। সবকিছু আগে থেকেই গুছিয়ে নেয়া হয়েছে। পিকনিকটা বেশ আনন্দের হবে বলে মনে হলো।
বাসের মধ্যে গানের আয়োজন করা হলো। একে একে সবাই গান গাইল। রনিও বাদ গেল না। টিচাররা অনেকে গিটার বাজিয়ে গান গাইলেন।
রনির কাছে আজকের দিনটা অন্য দিনের চেয়ে খুব ভাল লাগছে।
সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করতে লাগল। মাঠ জুড়ে অবারিত হলুদ শর্ষেফুল তার চোখে ধাঁধাঁ ধরিয়ে দেয়। মনে হয় যেন, প্রকৃতি হলুদের চাদর বিছিয়ে রেখেছে। নদীর ধারে ফুটে আছে কত জানা আর কত অজানা ফুল। গাঙের সামান্য পানিতে সাদা বক কি যেন খুঁজে বেরোচ্ছে।
মাঝে মাঝে রাস্তার দু’পাশে গাছ-পালার ঘন ঝোপ জঙ্গল চোখে পড়ছে। সবাই দৃশ্যগুলো বেশ আনন্দের সাথে দেখছে। তবে জানালার কাছে যারা বসেছে তাদের সুবিধা হলো বেশি। আর যারা তাদের পাশে বসেছে তাদের মন্দ ভাগ্যই বলতে হয়। কারণ তারা বাইরের প্রকৃতি কোন কিছুই ঠিক মত দেখতে পাচ্ছে না।
রনির পাশে বসেছিল স্কুলের ‘মিছকি শয়তান’ নামে খ্যাত তন্ময়। তন্ময়ের মত এমন পাজি ছেলে আর একটাও খঁজে পাওয়া যাবে না তাদের স্কুলে। তবে ওর চালাকি খুব সহজে ধরা যায় না। রনিকেও সে খুব জ্বালাতে লাগল। এক সময় দ’ুজনের মধ্যে দ্বন্দ বেধে যায়।
তন্ময় জানালার কাছে বসার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। কিন্তু রনি কিছুতেই দেবে না। এক পর্যায়ে দ’ুজনের মধ্যে মারামারি বেধে যায়। মারামারির এক পর্যায়ে হঠাৎ তন্ময় গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে পড়ে যায়। বাসটা আস্তে চলছিল তাই সে বেশি ব্যথা পেল না।
তবে ডান হাতটা সামান্য মস্কে গিয়েছে বলে মনে হলো। সাথে সাথে টিচাররা তার প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করে দেয়। তবে এর জন্য পুরো দোষ রনির উপর এসে পড়ে। যদিও সে এর জন্য মোটে ও দায়ী ছিল না। তাই তার আর তন্ময়ের জন্য আজকের পিকনিকটা প্রায় মাটি হয়ে গেল।
প্রায় দেড়ঘন্টা পর তারা তাদের গন্তব্য স্থানে এসে পৌঁছে যায়। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো রনি ভুলে যেতে চায় কিন্তু সে পারে না। টিচারদের রাগী রাগী মুখগুলো তার চোখে বার বার ভেসে উঠে। অন্যান্য ছেলেরা কি আনন্দনাই করছে কিন্তু রনি চুপ। রনি একা হেটে বেড়ায়।
তাছাড়া তার সাথে কেউ কথাও বলছে না। মাঝে মাঝে দুই-একটা ছেলে তাকে টিট্কারি দিচ্ছে। ঐ দিকে সে ফিরেও তাকায় না। আজকের দিনটা রনি ভেবেছিল বেশ আনন্দে কাটবে কিন্তু তা আর হলো না। তন্ময়ের এক হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
মোটামুটিভাবে তাদের পিকনিকটা শেষ হয়ে গেল। সন্ধ্যার আগেই তারা সবকিছু রেডি করে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সকাল ছয়টা কি সাতটার দিকে তারা বাড়িতে এসে পৌঁছে যায়।
হঠাৎ একটা ছেলে দেখতে পায় গাড়ির ছাদে একটা বানর বসে আছে। সে খবরটা সবাইকে জানিয়ে দেয়।
তাদেও গ্রামে কোন বানর ছিল না,তাই তারা ভেবেই নিল এটা নিশ্চয় সেখান থেকে এসেছে যেখানে তারা পিকনিক করতে গিয়েছিল। এখন বানরটাকে কী করবে তাই নিয়ে সবার ভিতর প্রশ্ন দেখা দিল। কেউ কেউ বলল,বানরটাকে অন্য গ্রামে ছেড়ে দিয়ে আসতে,নইলে বানরের অত্যাচারে থাকা যাবে না। আবার কেউ কেউ বলল, বানরটাকে যেখান থেকে আনা হয়েছে সেখানে দিয়ে আসতে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল, কে নিয়ে দিয়ে আসবে? বানরটা গাড়ির ছাদ থেকে নেমে রনির কাঁধে এসে বসে।
রনি প্রথমে কিছুটা ভয় পায় কিন্তু পরে তার ভয় কেটে যায়। বানরটার গায়ে সে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দেয়। বানরটার জন্য তার মায়া হতে থাকে। তারপর সে বানরটাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ির কেউ প্রথমে বিষয়টা মেনে নেয়নি কিন্তু পরে অনেক জোরাজুরি করে তাদের রাজি করাতে হয়েছিল।
তার জন্য অবশ্য রনিকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। সে বানর পালে বলে তার সাথে অনেক বন্ধু সম্পর্ক নষ্ট করেছে। সে বানরটাকে বন্ধু করে নিয়েছে তাই তার অন্য বন্ধুর দরকার হয় না।
পাঁচ.
