এদেশ আমার
বর্তমান বিশ্ব মার্কেটিং এর। প্রতিটি পেশার সাথে জড়িয়ে গেছে এ ডিসিপ্লিন। মুনাফাভোগী, অমুনাফাভোগী সব প্রতিষ্ঠানই মার্কেটিং এর টেকনিকগুলো ব্যবহার করছে। মার্কেটিং এর টেকনিকগুলোর প্রতিটির সাথে জড়িয়ে আছে ফলপ্রসূ যোগাযোগ। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়।
আর যোগাযোগকে ফলপ্রসূ করতে ভাষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। তাই কর্মজীবনে সফলতা অর্জনে ভাষা শিক্ষার জুড়ি নেই। উন্নত বিশ্বে প্রত্যেক শিক্ষার্থী একাধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে থাকে। চীনা ও জাপানীরা ছাড়া প্রায় প্রতিটি জাতির উন্নয়নে ইংরেজী ভাষায় দক্ষতার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতের তরুনদের বর্তমান বিশ্বজয়ের মিশনে ভাল ইংরেজী জানা সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করছে।
আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর আবেগের বশে ইংরেজির উপর কম জোর দেয়া হলেও বর্তমানে সব কারিকুলামে ইংরেজির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির মর্যাদাই যেন আলাদা। সবাই সমীহ করে চলে। কেউ যখন কথার মধ্যে দু চারটি ইংরেজী বলে, তখন তার কথা সবচেয়ে বেশী মর্যাদা পায়। শুধু ইংরেজী কেন? ভাল বাংলায় কথা বলতে পারলেও মানুষের মন জয় করা যায়।
খুব জ্ঞানগর্ভ কথাও গুছিয়ে বলতে না পারলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না। আবার সাধারণ কথাও সুন্দর করে বলতে পারলে মানুষের মনযোগ আকর্ষণ না হয়ে যায় না।
তাই শিক্ষার প্রাথমিক ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে ভাষা শিক্ষা। আমাদের দেশে বাংলার পাশাপাশী ইংরেজী ভাষা শিখানো হয় ইংলিশ মিডিয়ামে প্লে-গ্রুপ ও বাংলা মিডিয়ামে ক্লাশ ওয়ান থেকে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল- প্রায় দশ বারো বছর ধরে ১০০/২০০ নম্বরের পরীক্ষার জন্য স্কুলে, ঘরে, টিউটরের মাজারে পড়াশোনা করেও আমাদের তরুনদের অধিকাংশই ইংরেজী পড়তে ও লিখতে কিছুটা পারলেও না পারে হয়।
আবার একই ছাত্র তিন বা চার মাসের স্পোকেন ইংলিশ কোর্স করে মোটামুটি ভালই বলতে ও শোনে বুঝতে পারে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন যেসব শিক্ষক ছাত্রদের শিক্ষা দিচ্ছেন তাদের মধ্যে খুব কমই ভালভাবে কথা বলতে বা বুঝতে পারেন। ফলে যা হয় ক্লাশে ছাত্ররা কখনও ভাল ইংরেজী এমনকি বাংলায়ও কথা শুনতে পায় না। শিক্ষকরা অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা হলে থাকেন। ভাষা শিক্ষা মূলত শোনার উপরই নির্ভর করে।
শিশুরা যে পরিবেশে বড় হয়, সে পরিবেশের ভাষা, উচ্চারণভঙ্গি রপ্ত করে ফেলে। তাইত শিক্ষকদের ভাষাগত দক্ষতার প্রয়োজন সর্বাধিক, বিশেষভাবে তা প্রাইমারী ও মাধ্যমিক স্তরে।
শিশুরা ভাষা শিখে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে। বিনোদনের মাধ্যম ভাষা শিক্ষায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিশুরা কার্টুন মুভি পছন্দ করে।
যেহেতু আমাদের সন্তানদের বাংলা ও ইংরেজীতে দক্ষতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন, সেহেতু ভাল বাংলা বা ইংরেজীতে এসব মুভি প্রদর্শন করতে পারলে ওদের বিনোদনের পাশাপাশি ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেত। কিন্তু বাংলায় ডাবিং করা এমন সব মুভি চ্যানেলগুলোতে দেখানো হচ্ছে যা ওদের ভাষাকে আরো দূর্বল করতে বলতে বা না পারে শুনতে। অর্থাৎ শোনা ও বলার দক্ষতা খুবই কম উন্নয়ন সাহায্য করবে। কিছুদিন আগেও অনেকগুলো চ্যানেলে ইংরেজী মুভি ও ডকুমেন্টারী দেখানো হত। যেমন কার্টুন নেট ওয়ার্ক, পোগো, নিক, ডিসকভারী, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, হিষ্ট্রী ইত্যাদি।
বর্তমানে প্রায় সবগুলোতেই হিন্দিতে তৈরী ও ডাবিং করা মুভি ও ডকুমেন্টারী প্রদর্শন করা হচ্ছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ইদানিং বাংলায় চালু হলেও বাংলার পাশাপাশী ইংরেজী চ্যানেলটির প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রদর্শিত শতকরা ৮০ ভাগ চ্যানেলে হিন্দিতে প্রোগ্রাম হচ্ছে। এর ফলে পরিবারের ছেলে বুড়ো সবাই মনের অগোচরে হিন্দিতে দক্ষ হয়ে উঠছে। প্রায়ই হিন্দিতে কথা বলছে।
