আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ল্যাটিন আমেরিকার চিলি কাহিনী

‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলু খড়ের জীবন যায়’- এটাই হলো ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক ট্রাজিডী। প্রকৃত কথা হলো, দুই দল দখলদারের জয়-পরাজয়ের ইতিহাস। সভ্য জগতের ডাক সাইটে মাতব্বর যারা, সেই প্রাচীন ও নব্য পুঁজির বাজার দখলদারদের দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক কাহিনী ! যাহা আমাদের কাছে কখনও বিপ্লবী কাহিনী বা চাটামটা উচ্চমার্গের হলে সমাজতন্ত্রের গুপ্ত গুজব ফেরি করে লোকাল রাজনৈতিক ফেরীওয়ালারা। দেশের রাজনৈতিক ক্যানভাসাররা উদাহরন হিসাবে স্বর্গ প্রাপ্তীর জোসের গীত হাজির করে দেশবাসীর কাছে। কিন্তু চাটামবাজ ক্যানভাসাররা কেউ খোঁজ নেয় না যে, পূঁজি এবং বাজার কে নিয়ন্ত্রণ করছে ? এই হলো আমাদের সমস্যা।

গুজবের পাখায় ভর করে ভেসে বেড়ায় শকুনের মতো নিলিমায় ! কিন্তু দৃষ্টি দেয় না নিচের দিকে যদি স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় ! তাইতো হতভাগা হিসাবে জীবনটা কেটে গেল শ্রুতী গেলা ও তার ব্যাসাতির কৃপায়। পাইরেট কলম্বাসের আগমনের পর থেকে বৃহত্তর ল্যাটিন আমেরিকা ইউরোপের জলদস্যুদের অগ্রজ দেশের নিয়ন্ত্রনে চলে যায় ধীরে ধীরে। সেই দুর্বৃত্ত দেশের নেতৃত্বে ছিলো নাইট সমৃদ্ধ ধর্মোযোদ্ধাদের বাড়-বাড়ন্ত ভূমি স্পেন ও পর্তুগাল । ধনসম্পদে সমৃদ্ধ ল্যাটিন আমেরিকা লুণ্ঠনের কাহিনী ধর্মীয় উন্মাদনায় মশগুল ও খয়রাতি ইউরোপে প্রচারিত হয় ইহজগতিক ভোগের মতো বার্তা। বহুমুখী শঠতা ও হীনমণ্যতা যাদের পাথেয়, তাদের দমাবে কে ? আধুনিক অস্ত্র ও কামান ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জন করে দখলদারিত্ব।

লুন্ঠিত বিপুল পরিমান সোনা-রূপার চালান প্রাপ্তির কারনে পাইরেটদের ডেরা স্পেন অভাবি ইউরোপকে প্রলুব্ধ করলো। তখনতো ইউরোপে গজিয়ে ওঠা ধর্মীয় হাওয়ায় দোল খাওয়া হোলী রোমান এম্পায়ারের রাজত্ব বিরাজ করছে। ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপের আশির্বাদে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী হিসাবে বিরাজ করতো বিভিন্ন নামের আজকের খ্রীষ্টান দেশগুলো। ধর্মীয় দুর্বৃত্তপনার প্রধান পৃষ্টোপোষক স্পেনের রাজা ফার্ডি ও রানী ইসাবেলার হুকুমতে চালু হলো এই অধ্যায়। সকল ভোজবাজীর শুরু হলো খেলাফত বিতাড়িত ইউরোপের স্পেন থেকে।

তাইতো সময়টা ছিল একচেটিয়া ও আগ্রাসী, খ্রীষ্টান ধর্মের উন্মেষ ঘটাতে লাগল বল প্রয়োগের মাধ্যমে। সকল রাজ রাজড়ারা তখন ইউরোপের বৃহত্তরো ভূস্বামী (তিন ভাগের মধ্যে এক ভাগ ভূ-খন্ডের মালিকানা) এবং ক্যাথলিক খ্রীস্টীয় জগতের প্রভু পোপের আশির্বাদে পেটোয়া বাহিনী মর্যদায়। পাইরেট স্পেনিস বা পর্তুগিজরা দখলকৃত ভূ-খন্ডে রাজার মালিকানা এবং যাহা দখলদারদের ভূস্বামীর স্বত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বরং খেত-খামার বা খনিগুলো হাতালো মুখ্যত আর একদল নবাগত পাইরেট বৃটেন, ফ্রান্স এবং ডাচরা মহাজনের ভূমিকায় বিচরণ করতো। স্পেনীয় বংশদ্ভূত সাইমন বলিভার পরবর্তী ল্যাটিনে মালিকানার পরিবর্তন দেখা যায়।

