শফিক হাসান সন-তারিখের হিসাবে কোনো বাংলাদেশির কাছে যদি সবচেয়ে কষ্টের কথা জানতে চাওয়া হয়, উত্তর আসবে_ '৭১। আবার যদি সবচেয়ে সুখের কথা বলতে বলা হয়, তাও '৭১! এই একটি সালকে ঘিরে রয়েছে পুরো একটি জাতির আনন্দবেদনার যুগলবন্দি। গ্রামগঞ্জে এখনো দুষ্টু বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে 'পশ্চিমা'রা আসছে_ ভয় দেখান মা-দাদি-নানিরা। ভয়ঙ্কর দৈত্য কিংবা বনমানুষের জায়গায় অনায়াসে স্থাপন করে দেয়া যায় বর্বর পাকিস্তানিদের মুখ।
স্বজনহারাদের মনে এখনো দগদগে ঘা হয়ে ব্যথা জাগায় একাত্তর।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ খুব সহজেই অশ্রুসিক্ত করে দেয় কথককে। একই অনুভূতি নিজের ভিতর উপলব্ধি করে শ্রোতাও বেসামাল না হয়ে পারে না।
সুখের ভেতর যেভাবে ঘাপটি মেরে থাকে বেদনা, তদ্রূপ বেদনায়ও নিহিত থাকে সুখের আবেশ। এ পবিত্র সুখ বুকে ধারণ করে আশ্রয় খুঁজে পান ক্ষতিগ্রস্তরা। বেদনার পাশাপাশি একাত্তরকে ঘিরে যে আনন্দ, তাও বড় পবিত্র।
দুর্বিনীত এক অহঙ্কারের নাম একাত্তর। স্বাধীনতা উত্তরকালে এ মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ফি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে যে কর্মযজ্ঞ উদযাপিত হয়_ এক কথায় তুলনাহীন। টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে, বিভিন্ন ধরনের পত্রপত্রিকা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূর্ত করে তোলার চেষ্টায় রত থাকে দিবসগুলোকে।
ছবির ভিতরের ছবিকে আরো জ্যান্ত করে তোলে।
এ ফিরে দেখা শুধু ফিরে দেখাই নয়, শেকড় সন্ধানের আন্তরিক প্রচেষ্টাও। সুখের বিষয়, জাতীয় জীবনে সামগ্রিকভাবে যেমন মুক্তিযুদ্ধকে দেখার চেষ্টা করা হয়, সেই ধারায় শুরু হয়েছে আঞ্চলিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার মনোভাব। এ মহতী প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা দেখি বিভিন্ন জেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত বই। এ পর্যন্ত বেশ কিছু জেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে।
কোনোটি কারো একার গবেষণা আবার কোনোটি সম্পাদনা। একক গবেষণার একটি উদহারণ মুহম্মদ সায়েদুর রহমান লিখিত প্রসঙ্গ : মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ। এ বইকে লেখক তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। এ অধ্যায়ের শুরুতে আলোকপাত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি প্রস্তুতের ক্ষেত্রতে।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে উপমহাদেশ, পাকিস্তানের অমানবিক শাসন শোষণ বঞ্চনার ফলশ্রুতিতে যে আন্দোলন পুঞ্জিভূত হতে থাকে সেটা 'ঝপাৎ' করে ঝরে পড়ে একাত্তরে। অবশ্য এটাকে ত্বরান্বিত করতে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের ভূমিকাই ছিলো মুখ্য। নারকীয় এক গণহত্যার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ উত্তাল হয়ে ওঠে, বিক্ষুব্ধ, গুমোট এবং থমথমে পরিস্থিতির অবসান ঘটে ডিসেম্বর মাসে। মার্চ থেকে একাত্তর_ সময়ের হিসাবে এটি 'মাত্র' নয় মাস। কিন্তু নয় মাস কি প্রকৃত অর্থেই নয় মাস? তারচেয়ে আরো অনেক অনেক বেশি কি নয়!
