অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বিষয়ক
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড ইয়ারে থাকতে একটি টিউশন জোগাড় করে নিই। এটা একটা আশ্চর্য বিষয় যে স্কুলবয়েসী সন্তানকে ইংরেজি পড়ানোর জন্য অভিভাবকগণ ইংরেজির শিক্ষার্থী খোঁজেন; যাই হোক। শিক্ষার্থী ক্লাস এইটে পড়ত। বলতে গেলে ওটাই ছিল আমার প্রথম (এবং শেষ) টিউশন। আমি চাইতাম টেক্সট বই এর উপর শিক্ষার্থীর দখলটা ভাল থাক, রেজাল্ট এমনিতেই ভাল হবে।
কিন্তু পড়ানো শুরু করে দেখলাম বিষয়টি ঠিক এভাবে চালানো যাচ্ছে না। আমাদের সময় যেমনটি ছিল এখন আর ইংরেজি কারিকুলাম তেমনটি নেই। এখন ইংরেজি পড়ানো হয় কম্যিউনিকেটিভ অ্যাপ্রোচে। প্রতিটি লেসন শুরু হয় কোন একটি সিচুয়েশন নিয়ে কথোপকথনের বা কোন একটি ছবির উপর আলোচনার অথবা কোন ইন্সট্রাকশন শুনে সেই অনুসারে কাজের নির্দেশনা দিয়ে। আমি প্রথম প্রথম এই কনভার্সেশনগুলো প্র্যাকটিস করাতাম।
কিন্তু এক সময় মনে হল এভাবে এগোলে আমার স্টুডেন্ট তার বন্ধুদের তুলনায় পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করবে; কারণ পরীক্ষায় কনভার্সেশন করতে বলা হবে না। তাই পরীক্ষায় আসবে না এমন বিষয় নিয়ে ‘সময় নষ্ট’ না করে আমার স্টুডেন্টকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে লাগলাম। ক্রমে আমার প্রশ্ন জাগতে লাগল- যে বিষয়টি টেক্সট বইয়ে শেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা পরীক্ষায় আসে না কেন ? পরীক্ষায় না আসলে সেই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী সময় দেবে কেন ?
‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইগুলোর ভূমিকায় বলা আছে যে ইংরেজি একটি স্কিল বেইজড সাবজেক্ট। এখানে কনটেন্ট এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উপযুক্ত সিচুয়েশনে ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখা। তাই এই বইগুলো ভাষার চারটি বেসিক স্কিলের উপর গুরুত্ব দিয়ে রচনা করা হয়েছে।
আমরা জানি যে ভাষার চারটি বেসিক স্কিল হল লিসেনিং, স্পিকিং, রিডিং ও রাইটিং। ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইগুলোর কন্টেন্টে যে ধরণের ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে তাতে এই চারট স্কিলই চর্চা করা সম্ভব। এই স্কিলগুলোকে কীভাবে চর্চা এবং মূল্যায়নের মধ্যে নিয়ে আসা যায় সে সম্পর্কে ন্যাশনাল কারিকুলামে বলা আছে। কারিকুলাম এর প্ল্যান অনুসারে লিসেনিং এবং স্পিকিং অংশের মূল্যায়নের জন্য ক্লাস-ওয়ার্ক এর কথা বলা আছে। এই স্কিল বিষয়ে একজন শিক্ষার্থীর ক্লাস পারফরম্যান্স এর উপর মার্কিং করে তা ফাইনাল পরীক্ষায় যোগ করার কথাও বলা আছে।
কিন্তু এসবই গ্রন্থগত বিদ্যা, মানে পরহস্তে ধন। কোন স্কুল-কলেজে (অবশ্যই আমি বাংলাদেশের সাধারণ দৃশ্যপটে কথা বলছি) লিসেনিং বা স্পিকিং প্র্যাকটিস হয় না; এর উপর ক্লাস পারফরম্যান্সও হয়না; মার্কিংও হয় না; আর তা যোগও হয় না। কেন হয়না সে প্রশ্নও কেউ করে না। অবশ্য প্রশ্ন করাটা হাস্যকর দেখাবে। কারণ ন্যাশনাল কারিকুলামে এই কথাগুলো বলার পরও পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে লিসেনিং এবং স্পিকিং স্কিল যাচাই এর কোন পদ্ধতি রাখা হয় নি।
এর অর্থ দাঁড়াল এই যে আমাদের ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইগুলো যেভাবে ডিজাইন করা তার সঙ্গে পরীক্ষা পদ্ধতির মিল নেই। তাই বইগুলোর উদ্দেশ্য অংশত অর্জিত হচ্ছে, বাকিটা হচ্ছে না। এর পেছনে যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই রুরাল। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সেখানেই বসবাস করে এবং অবকাঠামো থেকে শুরু করে অন্যান্য সাপোর্ট না থাকাতে ভাষার সবগুলো স্কিল প্র্যাকটিস সম্ভব নয়। হ্যাঁ, অবকাঠামো একটি সত্যিকার সমস্যা।