তাও স্থানীয় মালিকানা নয়, বরং দখলদার ইউরোপীয় পূঁজিকে বিদায় জানালো তাদেরই বংশভুত মার্কিন ট্যাগের পূঁজির মালিকরা রিপাবলিকের দোহাই দিয়ে। খেত-খামার থেকে খনি, চিনিকল ইত্যাদি সকল পূঁজির মলিকানা পরিবর্তন হয়ে ইউরোপীয়দের গলা ধাক্কা দিয়ে উত্তর আমেরিকার ব্যবসায়ীদের দখলে বাজার চলে যায়। এই গলাধাক্কা অনুষ্ঠানকে রিপাবলিক বা অন্য যে কথাই বলা হোক দখলদার আমেরিকার তরফ থেকে। সকল ভূগোল পাঠ করানো হয়েছিল লুন্ঠিত ল্যাটিনদের নতুন রিপাবলিক নামক বেড়ীতে বন্দী রাখতে। শুরু থেকে ল্যাটিন শাসন হতো স্পেনিস বা পর্তুগিজ বংশদ্ভূত রাজ প্রতিনিধিদের দ্বারা।

স্থানীয় মানুষদের অবস্থা ছিল শুরু থেকেই দাসত্বের জালে বন্দী আদম। বর্তমান ল্যাটিন নেতা স্যাভেজ বা মোলাসেস হলো অতীতের সেই দাসেদের বর্তমান উত্তম পুরুষ। কিন্তু চিলির মার্কসবাদী আলেন্দে ছিলেন স্পেনিস বংশভুত এবং ইউরোমুখী বিশেষ করে লন্ডন পন্থী সমাজতন্ত্রী রাজনীতিবিদ। তিনি কিন্তু সিমেটিক মাকর্সের বয়ানে ব্যক্তি হিসাবে হ্যাভ নট(সর্বহারা) কখনও ছিলেন না। মার্কসবাদী নেতা আলেন্দে ১৯৭০ সালে জনগনের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

এই নির্বাচনের ফল চিলি ও যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের শঙ্কিত করে তোলে। তাদের আশঙ্কা ছিল ‘আলেন্দের জয় চিলিতে সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করবে এবং সেখানে সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট সরকার ব্যবস্থা কায়েম হবে। ’ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ চিলির সঙ্গে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের জোরদার বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মলিকানাধীন বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ছিল দেশটিতে। আলেন্দে ক্ষতিপুরণ ছাড়াই বিদেশি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন ব্যবসাগুলো বাজেয়াপ্ত করে সেগুলোকে জাতীয়করণ করেন।

চিলি এমন কিছু শিল্পোন্নত দেশ ছিল না যে, সর্বহারারা ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। স্থানীয় পূঁজির কোন সাড়া-শব্দ আগে বা এখনও চিলিতে পাওয়া যায় নাই। সেখানকার বিষয়টা ছিলো প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে গড়ে ওঠা কিছু প্রসেসিং শিল্প ও খনি ইত্যাদিকে সমাজতন্ত্রের কথা বলা এক ধরনের বাতুলা। যেহেতু সমাজতন্ত্র হলো শিল্পপূঁজির পরিনতির কাহিনী। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে নববই দশক পর্যন্ত সমাজতন্ত্র হাইব্রিড বিপ্লবী তত্ব হিসাবে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায় একই চেহারা বিরাজ করতে দেখা যায়।

যার প্রভাব আমাদের দেশে পঞ্চাশ ও ষাটের দশক বা স্বাধীনতার পরবর্তী স্থানীয় পূঁজিকে জাতীয়করণ। প্রতিবেশী মহা-ভারত তো জন্মলগ্ন থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একই পোষাকের বুনিয়াদে দামড়া পূঁজির সেবাদাসী হিসাবে নিজেকে জাহির করল জগতে। বর্তমান সময়ের জগতের আলোচিত গোলযোগপূর্ণ সোমালীয়াও একদা একই কাহিনীর লীলা ভূমি ছিল। বাংলাদেশে যতো কমিউনিস্ট পাওয়া যাবে তারা কেউ কিন্তু সর্বহারা নয় ! কারণ সকল প্রজ্ঞাবান কমরেডগণ ধনীর দুলাল বা জমিদার তনয়ারা বাপের জমিদারী হারাবার ভয়ে সেজে ছিলেন কমিউনিস্ট। প্রতিবেশী ভারতের জ্যোতির থেকে বুদ্ধ বা কারাত ইত্যাদি কেউই সিমেটিক পন্ডিতের ভাষায় হ্যাভ নট নয়, বরং সকলেই হ্যাভের রসীক পাগল শুধুই নয় বরং একই রং-এর পূজারীও বটে ! তাহলে কেসটা কি ? প্রশ্ন হতেই পারে।

