আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূরে আছি, তবু কাছাকাছি!!

যে বিশ্বাস নিয়ে একটা ছোট্ট শিশু হেসে ওঠে তাকে পরে ছুড়ে দেয়া হলে, তেমনি বিশ্বাস আমি করি তোমাকে। আমি জানি তুমি দুঃখ কখনও দেবেনা আমাকে। প্লাবনের সাথে আমার পরিচয় নেট এ। ২০০২ সালের কথা। আমি তখন সবে ক্লাস ১০ এ পড়ি।

একদিন হঠাৎ মনে হল একটা চ্যাট রুমে যেয়ে দেখি, মানুষ কি করে, কি বলে। অনেক মানুষ কথা বলতে চায় আমার সাথে। অনেকে অনেক ভাল কথা বলে, অনেকে বাজে কথা বলার চেষ্টা করে। চ্যাটিং এর ৬ষ্ট দিনে প্লাবনের সাথে আমার কথা হয়। ছেলেটা ভাল।

অনেক কথা হয় ওর সাথে। ওর বয়স তখন ২০। সবে এইচএসসি পাশ করে অস্ট্রেলিয়া তে গেছে। ও একা থাকে, কোন বন্ধুর সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করে। আমি বন্ধু হই ওর।

অস্ট্রেলিয়া থাকে প্লাবন। সিডনীতে। প্রতিদিন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬ টায় অনলাইন আসে ও। আমি এর আগেই পড়া শুনা শেষ করে রাখি ওর সাথে কথা বলার জন্য। টিচারদের বলি সন্ধার পরে আমি নিজে পড়ব, তাই উনারা দিনের বেলায় এসে পড়িয়ে যান।

মা জানে আমি ঘরে বসে পড়া শুনা করছি মন যোগ দিয়ে। আমার কথা হয় ওর সাথে। নানা রকম কথা হয় ওর সাথে আমার। আমার বাসার নাম্বার নেয় ও। ফোন ও করে একদিন।

কথা হয়। এর পর একদিন কি যেন একটা তে টিপ দিতে (এখন জানি আমি ভয়েস কল করে ফেলেছিলাম) শুনি স্পিকার এ যেন কার কন্ঠ। পরে বুঝলাম আমি ওর কথা শুনতে পাচ্ছি। এর পর রোজ ওর কথা শুনি আমি। আমিও একটা মাইক্রোফোন কিনে আনি।

কথা হয় দু’জনে, ঘন্টার পর ঘন্টা। ওর অস্ট্রেলিয়ার ঠিকানা দেয় আমাকে। আমি আরচিজ থেকে একটা কার্ড কিনে পাঠাই ওকে। সাথে কিছু গিফট, একটা ঘড়ি, একটা মানিব্যাগ। ও আমার ঠিকানা চায়, আমি বাবা মায়ের ভয়ে দিতে পারি না, ও বোঝে আমার ব্যপারটা।

জোর দেয়না। প্লাবনের কথা বলেছিলাম আমি বুবু কে, আমার চাচাতো বোন বুবু, আমাকে ভীষণ মায়া করে। বুবুও একদিন কথা বলেছে ওর সাথে। আমি থাকি শান্তিনগরে। ওখানে একটা বাড়ির সামনে তখন কার্ড ফোনের দোকান ছিল।

আমি প্রতি সপ্তাহে ফোন করতাম প্লাবন কে। নেটে কথা হয়ে মন ভরত না আমার। কথা চলে অনেক দিন। আমি কখনো দেখিনি ওকে। ও দেখেনি আমাকে।

একদিন কার্ডের সাথে আমার একটা ছবি পাঠাই ওকে আমি। ছবিটা ছিল আমার পুরো পরিবারের। মাঝে আমি। ছবি পেয়ে যখন জানায়, আমি ওকে বলি আমি কোনটা খুজে বের করতে। আমরা ৩ চাচাতো বোন মোটামুটি একই রকম দেখতে।

একই বয়স। ও ঠিক বলে দেয় আমি কোনটা। এতটুকু সন্দেহ নেই ওর কণ্ঠে। আমি অবাক হয়ে যাই। ওকে দেখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আমি বলিনি।