ররি দিন দিন বেশ বড় হয়ে উঠছে। সেই সাথে তার দুষ্টুমির পরিমাণটাও বাড়ছে।
তাই গলায় শিকল দিয়ে বেধে রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তার ক্ষুধার পরিমাণটাও বাড়ছে। আগের থেকে এখন দ্বিগুন খাওয়া লাগে তার। আর সময় মত খাওয়া না পেলে এমন ভাব করে যেন, আহা! বেচারা কতই না হতভাগা। তার খাওয়ার সময় হলে কিচ্ কিচ্ ডাকতে থাকে।
রনি কাছে থাকলে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রনির মতো বাড়ির অন্যরাও বানরটাকে কিছুটা আপন করে নিয়েছে। তাই রনি বাড়িতে না থাকলেও তারাই সাধারণত বানরটাকে খাইয়ে থাকে।
ররির অভ্যাস ও দিন দিন বেশ খারাপ হয়ে উঠছে। সামনে যা কিছু পায় সব মুখে দিয়ে বসে।
সাবান থেকে শুরু করে ছাই ও মাঝে মাঝে মুখে দিয়ে খেয়ে বসে।
ররিকে আজ শিকল দিয়ে বাধা হয়নি। রনিরও কথাটা মনে ছিল না। আজ খোলা পেয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে বানরটা। রোদ পোহানোর জন্য গিয়ে বসল ঘরের টিনের চালটায়।
ক্ষেতে ঔষধ দিয়ে রনির বাবা কীটনাশক ঔষধের বোতলটা রেখে দিল বাড়ির উঠানে। ররি ঘরের চালে বসে সে দৃশ্য দেখতে লাগল। যখন রনির বাবা উঠান থেকে চলে গেল ররি তখন চাল থেকে উঠোনে নেমে আসে। সে বোতলটা দেখে ভাবল, নিশ্চয় কোন খাওয়ার জিনিস হবে। তা সে আস্তে বোতলটার মুখ খুলে গপাগপ গিলতে থাকে।
তার জানাও ছিল না যে, এটার ভিতর সত্যি কি ছিল! ররির মাথাটা কতক্ষণ ঝিমাতে লাগল। সে বুঝতে ও পারল না তার কি হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বানরটা ঢুলতে ঢুলতে মারা যায়। মাঝ উঠানেই ররি ঘুমিয়ে পড়ল অতল ঘুমে। ব্যাপারটা এখনো কারও চোখে পড়েনি।
স্কুলে কেন জানি কিছুতেই রনির মন বসছে না। ররির কথাই বারবার মনে হচ্ছে। ররিকে দেখার জন্য রনি টিফিন টাইমেই বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে এসে রনির মনটা আর ও খারাপ হয়ে যায়। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে এটা যেন মরা বাড়ি।
সে দাদা, বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করে সবাই এত মুখ গোমড়া করে আছে কেন। কিন্তু অবাক কান্ড তারা কেউই তার কথার কোন উত্তর দিচ্ছে না! হঠাৎ রনির দৃষ্টিটা উঠানের দিকে যায়। আস্তে তার হাটা যেন বন্ধ হয়ে যায়। রনি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। রনি তার বুকে একটা ভীষন ব্যাথা অনুভব করল।
সে বুঝতে পারল তার বুক ফেটে কান্না আসছে। সে কান্নাকে থামিয়ে রাখতে পারে না। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা আপনিই বয়ে যায়। তার বাবা তাকে স¦ান্তনা দেয়, কাঁদিস না, আমি তোকে আরো ভাল চেয়ে একটা বানর এনে দেব। কিন্তু এসব স¦ান্তনা রনির মনে কোন প্রভাব পেলতে পারে না।
তবু ও সে বলে, ররিকে তো আর এনে দিতে পারবে না।
তার চোখ দিয়ে পানি শুধুই পড়ছেই কোন বন্ধ নেই। গ্রামের অনেক লোক এসেছে বানরটাকে দেখতে। তা দেখে রনির রাগ আরো বেড়ে যায়। সে বলে, ররি মরেছে এখন সবাই তামাশা দেখতে এসেছে যাও সবাই এখান থেকে চলে যাও।
ররি চলে যাওয়াতে সবার মাঝে কেমন জানি একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তার দাদা, স্কুলের টিচাররা ররিকে পছন্দ না করলে ও ররির মৃত্যুতে সবার চোখেই যেন জল এসেছে। আগের মত ররিকে নিয়ে সবার মধ্যে হৈ চৈ কিছুই নেই। ররির কারণে পুরো বাড়িটা যেন নীরব নিস্তব্দ হয়ে গেছে। একটা তুচ্ছ প্রানী ও যে কতকিছু শূন্য করে দিতে পারে এটাই তার প্রমান!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।