এই নয় মাসে রচিত হয়েছে কত বেদনাগাথা, অঙ্কিত হয়েছে কত অশ্রুজল, রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার সুফলা জমিন, কত নারীর বুকফাটা আর্তনাদে কালো থেকে নিকষ কালো হয়েছে সুনীল আকাশ।
সেই আকাশে ধূর্ত চিলের আনাগোনার কমতি ছিল না। স্বদেশি কিংবা বিদেশি।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি তৈরির নেপথ্যগাথা ছাড়াও এ অধ্যায়ে হবিগঞ্জবাসী সাধারণ মানুষ, ছাত্রসমাজের ভূমিকা, সেনাবাহিনীর বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ ইত্যাদি প্রাঞ্জল ভাষা বর্ণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বে বিধৃত হয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের খুঁটিনাটি। হবিগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিরোধ যুদ্ধের অনুপুঙ্খ বিবরণের জের ধরে পাওয়া যায় হবিগঞ্জের ট্রেজারি অভিযান, শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্য গুদাম অভিযান, গ্যাসফিল্ড, মাধবপুর, হলদারপুরের বিমান হামলা, মৌজপুর, শাহাজী বাজার, নোয়াপাড়া, শাহাপুর, তেলিয়াপাড়া, চুনারুঘাট, আন্দিউড়া, নলুয়া, ভবানীপুর, চান্দপুর চা বাগান প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্র।
এ চিত্র কখনো কখনো যেমন আশা জাগানিয়া, তেমনি আবার হৃদয়বিদারকও।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান, হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ, গেরিলা হামলা, যুদ্ধ-পরিকল্পনা, কৌশল ইত্যাদি বিধৃত হয়েছে। তবে এ পর্বের অনেক লেখাই 'কোট' হিসেবে ব্যবহৃত। নানাজনের নানামুখী চোখ_ এ কারণে কখনোসখনো কোনো কোনো তথ্য পরস্পরবিরোধী রূপে ধরা দেয়। এ খুঁতটুকু এড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই।
বাস্তবিক কারণে এজন্য লেখককে দোষারোপ করা যাবে না। এ অংশে বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকা, বুলেটিন ও সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশই রয়েছে বেশি। অবশ্য লেখক প্রতিটি উদ্ধৃতির উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সমরনায়কদের কীর্তিগাথা। সিলেট অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজী, মেজর জেনারেল এমএ রব বীরউত্তম, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত বীরবিক্রম, জগৎজ্যোতি দাস বীরবিক্রম, রমিজ উদ্দিন বীরবিক্রম, আব্দুর রহমান বীরবিক্রম, আব্দুল হক বীরবিক্রম প্রমুখের শৌর্য-বীর্য প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চিত্রাবলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠেছে।
মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের অবদান, বিভিন্ন বাগানের চা শ্রমিকদের বিস্তারিত তালিকা উঠে এসেছে এ অধ্যায়ের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। 'অচ্ছুত' এ জাতি ব্রিটিশ শাসকদের কূটবুদ্ধির শিকার হয়ে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পায়নি বললেই চলে। তদুপরি বাঙালিদের কাছ থেকে তাদের দূরত্ব যোজন যোজন। চা শ্রমিকদের অবদান লিপিবদ্ধ করে লেখক শুধু ইতিহাসই বর্ণনা করেননি, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত অবহেলিত একটি জনগোষ্ঠীর প্রতি দায়ও স্বীকার করে নিলেন। আমাদের ইতিহাসবেত্তারা সাধারণত এ শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাদের এড়িয়ে যান।
ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অবদান তেমন একটা আলোচিত হয় না বললেই চলে। রথি-মহারথিদের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় সর্বদাই নিগৃহীত, অবহেলিতরা। প্রাপ্য সম্মান দূরে থাক, স্বীকৃতিটুকুও তাদের কপালে জোটে না।
বইটির আরেকটি ইতিবাচক দিক, লেখক কর্তৃক মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীরবিক্রম'র সাক্ষাৎকার গ্রহণ। স্মর্তব্য, মি. সফিউল্লাহ সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক।
সাক্ষাৎকারটিতে উঠে এসেছে অনালোকিত অনেক দিক। বিশেষ করে এমএজি ওসমানী ও কাদের সিদ্দিকীর 'সর্বাধিনায়ক' ও 'বঙ্গবীর' খেতাব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, এ দুটি খেতাব ব্যবহারই অনৈতিক। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম'র অন্যতম নেতা মি. সফিউল্লাহর অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের আরো অনালোচিত দিক। যদিও তার মতের সাথে কারো কারো দ্বিমত থাকতে পারে।
পরিশিষ্ট অংশে স্থান পেয়েছে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, স্বাধীনতা বিরোধী ব্যক্তিদের একাংশের তালিকা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, গণহত্যা ও সমাধিক্ষেত্রের তালিকা প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম এবং ইতিহাসের প্রতি অনুরাগ থেকে লেখক ও গবেষক মুহম্মদ সায়েদুর রহমান যে বইটি উপহার দিয়েছেন তা শুধু
বই-ই নয়, এক খ- অমূল্য দলিলও।
এলাকাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের যে ধারা সূচিত হচ্ছে, সেই ধারায় একদিন নিশ্চয়ই জাতীয় ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ, আরো শক্তিশালী হবে। কেননা জাতীয় জাতীয় ইতিহাসের পথ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে এ ধরনের 'আঞ্চলিক' ইতিহাসই। যে ইতিহাসে অকৃত্রিমভাবে ধরা দেবে দেশমাতৃকা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।