এদেশের ছেলেমেয়েরা হিন্দিতে দক্ষ হয়ে উঠলেও ভারতে তরুনরা অনর্গল ইংরেজীতে কথা বলছে। এদেশের ছেলেমেয়েদের হাতে হিন্দি ভিডিও সিডি আর ভারতের তরুনদের হাতে হিন্দির পাশাপাশী ইংরেজী নভেল, সিডি শোভা পাচ্ছে। এদেশের তরুনরা বলিউড স্টারদের অপেন স্টেজ প্রোগ্রামের টিকেট এর জন্য যখন উদ্বিগ্ন তখন ওদেশের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটারের কোন প্রোগ্রামিং বা কোন কুইজ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ নিয়ে চিন্তিত। এদেশের চ্যানেলগুলোতে যখন রাত ৯-১০টায় প্রেমের নাটক, ছবি, গান এর অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে ভারতের অনেক চ্যানেলে তখন কৌন বনেগা ক্রোড়পতি, দাদাগিরি টাইপ কুইজ প্রোগ্রাম দেখানো হয়। কারণ হিসাবে অনেকে বলবেন এ হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির যুগ।
আমরা গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক। আমাদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে ওয়ার্ল্ড মার্কেট, স্বাস্থ্য হু (WHO), নিরাপত্তা এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড র বা মোসাদ, বিনোদন বলিউড বা হলিউড তাহলে প্রশ্ন জাগে একটি দেশের সরকারের দায়িত্ব তাহলে কি? কেন তাহলে ভারতের মত বন্ধু রাষ্টের আশীর্বাদপুষ্ট সরকার এদেশে ক্ষমতায় থাকাকালীন একটি চ্যানেলের ও প্রবেশাধিকার ওদেশে নেই? এমন চ্যানেলও এদেশে রয়েছে যারা রাতদিন জপ করছে। মুরিদান হিসাবে কি স্বীকৃতি এখন আসে নাই? প্রত্যেকটি সরকারের দায়িত্ব দেশের নাগরিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ। ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাইজির ঘরে নাচগানে মগ্ন রেখে কোন সরকারই আত্মতৃপ্তি পেতে পারে না। দেশের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই দেয়ার নাম করে এদেশের সক্ষ্ম প্রকাশনা শিল্প এর মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে দেয়ার মধ্যে আর যা থাকুক দেশপ্রেম থাকার কথা নয়- যতই ঢাক ডোল বাজানো হউক না কেন?
বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল ঠিক রাখতে দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যখন খুবই জরুরী, তখন সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে দেশপ্রেমের ধ্বজ্জাধারী, বুদ্ধিজীবিদের আশীর্বাদপুষ্ট কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মেগা প্রজেক্ট গ্রণন করলেন-যে প্রজেক্টের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হবে তথাকথিত স্টাকচারাল পরিবর্তনে।
এই স্টাকচারাল পরিবর্তনে শিক্ষার মান কতটুকু বৃদ্ধি পাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ পাঁচ শ্রেণী বিশিষ্ট প্রাইমারী স্কুলের অনেক দেশে শিক্ষার মান ঈর্ষণীয় পর্যায়ে রয়েছে।
এদেশের ঐতিহ্য একদল বিশিষ্ট জাতীয় সংসদের ধারাবিবরণী প্রকাশের জন্য নতুন চ্যানেল আসল। কিন্তু অনেক দিনের প্রত্যাশা শিক্ষা বিষয়ক একটি চ্যানেল এখনো আলোর মুখ দেখল না। জাতীয় সংসদের কার্যক্রম যখন থাকবে না তখন সরকার চাইলে এই চ্যানেলটিকে গুরুত্বপূর্ণ একাজে লাগাতে পারে।
অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের ভাষা শিক্ষাকে ফলপ্রসু করে তুলতে এগিয়ে আসতে পারেন। বাংলার পাশাপাশী ইংরেজী নিউজপেপার, সিলেক্টেড ইংরেজী মুভি, এনকার্টা ও এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার আপডেটেড ভার্সান, করুন। প্রিন্টেড ও ভিজুয়াল ডিকশনারী, থেজারাস কিনে দিন। সর্বোপরী বাসায় শুদ্ধ বাংলা ও ইংরেজীতে কথা বলার চেষ্ঠা করুন।
সরকার তার মেঘা রাজনৈতিক প্রজেক্টের একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যয় করে স্কুলগুলোতে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব চালু করতে পারে।
শিক্ষকদের নিয়োগ যেভাবে হউক না কেন তারা যাতে জাতির আর ক্ষতি না করতে পারে সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিন। প্রশিক্ষন বানচালেরও ষড়যন্ত্র করতে পারে যদি সেখানে কোন মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকে। যদি মহারথিরা প্রশিক্ষণ নিতে না চান তবে তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিন। দয়া করে ছাত্রদেরকে পড়াতে দিবেন না। তাহলে কোনভাবে একটা নোট জোগাড় করে প্রাইভেট পড়াতে বসে যাবে।
আর সুযোগ পেলেই প্রাইভেট পড়ানোর ফজিলত বর্ণনা করতে লেগে যাবে। সর্বোপরী সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এদেশের তরুন সমাজকে কোন কোন ভাষা শিখাতে চায়? বাংলা ও ইংরেজী না হিন্দি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।