তারপর শুরু হয় রোজার মাস। আমি ওকে বলি, ওর রোজা রাখবার প্রয়োজন নেই। অনেক পরিশ্রম করে ও। রোজা রাখলে অসুস্থ হয়ে পরতে পারে। আমি ওর হয়ে রোজা রাখি।

তারপর ঈদ। ও খুব জেদ করে ঈদে আমাকে কিছু পাঠানোর জন্য। আমি বুবুকে ধরি। বুবুর এক বান্ধুবী থাকে হলে। ওর ঠিকানা আমাকে দেয়।

উনার ঠিকানায় আসে ওর দেয়া শাড়ি। ঈদে আমি দেশের বাড়িতে চলে যাই। কথা হয়না ৮ দিন ওর সাথে। সেই প্রথম আমি ওর সাথে কথা না বলে থাকি। প্রতি মুহুর্তে মনে হত আমার শ্বাস আটকে আসছে।

তখন ও আমার পরিবারে মোবাইলের সেরকম প্রচলন নেই। আমার নিজের মোবাইল ছিল না। বুবু আমাকে ঈদের দিন ছোট চাচার মোবাইল চুরি করে এনে দেয়, আমি কথা বলি ১ মিনিট ওর সাথে। এভাবেই কাটে ৩টা বছর। শেষ হয় আমার এইচএসসি পরীক্ষা।

২০০৫ সাল। শুরু হয় ভার্সিটিতে ভর্তির চেষ্টা। ও এর মধ্যে ওর অনার্স শেষ করে। আমি কখনও দেখিনি ওকে। শুধু জানি এই কন্ঠটা না শুনলে বেচে থাকা কষ্টের হয় অনেক।

এইচএসসি পরীক্ষার পর একটা মোবাইল কিনে দেয় বাবা আমাকে। আমি সাথে সাথে নাম্বার দেই ওকে। প্রায়ই ফোন করে ও। কথা হয় প্রতিদিন, আগের নিয়মে। তারপর একদিন ও অনলাইনে আসেনি।

আমি ফোন করলাম, ওর ফোন বন্ধ। আমার তো মাথা খারাপ হবার অবস্থা। আমি গুগলে সিডনীতে কোন বাঙ্গালীর কিছু হয়েছে কিনা জানার জন্য খুজতে থাকি। পাইনা কিছু। বুবুকে ফোন করি।

কাদতে থাকি। বুবু আসে বাসায়। আমাকে শ্বান্তনা দেয়। আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারিনা। ২ দিন পর মোবাইলে একটা ফোন আসে, বাংলাদেশের একটা নাম্বার থেকে।

আমি ফোন ধরি। কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে যাই। ওর কন্ঠ, অথচ নাম্বারটা বাংলাদেশের। আমি জিজ্ঞেস করলে ও হাসতে থাকে। আমার খুশি যেন আর ধরে না।

মনে হয় পুরো পৃথিবীটা আমার হাতের মুঠোয়। ও বলে ও চিটাগাং এ, ওদের বাসায়। আমি জিজ্ঞেস করি ঢাকা কবে আসবে, আমি কবে দেখব। এর ২ দিন পর ও ঢাকা আসে। আমরা দেখা করি।

আমার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখে অবাক চোখে চেয়ে থাকি আমি। দেখে দেখে যেন মন ভরে না। আমি লজ্জা পাই, কিন্তু চোখ নামিয়ে নেই না। ওকে চোখের আড়াল করতে কষ্ট হয়। চারুকলার ভেতরে, দোতলার ছাদের উপর বসি আমরা।

কাঠগোলাপ গাছের ছায়ার নিচে। আমি ওর দেয়া প্রথম শাড়িটা পরে দেখা করি। আমার হাতে কাচের চুড়ি। লাল, সাদা আর কালো রঙের। ও বসে বসে আমার সাদা চুড়িগুলো ভেঙ্গে দেয়।