কিন্তু তারপরের বড় সমস্যা নিশ্চয়ই দক্ষ শিক্ষকের অভাব। লিসেনিং এবং স্পিকিং এ দক্ষ শিক্ষক গ্রামাঞ্চলের স্কুল-কলেজে চাকরি করবেন এটি ভাবা যায় না। কিন্তু কেন ভাবা যায় না ? কারণ, একজন স্কুল বা কলেজ শিক্ষক যে বেতন পান সেটি কোনভাবেই একটি পরিবার চালানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। শহরাঞ্চলে বেতনের বাইরে রোজগারের সুযোগটা বেশি। শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হলেও যারা শিক্ষাকার্য সরাসরি পরিচালনা করে থাকেন সেই শিক্ষকগণের প্রতি সত্যিকার মনযোগ দেওয়া হয় কি ? অন্যান্য পেশার তুলনায় একজন শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান (যা নিশ্চিতভাবেই আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে) সুস্পষ্টতই ব্রাইট স্টুডেন্টদেরকে শিক্ষকতায় আসার জন্য নিরুৎসাহিত করে।
(একবার কথায় কথায় এক বন্ধুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের দুর্দশার কথা বলেছিলাম। সে আমাকে হতাশ করে বলেছিল যে ঠিকই আছে। তার যুক্তি হল এইচএসসি পাশ করে এর চেয়ে বেশি কী আশা করা যায় ? আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে সিস্টেমটা পালটানো উচিত। প্রাথমিক শিক্ষক এর শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি চাওয়া হবে কেন ? এই চাওয়াটাতেই তো গলদ। এই চাওয়াটাতেই তো প্রতিফলিত হয় যে শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ প্রাথমিক পর্যায় নিয়ে রাষ্ট্রের তেমন উচ্চাশা নেই।
তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম। )
তার পরের কথা হল বই এর কলেবর এবং তা সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের অসামঞ্জস্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এসএসসি লেভেলের ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইটিতে ১৪টি ইউনিটে মোট ৭৩টি লেসন আছে। এইচএসসি লেভেলে আছে ২৪টি ইউনিটে মোট ১৫৮টি লেসন। ন্যাশনাল কারিকুলাম ২০১২ এর বার্ষিক ছুটি এবং কার্যদিবসের তালিকায় ছুটি ১১৮ দিন, দিবস উদযাপন উপলক্ষে ক্লাস বন্ধ ৫ দিন, পরীক্ষার জন্য ২৪ দিন বাদ দিয়ে ক্লাস কার্যক্রম চালনার জন্য ২১৮ দিনের কথা বলা হয়েছে।
আমার বিস্ময় জাগে ২১৮ দিনের প্রতিটি দিনই যদি সঠিকভাবে ক্লাস হয় তার পরও কীভাবে আশা করা যায় এসএসসি শিক্ষার্থীরা ৭৩ টি এবং এইচএসসি শিক্ষার্থীরা ১৫৮ টি লেসন যথাযথভাবে সম্পন্ন করবে যেখানে ইংরেজিই (এটি শুধু প্রথম পত্রের কথা) তাদের একমাত্র পাঠ্য নয়।
এখানেই শেষ নয়। ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইগুলোর সব এক্সেরসাইজও যদি কেউ করে ফেলে, পরীক্ষা দিতে গিয়ে তার মনে হবে এমন প্রশ্ন সে এই প্রথমবার দেখছে। অর্থাৎ বই এর এক্সেরসাইজ আর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের ধরণ এক রকম নয়। পরীক্ষায় যে ধরণের প্রশ্ন আসে সেই আঙ্গিকে রচিত হয়েছে চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন এর অ্যাডভান্সড সিরিজের বইগুলো।
এই চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন এর বইগুলো অলিখিতভাবে মূল বই এর কমপ্লিমেন্টারি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই এখন সিদ্ধ যে চৌধুরী অ্যাণ্ড হোসাইন ছাড়া পড়ানোই যায় না। কিন্তু কেন ? টেক্সট বই এর এক্সেরসাইজ সম্পূর্ণ করাটাই পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য যথেষ্ট হবে না কেন ?
অনেকে জানেনই না যে টেক্সটবুক বোর্ড এর গ্রামার বই আছে। ক্লাস সিক্স-সেভেন-এইট এর জন্য একটা, নবম-দশম এর জন্য একটা এবং একাদশ-দ্বাদশ এর জন্য একটা। আমি একাদশ-দ্বাদশ এর গ্রামার বইটা পড়েছি।
এটি অত্যন্ত ভাল গ্রামার বলে মনে হয়েছে। আমি জানিনা কেন আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে এই গ্রামার বাদ দিয়ে আবারো সেই চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন পড়ানো হয়।
শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা বাচালতা। বর্তমান বিশ্বে ইংরেজি একটি অর্থকর সাবজেক্ট। এটি একটি ভাল মূলধন যার সুদ দিয়ে বেশ ভালভাবেই জীবিকা নির্বাহ হয়।
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই সাবজেক্টটি পড়তেই হয় এবং দক্ষ হতেই হয়। আমাদের ইংরেজি শিক্ষার পথে এই অসঙ্গতিগুলো আদৌ কাম্য নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।