বিষয়টা সহজ ‘পূঁজি’ সকল সময় সচল এবং মুনাফা সৃষ্টি করবে ! ভন্ডদের সকল সময় কর্ম হলো স্থানীয় পূঁজিকে সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রিয় নিয়ন্ত্রণে রাখা। ফলে প্রভুর পূঁজি ও বাজার রক্ষা পায় ! যদি সমাজতন্ত্রের নামে স্থানীয় পূঁজিকে জাতীয়করণ করা যায়, তাহলে প্রভুরতো সোনায় সোহাগা। বরং স্থানীয় দাস-দালাল রাজনীতিকদের সার্বিক সহযোগীতায় একচেটিয়া বাজার ভোগের সুযোগ পায় ! প্রশ্ন হলো কাদের স্বার্থে বা কোন পূঁজির স্বার্থে ? সহজ কথা হলো, কোন দেশের পণ্য ও পূঁজি স্থানীয় বাজারে একচেটিয়া ভোগ করে কথিত বিপ্লবের পরবর্তী। অর্থাৎ কথিত সমাজতান্ত্রীক রাষ্ট্রের বাজারে। ভারতে যেমন লিভার, আইটিসি ইত্যাদি বা আমাদেরও একই গল্পো বা ভূট্টর রাজত্বেও একই লিভারের কাহিনী।

মি. আলেন্দের দেশেও এমন ঘটতো যেটা আমেরিকা ঘটতে দেয়নি। প্রতিদ্বন্দী ইউরোপীয় পূঁজির দালালকে বিদায় করেছিল বুলেটের মাধ্যমে স্থানীয় সামরিক পাহারাদার দ্বারা। যেমন পাকিস্তানের লিয়াকাত আলীকে বিদায় করেছিল বৃটেন অস্ত্রচুক্তি মার্কিনীদের সাথে করাতে। বা ভারতের গান্ধীকে হত্যা করায় পাকিস্তানকে মজুত নগদ অর্থ ভাগ দিতে বলায় ! যেমন কিউবার ! প্রথমে খামার সে তুলার হউক বা আখের ও কলের মালিক ছিল বৃটেন। সেখানে বৃটিসদের তাড়ায় আমেরিকা।

কাস্ত্রো যে সমাজতন্ত্রের নামে বৃটেনের পূঁজি লগ্নী করে নাই কে বলবে ? আমরা পাবো রাষ্ট্রীয় পূঁজির একদা গোলকের পুরাধা সোভিয়েত রাশিয়ার বেলায়ও তাই হতে দেখা গেছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় বৃটেনের অস্তিত্বের স্বার্থে গোজামিলের সমাজতন্ত্রের তাত্বিক ক্যাডার সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করে পঞ্চাশের দশক থেকে। বৃটিস সম্রাজ্যের কথিত স্বাধীন বাজার গুলোতে নিজের একচেটিয়া পূঁজি ও বাজার বজায় রাখতে এই সকল পরামর্শের লীলাভূমি হিসাবে বিরাজ করতে দেখা যায়। আমাদের অর্থনীতিবিদরা রাষ্ট্রীয় পূঁজিবাদকে সমাজতন্ত্র বা কৃষি নির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র বলে। সত্যকথা বলতে, হয় এরা পূঁজি বোঝে না, বা দলালী করতে যেয়ে হুস থাকে না কি বলতে কি বলছে ? তাই বিলুপ্তি হতে যাওয়া অবস্থাকে রক্ষার পথ হিসাবে লন্ডন হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের তাত্বিক ব্যাপারী।

তার মুলুকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজতন্ত্রের প্রশিক্ষণ আশ্রমে রূপ নেয় ! এখান থেকেই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের জনগনের প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েই এই সকল বন্ধা জ্ঞানের পাল্লায় পড়ে। পৃথিবীর চলমান প্রকৃতির পরিবর্তনের গতির সূত্র হলো, শুরু, বৃদ্ধি, পোক্ত, লয় ও বিলীন ইত্যাদি। বস্তু জগতের সকল বিষয় এই সর্বজন জ্ঞাত সূত্রের আলোকে প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং ভাবনার জগতের মতো কোনো বস্তুই চিরস্থায়ী নয়। এখনকার জগতের মড়োল মন্ডলদের কাল গনণায় সূত্রের ফলাফল হলো লয় যাত্রার অভিযাত্রীর তালিকাভুক্ত।

আর ল্যাটিনদের আগা গোড়া সমস্যা হলো স্থানীয় পূঁজির বিকাশে রাজনৈতিক বাগড়ার শিকার। বাংলাদেশের আকিজ, বসুন্ধারা ও যমুনা ইত্যাদি। ভারতের টাটা, মিত্তাল ও আম্বানীসহ অন্যান্যরা। এরা জগতে পরিবর্তন সূত্রের মতে, পুঁজির ‘শুরু’তেই বিরাজ করছে। আর সিমেটিক পন্ডিতের মতে, পুঁজির অর্জিত হয় মাথায় বাড়ীতে।

তাইতো বলা যায়, স্থানীয় পুঁজির বিকাশ ছাড়া ল্যাটিনদের মুক্তি নাই লেখাটি খুলনা জার্নালে পুর্বে প্রকাশিত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.