বলে, আমি যেন কখনো সাদা না পরি। কাপড়েও সাদা থাকবে না যতদিন ও বেচে থাকবে। শুনে আমি ওকে সাহায্য করি চুড়িগুলো ভাংতে। সেই থেকে আজ অবদি সাদা কিছু পরিনি আমি। ও দেখতে মাশাল্লাহ রাজপুত্রের মত।

৬ ফুট লম্বা, গাঢ় খয়েরি চোখ, মাথা ভর্তি চুল, ভীষন ফর্সা, গাঢ় নীল চোখ। ও ভার্সিটির জিমে যেত। বলেনি আমায়। শরীরের গঠন ও তাই অনেক ভাল। আল্লাহ যেন অনেক যত্ন করে, নিজ হাতে ওর মুখটা তৈরি করেছেন।

আমার মত একটা মেয়েকে কি করে ও ভালোবাসল, সেই চিন্তা করি। আমি খুব খারাপ তা বলব না। কিন্তু ওর তুলনায় আমি কিছুই না। আমি উজ্জ্বল শ্যামলা, ৫ফিট ২ইঞ্চি লম্বা। একটু মোটার ধাচ আছে।

চাইনীজদের মত বোচা নাক। ওর সামনে কিছুই না। ভেবে আসলেই অবাক হই, কি করে এত ভালোবাসে ও আমাকে। ও আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কেন যানতে চাইলাম না ও আমাকে প্রথম দেখে কি দেবে। আমি ওকে দেখেই কুল পাইনা।

আর কি চাই আমার। না দেখে ভালোবেসেছি। সিনেমার মত ভাগ্য আমার। ও বলে চোখ বন্ধ করতে। আমি ওর কথা মেনে নেই।

তারপর ও আমার হাতে একটা কৌটা তুলে দেয়। আমি চোখ মেলে কৌটা দেখে অবাক হই। কৌটা খুলে আরও অবাক হয়ে যাই আমি। ওটা সিদুরের কৌটা। খুব অবাক হয়ে যাই ওর কাজে।

আমার মুখ দেখে ও অনেকক্ষন চুপ থাকে। তারপর বলে, ও আমাকে ভালোবাসতে চায়নি, কিন্তু কি করে যেন আমার ভালোবাসা ওকে স্পর্শ করে ফেলেছে। ও হিন্দু, কথাটা আমাকে আগে জানাতে চেয়েছিল, কিন্তু আমাকে হারানোর ভয়ে বলেনি কোনদিন। আমার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তখন। ও জানে আমার পরিবার কতটা সংস্কারগ্রস্থ।

কোনদিন এই সম্পর্ক মেনে নেবে না আমার বাবা চাচারা। কিন্তু এটাও জানি, ওকে ছাড়া বাচবোনা আমি। কি করব ভেবে পাইনা। বুবুকে জানাই ব্যপারটা। বুবু জানে আমি ওকে ছাড়া বাচব না।

আমাকে বলে, সময় আছে এগুলো নিয়ে ভাবার। ও মাস্টার্স করবে, আমার ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে। এখনই সম্পর্ক নষ্ট করার ও কিছু নেই, নতুন করে কিছু তৈরি ও হবে না আর। যেভাবে আছে, থাক। সেবার আরও ৩ বার দেখা হয় ওর সাথে আমার।

আবার চলে যায় ও। যাবার আগের দিন নাকি ও ওর মাকে আমার কথা বলে যায়। আবার আমার বিরহের দিন শুরু। ওর বড় বোনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয় আমার এর মধ্যে। ফোনে মাঝে মাঝেই কথা হয় দিদির সাথে আমার।

দেখতে দেখতে ২ বছর পার হয়ে যায়। ২০০৭ এর এপ্রিল মাসে একদিন ওর মন ভীষন খারাপ। কারন জিজ্ঞেস করলে বলে, দেশ থেকে ফোন এসছিল, ওর মা অনেক অসুস্থ। সেদিনের কোন ফ্লাইট নেই ঢাকা আসার। পরের দিনই ঢাকা চলে আসে ও।

ফোনে কথা হত রোজ। একদিন হঠাৎ করে দিদি ফোন করেন আমাকে। করে খুব কাদেন, আর বলেন ওকে মাফ করে দিতে। ওর দোষ কিছু ছিলনা। আমি বুঝতে পারিনা কিছুই।

আমাকে আরও বলেন, তিনি নিজেও নাকি কিছুই জানতেন না। আমি উনার কথা শুনে, কান্না শুনে ভয় পেয়ে যাই। হঠাৎ ভাবি মায়ের কিছু হল না তো! সেজন্য তিনি এমন আবোল-তাবোল বকছেন না তো! এদিকে যে আমার পৃথিবী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সেকথা একবার ও ভাবিনি আমি। দুপুরেই নামাজে বসে ওকে চেয়েছি আমি আল্লাহর কাছে। আমার পৃথিবী অক্ষত রাখার প্রার্থনা করেছি।

ওর কিছু হয়েছে, ওর মা জেদ করে ওকে হঠাৎ করে বিয়ে করিয়েছেন, ভাবতেই পারছিনা। দিদি যা বললেন, শোনার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না আমি। হাতের কাছে নতুন ব্লেডটা পেয়ে গিয়েছিলাম কোন ভাবে। বাম হাতটাকে ফালা ফালা করে কেটে ফেলেছিলাম। রক্তক্ষরনের কারনে সঙ্গাহীন হয়ে যাই।

চোখ মেলে দেখি, খোদার দুয়ারেও ঠাই মেলেনি আমার। ২০০৮ এ আমার বিয়ে হয়ে যায় ইফতির সাথে। অনেক ভাল মানুষ ও। আমাকে অনেক যত্ন করে। একটা মেয়ে হয়েছে আমার।

সুখের সংসার। তবু একটা বিরহ, একটা না পাওয়া মাঝে মাঝেই বুকে ঝড় তোলে। দুপুরে রান্নার পর, যখন কিছু করার থাকেনা, হয়ত বসে আছি, বা শুয়ে, মনে হয়, ওকে পেলে জীবনটা হয়ত আর একটু মধুর হত। স্ত্রীর ভুমিকা, মায়ের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি আমি। ভালই করছি হয়ত, কিন্তু কি যেন একটা নেই।

কোথায় যেন একটা শুন্যতা। কি মনে করে ২০১১র জানুয়ারি মাসে আবার এক রবিবার দুপুরে অনলাইন এ বসি আমি। নতুন একটা নাম দিয়ে। দেখি প্লাবিত আমি বলে একটা আইডি। অপেক্ষা করি, ওই আইডি থেকে নক করে আমাকে।

কথা হয়। বুঝতে পারি এটা প্লাবন। ও বলে ওর কথা। শুধু লিখে কথা হয়, ওর কন্ঠ শুনতে পাইনা আমি। ও বলে ওর স্ত্রীর প্রতারনার কথা।

বলে আমার কথা, বলে ও আজও আমায় ভোলেনি, সে কথা। বলে ওর একটা ছেলে হয়েছে, তার কথা। বলে আমাকেই, অন্য নামে। ওর কথাগুলো শুনে চোখের জল মুছি। আমার ভাবনাগুলোই ওর মধ্যে শুনে কষ্ট বাড়ে।

প্রতিদিন কথা হয়। কষ্ট হয় ও আমাকে চিনতে পারে না বলে। জানি চেনার কোন কারণ নেই। ও যেই আমার সাথে কথা বলে, সে অনেক সুখি, স্বামী সংসার নিয়ে আনন্দে থাকা মানুষ। অবসরে চ্যাটিং করা।

জানেনা আমিই সেই ওর ভালোবাসার মানুষটা। আবার কি মনে করে গত ২ সপ্তাহ কথা বলছি না ওর সাথে। রাগ হচ্ছে আমাকে চিনছেনা বলে, অভিমান হচ্ছে। কাল অফলাইনে বললাম ওকে, আমি কে। জানিনা আজ ও কি লিখবে আমাকে।

। আমি অপেক্ষায় আছি ওর উত্তরের। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.